বৃন্দাবনের কোন এক গোপের ঘরে নববধূ হয়ে এসেছে একটি মেয়ে। নাম তার নীরজা। বৃন্দাবন থেকে কিছু দূরে কোন এক গ্রামে তার পিত্রালয়। নীরজা বৃন্দাবনে বধূ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার শ্বশুর বাড়ির লোক তাকে সতর্ক করে দেয়—সে যেন কৃষ্ণ থেকে দূরে থাকে। কোন ক্রমেই সে যেন কৃষ্ণের সঙ্গে বেশী মেলামেশা না করে।
নীরজা ভেবে পায় না কেন তার প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা। সে শুনেছে কৃষ্ণ এক কিশোরের নাম। নন্দের আদরের পুত্র সে। সেই কিশোরকে শ্বশুর বাড়ির লোক এত ভয় পায় কেন? তাঁর মধ্যে কি এমন বৈশিষ্ট্য বা দুরন্তপনা আছে যাতে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে ভয়ে এড়িয়ে চলে? নীরজা শ্বশুর বাড়ির লোকজনের মুখে একথা শুনেছে যে কৃষ্ণের কিশোররূপে এমন মাধুর্য্যমণ্ডিত আকর্ষণ আছে যা দেখলে ঘর-বাড়ি, জগৎসংসার এমন কি দেহজ্ঞান পর্যন্ত বিস্মরণ হয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করতে না দিক ক্ষতি নেই কিন্তু তাঁকে একবার নয়নভরে দেখতে দিতে এদের আপত্তি কেন? সংসারের সকল কাজের মাঝে নীরজার মনের মধ্যে উপরোক্ত কথাগুলি বারবার ভেসে ওঠে। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায়। আসে গিরি গোবর্ধনের পুজোর দিন। আর পাঁচজন গোপবধূর মতো সে ও যায় গিরি গোবর্ধনের পূজা-উৎসব দেখতে।
গিরিগোবর্ধনের পাদদেশে পৌঁছেই সে শুনতে পায় সর্বচিত্তাকর্ষক মন হরণকারী মোহন বাঁশীর সুর। নীরজা ভাবে কে এই নিপুণ শিল্পী—যে বাঁশীর সুর ছড়িয়ে তার হৃদয়কে শরীর থেকে বের করে নিতে চাইছে। এদিক-ওদিক আকুল নয়নে খুঁজে বেড়ায় নীরজা-বাঁশীর শিল্পীকে ভিড়ের মধ্যে দেখতে পায় না। ধীরে ধীরে বাঁশীর সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে চলে নীরজা। দেখে ভীড় থেকে কিছুটা দূরে গিরি গোবর্ধনের একপ্রান্তে রয়েছে একটি মনোরম কুঞ্জবন। সেই কুঞ্জবনে এক নয়নাভিরাম নীলকিশোর আপনভাবে বিভোর হয়ে বাঁশী বাজিয়ে চলেছে। লোকজন গিরিগোবর্ধনের পূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সেদিকে কারও নজর নাই। নীরজা ধীরপদে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যায় নীলকিশোরের কাছে। নীলকিশোর নীরজাকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে—তুমি কে? তোমার নাম কি?
—আমি নীরজা, বৃন্দাবনের নব গোপবধূ। তুমিই কি নন্দ কিশোর কৃষ্ণ?
—হ্যাঁ আমিই বৃন্দাবনের নন্দকিশোর, মা, যশোদার নয়নমণি গোপাল।
—তুমি বাঁশী বাজানো বন্ধ করলে কেন?
—তুমি এলে তাই!
—আমি এসে বুঝি তোমার সাধনায় বিঘ্ন ঘটালাম বেশ তাহলে আমি যাই—
—না সখী—তুমি আসায় বিঘ্ন হবে কেন? আমি এমনিই বন্ধ করলাম। দেখছ না ওদিকে গিরিগোবর্ধনের পূজা আরম্ভ হয়েছে।
—আচ্ছা তুমি আমায় সখী বললে কেন? তুমি কি আমার সখা?
—হ্যাঁ ভাই, আমি তোমার চিরজীবনের সখা।
—আচ্ছা গিরিগোবর্ধনের পূজা হয়ে গেলে আমি তো আবার গৃহে গিয়ে বন্দিনী হয়ে যাবো। তখন তোমার সঙ্গে আমার কেমন করে দেখা হবে? আমাকে আমার স্বামী শ্বশুর বাড়ী থেকে বের হতে দেয় না। আজ উৎসব বলে আমাকে আসতে দিয়েছে—এরপর সখা তোমার সঙ্গে কেমন করে দেখা করবো? তোমার বাঁশীর গান যে আমার হৃদয়কে কেড়ে নিয়েছে বন্ধু। ওই গান কি আর আমি শুনতে পাবো না?
—তুমি ঘরে বসেই আমার বাঁশীর গান শুনতে পাবে সখী। তুমি আকুল প্রাণে যখনই আমার গান শুনতে চাইবে—তখনই আমার বাঁশীর গান তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।
—কিন্তু তোমার এই অপরূপ রূপের দর্শন কেমন করে পাবো তাতো বললে না?
—তুমি যখনই আকুল হৃদয়ে আমাকে দেখতে চাইবে, তখনই আমার দেখা পাবে। আচ্ছা সখী, এখন আমি আসি—আমার বাবা-মা বোধ হয় অনেকক্ষণ আমায় দেখতে না পেয়ে ভিড়ের মধ্যে খুঁজছে, আমি যাই।
যশোদার নীলমণি নীরজার দিকে মধুর দৃষ্টিপাত করে মৃদু হেসে চলে যায়—উৎসব মণ্ডপের দিকে। নীরজা নীলমণির চলার পথের দিকে অনিমেষ নয়নে চেয়ে থাকে—তার হৃদয় যেন প্রিয় বস্তু হারানোর বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে, হায়! হায়! এইরূপ দর্শনে এতদিন বঞ্চিতা ছিলাম আমি। নীলমণির চলার পথের দিকে চেয়ে বলে—ওগো বন্ধু শুনে যাও আজ থেকে আমি তোমার। শুধুই তোমার—আমি আমার হৃদয় মন-প্রাণ ওগো বন্ধু তোমার চরণে সমর্পণ করলাম।
উৎসব শেষে বৃন্দাবনবাসী ফিরে যায় আপন আপন ঘরে। নীরজাও ফিরে যায় কিন্তু মন রয়ে যায়—গিরিগোবর্ধনের প্রান্তে স্থিত সেই কুঞ্জবনে, যেখানে নীলমণির সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। মাঝে মাঝে সে ঘর ছেড়ে একাই বেড়িয়ে চলে আসে সেই কুঞ্জবনে—এসে দেখে তার বন্ধু গিরিবর্ধনের পাদদেশে ধেনু চরাচ্ছে বাঁশী বাজাচ্ছে। কখনও বা সখাদের সঙ্গে মল্লক্রীড়া করছে। তা দেখে নীরজার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু, এর জন্য তাকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। শ্বশুর শাশুড়ি স্বামীর গঞ্জনা-লাঞ্ছনাও তাকে কম সহ্য করতে হয়নি। অনেক অগ্নিপরীক্ষার পথ পার হয়ে তবে সে পেয়েছে পরমপ্রিয় বন্ধু নীলমণিকে।
এইভাবে, কতদিন কত বছর চলে গেল। একদিন খবর এল মথুরা থেকে অক্রূর না কে একজন এসেছে তার বন্ধুকে নিয়ে যেতে। খবর শোনামাত্রই রাধা ও অন্যান্য গোপীদের মত নীরজাও ঘনঘন মূর্ছা যায়!
অক্রূরের রথে চেপে কৃষ্ণ যখন মথুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পথে তখন সবার অগ্রবর্ত্তিনী হয়ে নীরজা রথের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে। সেদিন কোন বাধাই তাকে আটকাতে পারে না। মনে হচ্ছে কে যেন তার প্রাণপাখীটিকে বুকের খাঁচা থেকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণ রথ থেকে নামলেন। নীরজার অশ্রুসিক্ত নয়ন আপন উত্তরীয় দিয়ে মুছিয়ে দিলেন—সান্ত্বনার স্বরে বললেন,—’সখী, আমি তোমাদের সকলের সঙ্গেই আছি। যখন আমাকে স্মরণ করবে—দেখবে আমি তোমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। অনেক বুঝিয়ে নীরজাকে শান্ত করেন কৃষ্ণ।
রথ চলে যায় মথুরায়। কৃষ্ণ আর আসেন না। বাঁশী আর বাজে না বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে। কৃষ্ণবিরহ যন্ত্রণার আগুনে আর সব গোপীদের মতো নীরজার হৃদয়ও দগ্ধ হতে থাকে। শেষে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে মৃত্যু আসন্ন প্রায়। মৃত্যু শয্যায় শায়িতা হয়ে বন্ধু কৃষ্ণকে, প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণকে স্মরণ করতে করতে নীরজার দুই নয়ন দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরতে থাকে। আস্তে আস্তে দুটি শীর্ণ হাত-উপরের দিকে তুলে নীরজা বলে,—’বন্ধু, আমার যে যাওয়ার সময় আগত প্রায়। বিদায়-এর ক্ষণে বড় ইচ্ছা জাগে মনে, তোমার শ্রীমুখ দর্শন করতে করতে দেহত্যাগ করি। এসো বন্ধু মোর! এসো সখা, প্রিয়তম লইতে মোরে তব আনন্দ রথে শোনাও প্রিয় সে বাঁশীর গান—শীতল হোক তপ্ত, ক্লান্ত প্রাণ—দেরী কর কেন সখা—এত বি-ল-ম্ব হলে শে-ষ দে-খা হবে কেমন ক-রে এ-এ। নীরজার অন্তিম আকুল আহ্বানে কৃষ্ণ এসে উপস্থিত হলেন তার কাছে। কৃষ্ণ দাঁড়ালেন নীরজার শিয়রে, করকমল রাখলেন তার মাথায়। বললেন,—সখি, আঁখি খুলে দেখ আমি এসেছি।’ নীরজা ধীরে ধীরে নয়ন মেলে দেখেন। গিরিগোবর্ধনের প্রান্তে স্থিত সেই কুঞ্জবন। কণ্ঠের বাণীতে সেই প্রেম-ভালোবাসা—আন্তরিকতার ছোঁয়া। নীরজা কৃষ্ণের দিকে চেয়ে করুণ আঁখি মেলে বলে—বন্ধু, আমার পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ রাখবে?
—বলো কি তোমার অনুরোধ। শুধু একটা কেন অসংখ্য হলেও আমি তা রাখবার চেষ্টা করবো’।
—প্রথম দিন তোমার গান শুনে, গানে সুর অনুসরণ করে যেমন তোমার সঙ্গে মিলেছিলাম আজ, যাওয়ার পথে সেই বাঁশীর গান শোনাও বন্ধু—ওই গান শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি তোমার সুরের অনন্ত শয্যায়।
কৃষ্ণ নীরজার মাথায় হাত রেখে বলেন,—’সখি আজ যে আমি বাঁশী আনি নি। বাঁশী নিয়ে আসিনি বলে তুমি হতাশ হয়ো না—আমি এখনই তোমাকে বাঁশীর গান শোনাচ্ছি, তুমি একটু অপেক্ষা করো।
নীরজাকে অপেক্ষা করতে বলে কৃষ্ণ নিকটবর্তী একটি বেণুবাঁশে ঝোপ থেকে একটুকরো বেণুবাঁশ সংগ্রহ করে তা ছিদ্র করলেন এবং নীরজার মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাঁশীতে সুরের ঢেউ তুলে নীরজাকে শোনাতে লাগলেন। নীরজা সেই বাঁশীর সুর শুনতে শুনতে দ্রবীভূত হয়ে কৃষ্ণ অঙ্গে মিশে গেলেন। বাঁশীর সুরে, চোখের জলে তার সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে শুদ্ধাতিশুদ্ধ হয়ে পরম প্রিয়ের সত্তায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেন। কৃষ্ণ মথুরায় যাওয়ার সময় যে বাঁশী ত্যাগ করেছিলেন—আজ নীরজার অনুরোধে সেই বাঁশী গ্রহণ করলেন। নীরজাকে যেখানে বাঁশী শুনিয়ে তিনি পরমগতি দান করেছিলেন—আজও লোকে তাকে বংশীকুঞ্জ বলে নীরজার স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রেখেছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন