কুরুক্ষেত্রের রনাঙ্গনের একপ্রান্তে ছাউনি ফেলেছে কৌরবপক্ষ, অন্যপ্রান্তে পাণ্ডবপক্ষ। যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতির অঙ্গ এটা। এইসময় কৃষ্ণ হস্তিনা নগরেই ছিলেন। তিনি এই যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের সারথি। শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব পক্ষে যোগদান করেছেন শুনে দেবর্ষি নারদ তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শ্রীকৃষ্ণ নারদকে দেখে যথেষ্ট প্রীত হলেন এবং রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করলেন—”নারদ তোমার মতো নিরামিষী লোক এই রণক্ষেত্রে হঠাৎ কী মনে করে?”
নারদ বললেন, ”আপনাকে দর্শন করতে ও সেইসঙ্গে আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতেই আমি আপনার কাছে এসেছি।”
—উত্তম, কি তোমার জিজ্ঞাসা বলো?
—শুনলাম এই যুদ্ধে আপনি নিরস্ত্র হয়ে পাণ্ডবদের রথের সারথি হয়ে তাদের সহায়তা করবেন। আমার মনে হয় এটা আপনার পক্ষে সমীচীন কর্ম নয়। কারণ ভারতের জনতার একটা বৃহৎ অংশ আপনাকে ভগবান বলেই জানেন। সকলের প্রতি সাম্যভাব প্রদর্শন করা আপনার উচিত বলে আমি মনে করি। আপনার কাছে শত্রু-মিত্র সকলেই সমান। সমাজ ধর্মে পাণ্ডব ও কৌরব উভয়েই আপনার পরমাত্মীয়। এক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব গ্রহণ করাটা কি আপনার উচিত বলে মনে হয়?
কৃষ্ণ বললেন, ”নারদ, তুমি নিজে না হয় পরীক্ষা করে দেখ। আমি কেন দুর্যোধন বা কৌরব পক্ষ ত্যাগ করে পাণ্ডব পক্ষে যোগদান করেছি।”
নারদ বললেন, ‘কিভাবে আমি এই পরীক্ষায় ব্রতী হব, তার উপায় যদি বলে দেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি।’
শ্রীকৃষ্ণ তখন নারদের হাতে তিনটি ফুলের মালা তুলে দিয়ে বললেন, ‘দেখ নারদ তিনটি মালার মধ্যে একটি হচ্ছে পারিজাত ফুলের মালা, বাকি দুটির একটি গোলাপ ও অন্যটি বেলফুলের মালা। এই মালা তিনটি নিয়ে তুমি উত্তম, মধ্যম ও অধম পুরুষের বিচার করবে। বিচারে যাকে উত্তম বলে মনে হবে তাকে পারিজাত ফুলের মালাটি পরিয়ে দেবে, যাকে মধ্যম বলে মনে হবে তাকে গোলাপের মালা এবং যাকে অধম বলে মনে হবে তাকে বেলফুলের মালাটি পরিয়ে দেবে। যদি তুমি বিচার দ্বারা ঐ তিন পুরুষের অন্বেষণ করতে সমর্থ না হও, তাহলে মালা তিনটি নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। প্রথমে তুমি কৌরব শিবিরে পরীক্ষার জন্য গমন কর।’
নারদ শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে মালা তিনটি নিয়ে প্রথমে কৌরব শিবিরে উপস্থিত হলেন। দূর্যোধন নারদকে দেখে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে আসন গ্রহণ করতে বললেন। নারদ আসন গ্রহণের পর দূর্যোধন নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ”দেবর্ষি, আপনার এখানে আগমনের হেতু কি জানতে পারি?” নারদ বললেন, ”আপনাদের কুশল জানতে এবং সেইসঙ্গে ভগবান আমার হাতে তিনটি মালা দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন যারা আপনাদের মধ্যে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও অধম পুরুষ হবেন তাঁদের গলায় এ মালা তিনটি পরিয়ে দিয়ে সম্মান জানাতে। এখন হে যুবরাজ আপনি বলুন আপনাদের মধ্যে উত্তম পুরুষ কে? যিনি উত্তম পুরুষ হবেন তিনি পাবেন ভগবানের দেওয়া পারিজাত কুসুমের মালা।”
দূর্যোধন বললেন, ”আমি থাকতে আবার উত্তম পুরুষ কে হবে? আমি জ্যেষ্ঠ কৌরব মহামানী রাজা দূর্যোধন, আমার চেয়ে উত্তম এই ভূমণ্ডলে আর কে হতে পারে? দিন দেবর্ষি, আমার কণ্ঠে ঐ পারিজাত মালা পরিয়ে দিন।”
নারদ জিজ্ঞাসা করলেন—”কিন্তু আপনাদের মধ্যে মধ্যম ও অধম পুরুষ কে?”
দূর্যোধন বললেন—”মধ্যম পুরুষ আমার ভাই দুঃশাসন, গোলাপ ফুলের মালাটা তাকে পরিয়ে দিন। আর অধম পুরুষ, উপস্থিত সভাসদদের মধ্যে যাকে হোক ভেবে নিয়ে বেলফুলের মালাটি তাকে পরিয়ে দিন।”
নারদ সভাসদদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের মধ্যে অধম পুরুষ কে?’ সভাসদরা ঘাড় নত করে নিরুত্তর। অর্থাৎ অধম পুরুষ কেউ হতে চায় না। নারদ তখন মালা তিনটি নিয়ে বললেন, ”আমার বিচারে উত্তম, মধ্যম ও অধম পুরুষ বলতে যা বোঝায় তা এখানে কেউ নেই। তাই আমি মালা তিনটি নিয়ে চললাম।”
অতঃপর নারদ পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করলেন। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব দেবর্ষিকে দেখে খুব আনন্দিত হলেন। নিজে আসন ত্যাগ করে উঠে এসে নারদকে সেই আসনে সসম্মানে বসিয়ে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন—”বলুন দেবর্ষি, আমি ও আমার ভাইয়েরা আপনার কোন উপকারে লাগতে পারি?”
দেবর্ষি প্রীত হয়ে বললেন, ”দেখ যুধিষ্ঠির, ভগবান আমার হাত দিয়ে তিনটি তিনরকমের ফুলের মালা রচনা করে পাঠিয়েছেন, তোমাদের মধ্যে যে উত্তম পুরুষ, সে পাবে পারিজাতের মালা, যে মধ্যম পুরুষ সে পাবে গোলাপ ফুলের মালা এবং যে অধম পুরুষ সে পাবে বেলফুলের মালা। এখন তুমি বলো ধর্মরাজ, ভগবানের দেওয়া এই তিনটি মালার তিনজন অধিকারী কে কে?’ যুধিষ্ঠির বললেন, ”দেবর্ষি, আপনি আমার সম্মুখে ঐ যে রত্নখচিত, অর্ঘ্য উপাচারে সজ্জিত শূন্য স্বর্ণসিংহাসনটি দেখতে পাচ্ছেন, ভগবানের দেওয়া পারিজাত ফুলের মালাটি আপনি ঐ সিংহাসনে রাখুন। নারদ মালাটি সিংহাসনে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই সিংহাসনটি কার?’
—পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের, তিনি ছাড়া এই বিশ্বে আর উত্তম কে আছেন? তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত না থাকলেও আমরা তার জন্য ঐ আসন তৈরি রাখি। ওই আসনে আমরা অন্য কাউকে বসতে দিই না।
নারদ যুধিষ্ঠিরের কথায় আনন্দিত হয়ে বললেন, ”কিন্তু তোমাদের মধ্যে মধ্যম পুরুষ কে?’
—কেন আপনি?
নারদ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি!’
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আপনি ভক্ত, ভক্তই ভগবানের পরম সম্পদ। ভক্তের হৃদয়েই ভগবান বাস করেন। ভক্ত যেখানে ভগবানও সেখানে। ভক্তছাড়া ভগবানের মহিমা প্রচার করবে কে? ভক্ত ভগবানের সাধনায় ওঠেন আর ভগবান, ভক্তের ডাকে করুনায় বিগলিত হয়ে নেমে আসেন। তাইতো ভক্ত মধ্য পুরুষ’।—এই বলে যুধিষ্ঠির নারদের গলায় ইচ্ছাপূর্বক গোলাপফুলের মালাটি পরিয়ে দিলেন।
নারদের শেষ জিজ্ঞাসা,—’তাহলে অধম পুরুষটি কে?’
যুধিষ্ঠিরের উত্তর,—’দ্যূত ক্রীড়ায় হৃতসর্বস্ব, মতিভ্রষ্ট এই যুধিষ্ঠিরই অধম পুরুষ, দেবর্ষি। দিন, ঐ বেলফুলের মালাটা আমার গলায় পরিয়ে দিন।’—এই বলে যুধিষ্ঠির বেলফুলের মালাটি নিজের গলায় পরে নিলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারে ও ধর্মগুণে মুগ্ধ হয়ে বললেন,—’আমি তাহলে এখন আসি ধর্মরাজ, বিদায়।’
যুধিষ্ঠিরের কাছে বিদায় নিয়ে নারদ যখন শ্রীকৃষ্ণের কাছে পৌঁছলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি নারদ পরীক্ষা করে দেখলে?”
নারদ মাথা নত করে যুক্ত করে শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘প্রভু আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি। আমি এখন আসি।’
যাওয়ার সময় নারদ মনে মনে উচ্চারণ করলেন—”নাহং জানে মহিমা তব।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন