কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের পতন বা শরশয্যা গ্রহণের পর সর্বসম্মতিক্রমে কৌরবপক্ষের মহাসেনাপতি পদে অভিষিক্ত হলেন—পাণ্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য। মহাসেনাপতি পদে অভিষিক্ত হয়েই দ্রোণাচার্য প্রথম দিন অসংখ্য পাণ্ডবপক্ষীয় সেনা সংহার করলেন। আচার্যদেবের সংহার মূর্তি দেখে অজুর্ন চিন্তিত। তিনি ঐ দিন যুদ্ধ শেষে রাত্রির প্রথম প্রহরে শিবিরে প্রবেশ করে কৃষ্ণের কাছে উপনীত হয়ে বললেন—”সখা, আচার্যদেবের রুদ্র রণোন্মাদ মূর্তি কি আজ লক্ষ্য করেছো?’ কৃষ্ণ ঘাড় নেড়ে মৃদু হাসলেন। কোন উত্তর দিলেন না। অর্জুন কৃষ্ণের মুখপানে চেয়ে পুনরায় বললেন, ‘আচার্যদেব পৃথিবীর কোন বীরযোদ্ধার চেয়ে কম নন। যুদ্ধে তাঁকে অজেয় বললেই চলে। আজ তাঁর যুদ্ধ দেখে আমার মনে হচ্ছে আগামীকাল যুদ্ধে কোনপক্ষ জয়লাভ করবে তা প্রায় অনিশ্চিত। তাই আমি জানতে চাই কালকের যুদ্ধে যদি কোন অমোঘ অস্ত্রাঘাতে আমি মারা যাই, তাহলে আমার মৃত্যুর পর তুমি কী করবে সখা?’
শ্রীকৃষ্ণ বিশ্রাম শিবিরের শয্যায় শুয়ে শুয়ে অর্জুনের কথা শুনছিলেন। কথা শেষ হতেই শয্যার উপর উঠে বসলেন এবং গম্ভীর হয়ে বললেন—’পার্থ তুমি এরকম কেন ভাবছো? আমি তোমার সঙ্গে যতক্ষণ রয়েছি ততক্ষণ ধরায় কে এমন বীর আছে যে অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করে তোমার জীবন নাশ করে দেবে? পৃথিবীতে এমন বীর এখনও জন্মায়নি—সৃষ্টিতে এমন কোন অস্ত্র নেই যা কৃষ্ণের সংকল্প বা ইচ্ছাকে ব্যর্থ করতে সমর্থ। স্বয়ং ভগবান শংকর যদি পিনাকপানি হয়ে কৌরব পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করতে আসে—সেও সমর্থ হবে না আমার প্রাণসখার প্রাণ নিতে—তাঁকে ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করতে হবে। পৃথিবী থাকুক অথবা টুকরো টুকরো হয়ে যাক, সারা সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাক, তবু পার্থ আমি সঙ্গে থাকতে কেউ তোমায় মারতে সমর্থ হবে না।’
কৃষ্ণের অভয়বাণীতে অর্জুনের মুখে হাসি ফোটে। সে স্মিত আননে কৃষ্ণকে বলে—’আমি জানি সখা, তুমি থাকতে কেউ আমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু সৃষ্টিতে কখনও যা হবার নয় তা যদি হয়। তোমার ইচ্ছাকে ব্যর্থ করে যদি সত্য সত্যই আমার মৃত্যু হয় তাহলে আমার মরণের পশ্চাতে তুমি কি করবে?’ অর্জুনের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণের কন্ঠস্বর ক্রোধে কম্পিত হয়ে ওঠে—’শোন সখা পার্থ, যদি কখনও এ অসম্ভব সম্ভব হয় তাহলে জেনে রাখ সৃষ্টির সব নিয়ম মর্যাদা উল্টে যাবে। আমি থাকতে তোমার মৃত্যু হলে চক্র তুলে নেব হাতে। পলকের মধ্যে কৌরবপক্ষের সকল যোদ্ধা বীর ও সমর্থনকারীদের ধ্বংস করে দেব। ওদের সবাইকে সমূলে বিনাশ করে যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে কপালে রাজটীকা পরিয়ে দেব। তারপর তোমার মৃত শরীর চিতায় তুলে দিয়ে নিজেও সেই চিতায় আরোহণ করবো। পার্থ, কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা সে তোমাকে ছেড়ে পৃথিবীতে এক দণ্ডও রইবে না। তুমি দেখে নিও পার্থ, কৃষ্ণ তোমার মৃত্যুর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।” শ্রীকৃষ্ণের কথা শেষ হতেই, অর্জুন তাঁর পা দু’খানি (কৃষ্ণের) নিজের কোলে তুলে নিয়ে নয়নের অশ্রুধারায় ধুইয়ে দিলেন।
সুহৃদ পরমোদার ভক্তবৎসল শ্রীকৃষ্ণ স্বীয় উত্তরীয় দিয়ে অর্জুনের চোখের জল মুছতে লাগলেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের পাদুখানি কোল থেকে নামিয়ে শয্যার উপর স্থাপন করলেন। অতঃপর নিজের মস্তক সেই চরণযুগলের মাঝে অঞ্জলি দিয়ে বললেন—’হে সখা, বেদমাতা যথার্থই বলেছেন—
”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষ স্বজাতে।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন