দ্বারকার নিভৃত প্রাসাদকক্ষে পালঙ্কোপরি শয়নে আসীন শ্রীকৃষ্ণ। পদপ্রান্তে বসে পদসেবা করছেন মহারানী রুক্মিণী। সেবা করতে করতে তিনি সলজ্জভাবে কৃষ্ণকে বললেন—’আপনি শ্রীচরণে স্থান দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করেছেন কিন্তু….!’
কোন কিন্তু না রেখে তুমি যা বলতে চাও নিঃসঙ্কোচে বল। তোমার ইচ্ছা আমি অবশ্যই পূর্ণ করবো।’ শ্রীকৃষ্ণ আস্বাস দিয়ে বলেন রুক্মিণীকে।
—আপনি দেব-দেবেশ্বর। মহান পুরুষোত্তম। আমি চাই আপনার অনুরূপ গুণবান, বীর্যমান, সুন্দর, শাস্ত্রজ্ঞ, সন্তান আমার কোল আলো করুক।’
— দেবী, আমি বুঝেছি, তুমি কি চাও! কিন্তু ঐরূপ পুত্রের জন্যে প্রত্যেক দম্পতির দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যা করা উচিত। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করতে আমি কৈলাশ যাব। সেখানে গিয়ে তপস্যা দ্বারা আশুতোষকে সন্তুষ্ট করে পুত্রের জন্য বর চাইব।”
—তুমি পুরুষোত্তম ভগবান সর্বেশ্বর, পুত্রের জন্য তোমাকে আশুতোষের তপস্যা করতে হবে কেন?
—নরলীলার উদ্দেশ্য জীবকে শিক্ষাদান করে কল্যান পথ নির্দেশ করা। ভগবান নররূপে অবতীর্ণ হলে তাঁকে নরের মর্যাদা পালন করতে হয়। তাছাড়া ভগবান আশুতোষ আমারই আত্মা দ্বিতীয় বিগ্রহ স্বরূপ। জীব কল্যানে তিনি সদা তপোমগ্ন—তাই তাঁর আরাধনা জীব মাত্রেরই কাম্য।’
পরদিন প্রাতে কৃষ্ণ যাদবদের অন্তরঙ্গ রাজসভায় আহ্বান করে বললেন,—”আমি সন্তান প্রাপ্তির জন্য তপস্যার উদ্দেশ্যে কৈলাশ যেতে চাই। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত দ্বারকানগরীর একটিমাত্র দ্বার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। অন্যান্য দ্বারসমূহ বন্ধ থাকবে। এইসময় নগরের বাইরে শিকারভ্রমণ নিষিদ্ধ। যাঁরা আমার সাক্ষাৎ চাইবে তাঁদের বলবেন, আমি বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছি। এখন সাক্ষাৎ হবে না। শত্রুপক্ষের লোকেরা বা বিরোধী নৃপতিরা যেন কোনভাবেই বুঝতে সমর্থ না হয় যে আমি দ্বারকার বাইরে অবস্থান করছি।’ বলরাম ও উদ্ধবের উপর বিশেষ ভার অর্পন করে সাত্যকিকে বললেন,—আমার অনুপস্থিতিতে তুমি নগররক্ষার কাজে বিশেষ ধ্যান দিও।”
এইভাবে যোগ্যব্যক্তির উপর উত্তর দায়িত্ব অর্পণ করে ওইদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি বিনতানন্দন গরুড়কে স্মরণ করলেন। গরুড় উপনীত হতেই তিনি তাঁর পৃষ্ঠদেশে আরোহন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই হিমালয়ের বদ্রীনাথে অবতরণ করলেন। বদ্রীক্ষেত্র নরানারায়নের নিত্য তপোভূমি। উচ্চস্তরের ঋষি, মুনি, তপস্বী, ও সাধকদ্বারা বদ্রীধাম সবসময়ই পূর্ণ থাকে। শ্রীকৃষ্ণকে আন্তরিক স্বাগত অভ্যর্থনা জানালেন সেখানকার ঋষি-মুনি-তপস্বীরা। তাঁদের সমবেত সাদর অভ্যর্থনা গ্রহন করে স্নান সমাপন করলেন শ্রীকৃষ্ণ। তারপর পূণ্যসলিলা অলকানন্দের উত্তর তটস্থিত নারায়ণ আশ্রমে উপস্থিত হয়ে তিনি তপস্যায় বসলেন।
তিনি তপস্যায় মগ্ন হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সহসা সেখানে মহাকোলাহল ধ্বনি ভেসে আসে। যেমন—”বন্য শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া কর—শিকার যেন ফস্কে না পালায়—বন্য পশুদের পিছু চিৎকার করতে করতে এগিয়ে চল—পশুদের মার।” কোলাহলের মধ্যে এইসব চিৎকারধ্বনি কৃষ্ণের কানে ভেসে আসে-তাঁর তপস্যা ভঙ্গ হয়। কোলাহলের মধ্যে তিনি এও শুনলেন—’ভগবান বাসুদেবের জয় হোক! দেবের দেবভক্তবৎসল ভগবান পুরুষোত্তমের জয়! করুণাবরুণালয় জনার্দন ধন্য! তুমি ধন্য!”
কোলাহলের মধ্যে ভেসে আসা ওইসব চীৎকার ধ্বনি শুনে কৃষ্ণ আশ্চর্য্য হলেন। তিনি ভাবলেন এই পবিত্র তীর্থভূমিতে একদিকে যেমন পশু শিকারের ন্যায় ক্রূর কর্ম সম্পাদন করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে তাঁর জয়ঘোষও উচ্চারিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রাণভয়ে ভীত বন্য পশুর দল (বাঘ, সিংহ, হরিণ, খরগোশ) শিকারীদের তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে কৃষ্ণের কাছে এসে উপস্থিত হল। করুণ নয়নে পশুর দল কৃষ্ণের কাছে নির্ভয় শরণ চায়। পশুদের পিছু পিছু আসে শিকারী কুকুরের দল। অসংখ্য জলন্ত মশাল হাতে নিয়ে কুকুরের পিছু পিছু ভয়ংকর-দর্শনধারী, পিশাচ-পিশাচিনী ভূত প্রেতের দল। এদের মধ্যে কেউ কেউ সদ্যমৃত পশুদের কাঁচা মাংস চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। ভীত বন্যপশুরা কৃষ্ণকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভূত পিশাচ-পিশাচিনীর দল সংকুচিত হয়ে ইতস্ততভাবে কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান। শ্রীকৃষ্ণ ভাবছেন,—”এখানে তপোধন মুনিঋষিরা রয়েছেন। স্বয়ং আমিও উপস্থিত রয়েছি—এখানে ভূত, প্রেত, পিশাচিনীর দল তৎসত্বেও আসতে সমর্থ হল কি করে? এরা কারা? কিছুক্ষণ পর আরও দুজন ভয়ংকর বিকট দর্শনধারী পিশাচ সেখানে উপস্থিত হল। বিশাল লম্বা দেহ তাদের। শরীরময় পিঙ্গল-বর্ণ রোমরাজি। সারাশরীরে মৃত পশু ও নর-নারীর নাড়ীভূড়ি জড়ানো। হাতে ত্রিশূল, ত্রিশূলের অগ্রভাগে বিদ্ধ নরমুণ্ড। তাদের হা-হা-হি-হি অট্টহাসি ধ্বনিতে তপোভূমি বদ্রীধামে যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠল। হাসতে হাসতে তারা দুজন মৃত শবদেহের মাংস ভক্ষণ ও রক্তপান করছে। রাশি রাশি পশুও মানবের শবদেহ স্নায়ুতন্ত্রে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্য, মাংসভক্ষণ ও রক্তপান শেষ হলে দুই পিশাচ উদ্দাম নৃত্যসহ সংকীর্তন শুরু করে দেয়—’
জয় নারায়ণ, ‘জয় কৃষ্ণ গোবিন্দ।
জয় ভগবান, বাসুদেব পরমানন্দ।।
কীর্তন করতে করতে দুই পিশাচ কখনও কখনও কেঁদে ওঠে এবং বলে, ‘আমরা দুরাচারী অধম পাপী সবসময়ই দুষ্কর্ম করি, হে ভগবান বাসুদেব তুমি কবে আমাদের দর্শন দিয়ে উদ্ধার করবে?’ কীর্তন করতে করতে তারা কৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হয় এবং জিজ্ঞাসা করে—”আপনি কে? কার পুত্র? কোথা থেকে আসছেন? পর্বতের উপরে ঘোর অরণ্যে আপনি কেন এসেছেন?”
শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ পরিচয় প্রদান না করে শুধু বললেন—”যদুকুলে আমার জন্ম। আমি এখান থেকে কৈলাশ যাব। বদ্রীধাম পুণ্যতীর্থক্ষেত্র-কৈলাশ যাওয়ার পথে তাই এই স্থান দর্শন করে, এখানে কিছুদিন তপস্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধ ঋষি-মুনি তপস্বীরা এখানে থাকেন। দুষ্ট-অসৎরা এখানে অবস্থান করতে পারে না। আজকের মতো কুকুরের দল নিয়ে তোমাদের মতো মাংসভক্ষণকারীরা কোনদিন এই পবিত্র স্থানে আগমন করেনি। পুণ্যভূমি বদ্রীধামে পশুবধ করা উচিত কর্ম নয়। আমি এই পুণ্যতীর্থের সংরক্ষক। তোমরা দুজন কে? কোথায় থাক, এই বিশাল ভূত পিশাচ সৈন্য কার? তোমরা আর একপাও অগ্রসর না হয়ে এখান থেকে ফিরে যাও। তোমাদের উন্মত্ত কোলাহলে ঋষিমুনিদের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটবে। সুতরাং তোমরা এই স্থান অবিলম্বে ত্যাগ কর।”
ভয়ংকর দর্শনাকার বিশিষ্ট দুই পিশাচের মধ্যে একজন কৃষ্ণের কথা শোনার পর বলল,—’আপনি হয়তো আমাদের নাম শুনে থাকবেন। আমি ঘণ্টাকর্ণ নামক প্রসিদ্ধ পিশাচ। মহেশ্বরের অনুচর। ধনাধিপতি কুবেরের সখা। আর একজন যাকে আমারই মতো দেখছেন—ও হল কালের ও কাল আমার ছোটভাই। কোনও স্থান আমাদের অগম্য নয়। ভূত পিশাচ সেনার দল আমারই, কুকুরও আমার। ভগবান বাসুদেব নারায়ণের জন্য আমি শিকার সংগ্রহে বের হয়েছি।’ কৃষ্ণ সকাশে পিশাচ আপনার পরিচয় প্রদান করল। ”ভগবান বাসুদেব নারায়ণের অর্চনা তোমরা কেন করতে চাও? তোমার উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্ট করে ব্যক্ত কর আমার কাছে, ”কৃষ্ণ অগ্রজ পিশাচকে জিজ্ঞাসা করলেন। পিশাচ উত্তরে বলল, ”আপনার গন্তব্যস্থল যে কৈলাশভূমি, আমি দলবল নিয়ে সেখান থেকেই এসেছি। একসময় আমি বিষ্ণু নারায়ণের ভীষণ নিন্দুক ছিলাম। দুই কানের উপরে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতাম-যাতে বিষ্ণুনাম আমার কানে প্রবেশ না করে। আমি নৈষ্ঠিক শিবভক্ত ছিলাম। কৈলাশে আমি ভগবান আশুতোষের আরাধনা করতাম। মঙ্গলময় আশুতোষ আমার তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে বর দিতে চাইলেন। আমি বললাম,—’হে ভূতনাথ, তুমি আমায় মুক্তি দাও। আশুতোষ আমার বর প্রার্থনা শুনে সন্তুষ্টচিত্তে বললেন—”মুক্তি তোমায় দিতে পারতাম কিন্তু তোমার হৃদয়ে আমার আরাধ্য ইষ্টদেব শ্রীবিষ্ণু নারায়ণের প্রতিদ্বেষ জমে আছে। অতএব তুমি নর-নারায়নের ক্ষেত্র বদ্রীধামে যাও এবং ঐখানেই জনার্দন বাসুদেবের তপস্যা করে তাঁর কাছ থেকে ‘মুক্তির’ বরপ্রাপ্ত হও। দেবাদিদেব মহাদেবের আদেশে আমি এখানে এসেছি। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন—পশ্চিম সমুদ্রের তটস্থিত সুপ্রসিদ্ধ দ্বারকা নগরীতে এই সময় শ্রী বিষ্ণু নারায়ন কৃষ্ণনামে গার্হস্থ্য লীলারস আস্বাদনকরত অবস্থান করছেন। আমি আমার অনুচরদের নিয়ে তাঁকে দর্শন করতে দ্বারকায় যাচ্ছি। আপনিও ইচ্ছা হলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন। কারন বিষ্ণু নারায়ণ যদুবংশে অবতীর্ণ হয়েছেন। আপনার পরিচয় পেয়ে জানলাম আপনিও যদুবংশী এতদকারণে আপনিও আমাদের পরম সম্মানীয়। অর্ধেক রাত্রি অতিক্রান্ত প্রায়। এইসময় আমরা (ভূত-পিশাচরা) আরাধনা করি। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে দ্বারকায় যেতে সম্মত না হন তাহলে যেখানে আপনার অভিরুচি, আপনি সেইস্থানের উদ্দেশ্য গমন করুন। আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের কোন ভয়ের কারণ নেই।
শিবসেবকের পক্ষে কোন তপোবন বা পুণ্যভূমি অগম্য নয়। মানুষ, পশু সবার ক্ষেত্রে ওরা ভয়ংকর ত্রাসসঞ্চারকারী। কিন্তু ওদের বিষ্ণু ভক্তি নিষ্ঠা? ভক্তি তো কখনও কুল, আচার-বিচার-আহার কর্ম দেখে না। যে কোন হৃদয়ে ভক্তি যখন-তখন প্রকট হতে পারে। ভক্তি যদি একবার হৃদয়ে প্রকট হয় তাহলে কি কৃষ্ণ দূরে থাকতে পারে? যে হৃদয়ে ভক্তি প্রকট হয় সেখানে না এসে কি তিনি থাকতে পারেন! পিশাচকে কৃপা করবেন বলেই তিনি কি পুত্রের জন্য শিবের তপস্যা করা উচিত এই অজুহাতে বদ্রীধামে উপনীত হয়েছেন? সেই ভগবানই বা কেমন যে পিশাচের প্রতি প্রসন্ন হয় না? তাকে আপনার করে নিজের কাছে টেনে নেয় না? পিশাচ কি ভগবানের সৃষ্টির বাইরে?
‘স্বধর্মম্ আরাধনম্ অচ্যুতস্য’—পিশাচের ধর্মে স্থিত হয়েই ঘণ্টাকর্ণ স্বধর্ম পালন করছে। উপরের কথাগুলি কৃষ্ণের করুণারসপূর্ণ হৃদয়ে জলবিন্দুর মত ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়। তিনি কোথাও না গিয়ে এইখানেই শান্ত হয়ে বসে রইলেন। পিশাচ আপন ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী আরাধনায় মগ্ন হল। খালি পেটে আরাধনা করা পিশাচের পক্ষে সম্ভব নয়। আকণ্ঠ রক্তপান ও মাংস ভোজন করে নাড়ীভূঁড়ি পাশে রেখে সে পশু চর্মের আসন বিছিয়ে উপবেশন করে, আচমন করে। কুকুরের দলকে দূরে সরিয়ে দেয় তারপর আসলে উপবিষ্ট হয়ে যুগলনেত্র বন্ধ করে স্তুতি করে—”হে আরাধ্য ভগবান বাসুদেব, আমার মন প্রতিক্ষণ তোমার শ্রীপাদপদ্মের অনুধ্যান করে। আমার মনের সমস্ত পাপ তাপ-মালিন্য তুমি নষ্ট করে দাও। তোমার চরণে আমার ভক্তি অচল হোক। অধম পিশাচ ঘণ্টাকর্ণকে তুমি কৃপা করো-দয়াময়। কৃপা কর”….স্তুতি করতে করতে ঘন্টাকর্ণের কণ্ঠ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। নেত্র দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরতে থাকে। শরীর রোমাঞ্চিত হয়। ভগবান বাসুদেবের ধ্যান স্তুতি করতে করতে সে সমাধিস্থ হয়ে পড়ে। নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি স্থির। শ্বাসে শ্বাসে প্রণবসহ বাসুদেব মন্ত্রের মানসিক জপ চলতে চলতে প্রাণ স্থির হয়ে যায়। ভগবান পিশাচের হৃদয়ে আজ চতুর্ভুজ মূর্তিতে প্রকট হন।
পিশাচ ঘণ্টাকর্ণের সমাধিভঙ্গ হয়। নয়ন মেলে দেখে শ্রীকৃষ্ণ সম্মুখে দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণকে সম্মুখে দেখে আনন্দে নৃত্য করতে করতে সে বলে, ”এই তো আমার সন্মুখে ইষ্টদেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাকে কৃপার অমৃতধারায় স্নান করানোর জন্য। হে ভক্তবৎসল, করুণার অনন্ত পারাবার-আপনিই আমার হৃদয়ে চতুর্ভুজ মূর্তিতে প্রকট হয়েছিলেন, আমি আপনাকে চিনেছি প্রভু। আপনি এই অধমাধম ঘণ্টাকর্ণকে করুণা করবে বলেই এখানে এসেছেন।’
আনন্দে উল্লসিত হয়ে নৃত্যের তালে তালে সংকীর্তন করতে করতে পিশাচ ঘণ্টকর্ণ কৃষ্ণচরণে লুটিয়ে পড়ল। কৃষ্ণ পিশাচকে চরণ থেকে তুলে বুকে চেপে ধরেন এবং মধুরাতিমধুর আলিঙ্গন দ্বারা তাঁকে কৃতকৃতার্থ করেন। পিশাচআলিঙ্গনমুক্ত হয়ে আনীত শবদেহের মধ্য হতে একখানি বিশেষ শবদেহ কর্তন করে তা থেকে কিছুটা মাংসখণ্ড একটি ধৌত তরুপত্রে স্থাপন করে কৃষ্ণের সম্মুখস্থিত ভূমিতে নিবেদন করে বলল, ”হে আমার প্রাণপ্রিয় প্রভু, পবিত্র সংস্কার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ শবদেহের মাংস সংগ্রহ করা পিশাচদের পক্ষে বড়ই দুর্লভ। এরূপ মাংস পিশাচদের উত্তম আহার রূপে গণ্য হয়। আমি সেই পবিত্র মাংস আপনার সম্মুখে নিবেদন করেছি, দয়া করে গ্রহণ করুন।
”যদন্মং পুরুষোভবতি তদন্নং তস্য দেবতা।” যে অন্ন সাধকের নিজের প্রিয়, সেই অন্নই সে আপন ইষ্টদেবকে নিবেদন করে। আমি অধম পিশাচ। ভক্তি-আচার বিচারের শুদ্ধতা আমার জানা নেই। উন্নত-পবিত্র-সাধন মার্গের পথিকও নই। হে প্রভু, দয়া করে নিজগুনে আমার সকল অপরাধ মার্জনা করে নৈবেদ্য গ্রহণ করুন।”
কৃষ্ণ বললেন,—’ঘণ্টাকর্ণ, যে ভোগ তুমি আমার উদ্দেশ্য নিবেদন করেছ—তা আমার স্পর্শ করার যোগ্য নয়। তুমি ওই ব্রাহ্মণের শবদেহ আমার কাছে নিয়ে এস। আমি তাঁকে পুর্নজীবন দান করব’।
ঘণ্টাকর্ণ ব্রাহ্মণের শবদেহ কাছে আনতেই কৃষ্ণ অমৃতদৃষ্টিদানে সেই প্রাণহীন দেহে প্রাণসঞ্চার করলেন। ব্রাহ্মণ সুস্থ শরীরে নবজীবন লাভ করলেন। ব্রাহ্মণকে প্রণাম জানিয়ে কৃষ্ণ বললেন,—’হে বিপ্রশ্রেষ্ঠ, আপনার মঙ্গল হোক। তপোনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের উচিত নয় তপস্যা থেকে বিরত হয়ে তমোগুণের আশ্রয় করা। ব্রাহ্মণ কৃষ্ণের কথাশুনে নত শিরে লজ্জাবশত হয়ে ভূমিপরে বিরাজিত কৃষ্ণচরণকমলে মনে মনে প্রণাম জানান। কৃষ্ণকৃপায় তাঁর পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে। মনে পড়ে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আসনে উপবেশন করে গায়ত্রীমন্ত্র জপ করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে যান। সেই কারণে পিশাচের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ব্রাহ্মণ কৃতজ্ঞ চিত্তে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে আর একবার মনে মনে প্রণাম জানিয়ে সেইস্থান ত্যাগ করে চলে যায় আপন গন্তব্যস্থলে।
ব্রাহ্মণ চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণ ঘণ্টাকর্ণের শরীরে আপন অভয়বরদ হস্ত কমল স্থাপন করে বললেন,—’আমি তোমার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়েছি।’ কৃষ্ণের করকমলের স্পর্শ পেতেই ঘণ্টাকর্ণের শরীর পরিবর্তন হয়ে যায়। সুন্দর সুকুমার কুঞ্চিত কেশদাম কমল নয়নযুক্ত যেন আর এক কৃষ্ণ সেখানে পিশাচের পরিবর্তে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর রূপ কৃষ্ণ রূপেরই প্রতিরূপ। পিশাচ পরমগতি প্রাপ্ত হয়ে সিদ্ধ দেহ লাভ করল। কৃষ্ণ সদ্য সিদ্ধ দেহলাভকারীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি এখন স্বর্গধামে গিয়ে অবস্থান কর। তোমার ভাই ও অন্যান্য অনুচর সবাই স্বর্গধামে তোমার সঙ্গেই থাকবে। বর্তমান ইন্দ্রের কার্যকাল শেষ হওয়ার পর তুমি ও তোমার ভাইসহ সমস্ত অনুচরের দল আমার নিত্যধাম প্রাপ্ত হবে। এছাড়া তোমার যদি আর কোন প্রার্থনা থাকে, তবে নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ কর, আমি তা পূরণ করব।’ সদ্য সদ্য সিদ্ধদেহধারী ঘণ্টাকর্ণ অশ্রুপূর্ণ নয়নে বললেন,—’হে পরমপুরুষ, আপনার চরণে যেন আমার অচল ভক্তি থাকে। এই অধম পিশাচকে আপনি যে অনুগ্রহ করলেন তা আপনার পক্ষেই সম্ভব। হে সর্বাভীষ্ট পূর্ণকারী পতিতপাবন আমায় এই বর দিন—যাঁরা আমার প্রতি আপনার এই অনুগ্রহ প্রদর্শনের প্রসঙ্গকে শ্রবণ-স্মরণ-চিন্তন করবে তাদের অন্তরের সমস্ত পাপ যেন নষ্ট হয়ে যায়। অন্তিমে তাঁরাও সকলে যেন আপনার চরণে ভক্তি লাভ করে ধন্য হয়।’
মেঘগম্ভীর স্বরে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ বললেন—”এবমস্তু’! ‘তাই হবে। কল্যাণীয়, এখন তোমরা দুইভাই অনুচরসহ স্বর্গে গমন কর। ওই দেখ দূরে পুষ্পবিমান নিয়ে দেবেন্দ্র তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে? দুইভাই অনুচরসহ কৃষ্ণচরণে সভক্তি প্রণাম জানিয়ে পুষ্পবিমানে আরোহন করল।
ঘণ্টাকর্ণকে অনুগ্রহ করে কৃষ্ণচন্দ্র রাত্রিশেষে ব্রাহ্মমুহূর্তের মধ্যে নারায়ণ আশ্রমে ফিরে এলেন। প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে স্থানীয় মুনিঋষিদের শ্রীপাদ বন্দনা করে গরুড় আসনে আরোহণ করলেন। অন্তরীক্ষ পথে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি কৈলাশের নিকটবর্তী মানসসরোবরের উত্তরতটে অবতরণ করলেন। অতঃপর শুরু করলেন তপস্যা।
প্রতিদিন মানস সরোবরে স্নান, জটা ও চীরবস্ত্র (অর্থাৎ কৌপীনমাত্র) ধারণ এবং শাকাহার গ্রহণ করে ফাল্গুনমাসের শুক্লপক্ষ থেকে তিনি তপস্যা আরম্ভ করেন। গরুড় সাথেই থাকেন। শ্রীকৃষ্ণের সব অস্ত্রশস্ত্রও সেখানে মূর্তিমান হয়ে তাঁর সেবায় তৎপর হয়। গরুড় হোমের জন্য শুকনো কাঠ সংগ্রহ করার জন্য সচেষ্ট হন। কিন্তু হিমালয়ের ঐ অংশ বারমাস বরফাচ্ছাদিত থাকার ফলে বৃক্ষ জন্মায় না—এখানে ওখানে দু’চারটে কণ্টকময় গুল্মলতা দৃশ্য হয় এবং কাঁচা অবস্থাতেই অগ্নিসংযোগে জ্বলতে থাকে। তাতে সমিধের কাজ (হোমের কাঠের) সম্পন্ন হবে না। তাই মনোবেগ সম্পন্ন বিনতানন্দন হিমালয়ের ওই স্থান থেকে দূরে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হোমের জন্য কাঠ সংগ্রহ করে আনেন। সুদর্শন চক্র আরাধনার জন্য প্রতিদিন পুষ্পচয়ন করে প্রভু কৃষ্ণের সেবা করে, কিন্তু ঐস্থানে সুগন্ধি পুষ্প না থাকায় তাঁকেও দূর থেকে গরুড়ের মতো পুষ্প সংগ্রহ করে আনতে হয়। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খ তপস্যায় পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করে, শঙ্খ পাঞ্চজন্য রক্ষা কার্যে নিযুক্ত থাকলেও সে কিন্তু কাউকে আঘাত করে না। কৈলাস ভূমি শিবক্ষেত্র। কাজেই শিবের অনুচর ভূত-প্রেতের দল সেখানে বিচরণ করবেই। কিন্তু শঙ্খধ্বনি তাদের সহ্য হয় না। পাঞ্জজন্য তাই ধ্বনি দ্বারা কৃষ্ণের সেবা করে। ধ্বনি শুনে ভূত প্রেতরাও সেখানে যেতে সাহসী হয় না।
কৈলাশে কুশ দুর্লভ। সমগ্র হিমালয়ে কোথাও কুশ দেখা যায় না। তাই কৃষ্ণের খড়গ নন্দক প্রতিদিন নবীন দূরের সমতল ভূমি হতে কুশ সংগ্রহ করে আনে। কুশ ছাড়া যে আর্য ভারতের উপাসনা কিছুতেই সম্ভব নয়—এটা সে ভাল করে জানে। শ্রীকৃষ্ণ আহারের জন্য নিকট হতে সামান্য কিছু শাকসংগ্রহ করে নেন। ত্রিসন্ধ্যা মানস সরোবরে স্নান করেন। জপ-তপ-রুদ্রাষ্টাদশ অধ্যায় পাঠ করেন। প্রজ্বলিত অগ্নিতে ঘৃতসিক্ত কাষ্ঠ আহুতি দেন। সর্বলোকশ্বরেশ্বর নিখিল ব্রহ্মাণ্ড নায়ক কৃষ্ণের তপস্যার কি প্রয়োজন? বিশ্বের সন্মুখে আদর্শ স্থাপনের জন্য তাঁর এই লীলা নাটক রচনা।
কামসুখের দ্বারা প্রাপ্ত সন্তান কখনও সদগুণের অধিকারী হয় না। কুলের মান মর্যাদা যশ গৌরব বৃদ্ধি করবে যে সন্তান তাঁর জন্য বিশ্বের প্রতিটি দম্পতির তপস্যা করা প্রয়োজন। সন্তান-সন্ততি যদি কামবাসনা চরিতার্থতার পরিণতি হয় তবে সেই সন্তান-সন্ততি কখনও উচ্চস্তরের হয় না এবং মহান হৃদয়ের অধিকারী হয় না। সন্তান-সন্ততি সৃষ্টির মূলে যদি সংযম তপস্যা থাকে তবে জগৎ সংসারে জীবের কল্যাণ হয়। উত্তম সন্তানের জন্য ভগবান শিবের আরাধনা করা কৃষ্ণের কি প্রয়োজন? শঙ্কর কি কৃষ্ণ থেকে আলাদা? গীতার দশম অধ্যায়ে ‘বিভূতি যোগে’ তিনি নিজমুখে অর্জুনকে বলেছেন—”রুদ্রানাং শঙ্করশ্চাসিম”—অর্থাৎ একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমি শঙ্কর। তিনি ইচ্ছা করলে শিব স্বয়ং দ্বারকায় গিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হতে পারতেন। দ্বারকায় গার্হস্থ্য লীলারসে মর্যাদা তা তিনি লঙ্ঘন করতে চান না, তাই এসেছেন লোক শিক্ষার্থে কৈলাশে তপস্যা করতে।
লীলাময় কৃষ্ণের যতক্ষণ তপস্যা করার অভিরুচি ছিল ততক্ষণ তপস্যা করতে থাকেন। তপস্যার অন্তে হোমাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দিতেই ভগবান আশুতোষ উৎসুক হয়ে উঠলেন কৃষ্ণদরশনের জন্য। পূর্ণাহুতি অনুষ্ঠান সমাপ্তির পূর্বেই তিনি (মহাদেব) বৃষবাহনে আরূঢ় হয়ে কৃষ্ণের সন্মুখে আবির্ভূত হলেন। মহেশ্বরের পিছু পিছু ভূতাদিগণও সেখানে উপনীত হলেন। আপন পার্যদদের সঙ্গে সমবেত স্বরে তিনি জয়ঘোষ করে বললেন—”হে জনার্দন, আপনার জয় হোক।” শ্রীকৃষ্ণ শিবকে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম জানালেন। শিব বৃষবাহন থেকে অবতরণ করে কৃষ্ণকে বক্ষসংলগ্ন করলেন। দুজনা দুজনার দিকে চেয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন। উভয়ের দিব্যশরীরের রোমে রোমে অপূর্ব আনন্দের অভিব্যক্তি। শিবের অনুচররা উভয়ের অদ্ভুত মিলন দৃশ্য সানন্দে উপভোগ করেন। ইতিমধ্যে অন্তরীক্ষপথে দেবগণও সেখানে উপস্থিত হয়ে এই অনুপম দৃশ্য দর্শন করতে থাকেন। শিব-কৃষ্ণ দুজনেই পৃথক পৃথকভাবে দু’জনের উদ্দেশ্যে স্তব স্তুতি করেন। অবশেষে ভূতনাথ শঙ্কর অভিযোগের স্বরে বললেন—’হে পুরুষোত্তম, আপনি তপস্যারত হয়েছেন কেন?’
কৃষ্ণ বললেন, ‘দেবী রুক্মিণী আপনার অনুগ্রহে পুত্রবতী হতে চান।’
শিব বললেন,—’কামদেবকে আমি একদা ভস্ম করে অনঙ্গ করে দিয়েছিলাম। তৎপত্নী রতি ক্রন্দনরতা অবস্থায় আমার কাছে স্বামীর পুনর্জীবন প্রার্থনা করলে আমি বরদান করেছিলাম, তাঁর পতি কামদেব বৈবস্বত মন্বন্তরে আঠাশতম দ্বাপরের অন্তে বাসুদেবের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবে। আপনি আমার বরদানের বাণীকে সত্য করার জন্য তপস্যাকে নিমিত্ত করে আমায় কৃপা করার জন্য এখানে পদার্পণ করেছেন। কামদেব আপনার জ্যেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠ পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবে।” শ্রীকৃষ্ণ মহেশ্বরকে আর একবার প্রণিপাত করলেন। কৃষ্ণকে হদয়ে সংলগ্ন করে মহেশ্বর বললেন—”এখন আপনি দ্বারকায় ফিরে যান। আপনার দিব্যাঙ্গে পীতাম্বরই শোভা পায়। চীরবস্ত্র বা কৌপীনখানি অঙ্গ থেকে খুলে আপনার প্রিয় ভোলানাথের জন্য রেখে যান।”
শ্রীকৃষ্ণ মৃদ্যুহাস্যে শিবের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করে গরুড়াসনে সমাসীন হয়ে দ্বারকায় ফিরে গেলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন