জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…

জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…

ব্রজমণ্ডলে ব্রহ্মগিরি পর্বতের উপর একটি সুরম্য মন্দির আছে। মন্দিরটির নাম মান মন্দির। এখানেই শ্রীমতি রাধারাণী লীলা মাধুর্য বৃদ্ধির জন্য শ্যামসুন্দরের উপর মান করেছিলেন। এ কারণে এই মন্দিরের নাম মানমন্দির। ব্রজবাসীগণ এতৎ কারণে ব্রহ্মগিরি পর্বতকে মান পর্বতও বলে থাকেন। পর্বতের উপরে অসংখ্য তরুলতা ফল ফুলে শোভিত হয়ে সদা বিদ্যমান। পর্বতের অনতিদূরে অবস্থিত বর্ষাণা গ্রাম। রাধারাণী মাঝে মাঝে সখীদের সঙ্গে মানপর্বতের কাননে ভ্রমণ করতে আসতেন।

একদিন রাধারাণী এই পর্বতকাননে একটি সুন্দর মনোহর কুঞ্জ নির্মাণ করেন। কুঞ্জের নিকটে শীতল সলিলে পূর্ণ একখানি কুণ্ড আছে। কুঞ্জ নির্মাণ অন্তে তিনি সেখানে শ্যামসুন্দরের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন দেখলেন—শ্যামসুন্দর এলেন না তখন তিনি বিরহ তপ্ত অন্তরে শ্যামসুন্দরের উপর অভিমান করে কুণ্ডের সলিলে আকন্ঠ নিমজ্জিতা হয়ে বসে রইলেন। সখীরা শ্রীরাধার অবস্থা দেখে থাকতে পারলেন না। তাঁরা শ্যামসুন্দরকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। শ্যামকে দেখে শ্রীমতি রাধারাণীর মান আরও বৃদ্ধি পেল। তিনি তাঁর সঙ্গে একটি কথাও বললেন না। সখীদের পরামর্শে শ্যামকুণ্ড তীরে দাঁড়িয়ে অনেক কাকুতি-মিনতি করলেন। কিন্তু শ্রীমতী রাই তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলেন না। রাইকিশোরীকে মানগর্বে গর্বিতা দেখে শ্যামসুন্দর কুঞ্জ থেকে প্রস্থানোদ্যত হতেই ললিতাসখী তাঁর হস্তযুগল ধরে বললেন, ‘দাঁড়াও হে শ্যাম নটবর’। মানিনীর প্রেম অত সুলভ নয়, যাও ঐ কুঞ্জের নিকট বেদীতে উপবেশন কর। আমি দেখি কী করা যায়। শ্যামসুন্দর ললিতাসখীর পরামর্শে বেদীতে উপবেশন করলেন, শ্রীমতী রাধারাণীর করুণার প্রতীক্ষায়।

ললিতাসখী কুণ্ড তীরে উপনীতা হয়ে রাইকে বলেন—”মানিনী মান পরিহার কর। কুণ্ড হতে উত্থিতা হয়ে কুণ্ড কুটীর অভ্যন্তরে সিক্তবসন পরিবর্তন করে— বেদীতে শ্যামসুন্দরের পাশে উপবেশন কর। রাধারাণী, ললিতা সখীর কথানুযায়ী মান-পরিত্যাগ পূর্বক কুণ্ড হতে উত্থিতা হয়ে বস্ত্র পরিবর্তনের জন্য কুঞ্জ কুটীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। বস্ত্র পরিবর্তনে কিছুটা বিলম্ব হয়। শ্যামসুন্দর তখন মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। ইতিমধ্যে বৃন্দাসখী সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। শ্যাম বৃন্দাকে বললেন, ‘দেখ তোমাদের রাইধনী একবার মান করলে, তা পরিহার করতে চায় না। এখন কী উপায় অবলম্বন করলে রাইয়ের সঙ্গে মিলন হবে বলতে পারো?”

—রাইয়ের চাঁদ বদন দর্শনের যদি এতই লালসা—তবে সময় মতো আস না কেন?

—মানছি, আমার না হয় অন্যায় হয়ে গেছে। এবারকার মতো যা হোক একটা কিছু উপায় বের করো—যাতে মানিনীর মান প্রশমিত হয়।

—মানিনীর মান প্রশমিত হোক আর না হোক—আসল কথা হচ্ছে রাইসঙ্গ লালসায় তোমার অশান্ত চিত্ত প্রশমিত হোক, তাই না?

—তুমি ঠিক ধরেছ বৃন্দা। আমার প্রাণময়ী হৃদয়বল্লভাকে ছেড়ে আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। প্রিয়ার বিরহ আমার চিত্তকে মিলনের অভীপ্সায় ব্যাকুল করে তুলেছে। বৃন্দা, তুমি যদি প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের উপায় বের করে দাও, তাহলে তোমার কাছে আজীবন ঋণী থাকবো।’

—’ঋণ গ্রহণ করলে ঋণী হওয়ার প্রশ্ন ওঠে। তোমাকে যে ঋণ দেব, কি দেখে দেব? তোমার আছেটা কি?’

—কেন আমার বাঁশী, চুড়া, বনমালা, পায়ের নূপুর-এর বিনিময়ে আমি কি তোমাদের কাছে ঋণ পেতে পারি না?

—’দেখ শ্যাম, কিছু মনে কোরো না। সারাদিন ধেণু চরিয়ে চরিয়ে দেখছি তোমার বুদ্ধিটাও ধেণুর মতো হয়ে গেছে। বুদ্ধু তোমার ঐ সব সম্পদ রাইয়ের কাছে বন্ধক আছে, তা কি মনে নেই? রাই তোমাকে ঐগুলো কৃপা করে পরতে দিয়েছে।’

—বৃন্দা, এখানে যা খুশী বল আপত্তি নেই। দেখ আমার সখাদের সামনে যেন ঐসব কথা বলো না।

—বললে কি হবে?

—ওরা আমাকে নিয়ে উপহাস করবে।

—যাক তাহলে দেখছি তোমারও লজ্জা আছে। শোন, রাইয়ের সঙ্গে মিলনের জন্য একটা উপায় আমি তোমাকে বলতে পারি। যদি আমার কথামত কাজ কর তাহলে তোমার মনোরথ অবশ্যই পূরণ হবে।’

—হে বৃন্দা সখী, তুমি যা বলবে আমি তাই করতে রাজী।

—তাহলে শোন, আমি তোমাকে শ্যামাসখী সাজিয়ে একটি মনোবীণা দেব। তুমি সেই মনোবীণায় জয়রাধে, জয়রাধে, শ্রীরাধে সুর তুলে আমাদের কুঞ্জেশ্বরীর সম্মুখে উপস্থিত হবে। তোমার সুর সাধনা যদি সুন্দর হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের কুঞ্জেশ্বরী তোমায় কৃপা করবেন।

বৃন্দার কথা শেষ না হতেই শ্যামসুন্দর বললেন,—’বৃন্দাসখী, আর বিলম্ব না করে আমায় তাড়াতাড়ি শ্যামাসখী সাজিয়ে দাও। মনোবীণায় কীভাবে সুর তুলবো তা শিখিয়ে দিয়ে যত তাড়াতাড়ি পার আমাকে রাইয়ের কাছে নিয়ে চল।’

বৃন্দা শ্যামসুন্দরকে শ্যামাসখীর সাজে সাজিয়ে মনোবীণায় সুর সাধনের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে ললিতাদি সহ অন্যসখীরা সেখানে উপস্থিত হন। শ্যামকে ‘রমনীবেশে’ দেখে সকলে মুগ্ধ হয়ে যান। ভাবেন রাই বুঝি আজ শ্যামাসখী সেজেছে। মনোবীণার সুর সাধনার প্রশিক্ষণ শেষ হলে সকলে শ্যামাসখীর বেশধারী কৃষ্ণকে নিয়ে কুঞ্জকুটীরে প্রবেশ করলেন। কুঞ্জকুটীরে প্রবেশ করে মনোবীণায় ঝঙ্কার তুলে শ্যামাসখী রাইকিশোরীকে সন্তোষ প্রদান করলেন। রাইকিশোরী মনোবীণার ধ্বনি শুনে প্রসন্ন হয়ে শ্যামাসখীকে আলিঙ্গন করেন। সখীরা শঙ্খধ্বনি ও পুষ্প বরিষণ করলেন। শ্যামাসখীবেশি কৃষ্ণ ও রাধাকে কুঞ্জের অভ্যন্তরে রেখে সখীরা ধীরে ধীরে কুঞ্জ হতে বেড়িয়ে গেলেন। সখীরা বেরিয়ে যেতেই শ্যামাসখীও নিজ রূপ ধারণ করে রাই কিশোরীকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন, যুগল মিলন দেখে অন্তরীক্ষ থেকে দেবতা গন্ধর্বরা করেন বন্দনা—

”দেব গন্ধর্ব রম্যায় রাধা মান বিধায়িনে।

মান মন্দির সংজ্ঞায় নমস্তে রত্নভূময়ে।।”

অর্থাৎ দেব গন্ধর্বাদির জন্য রমনীয় শ্রীরাধারাণীর মান বিধানকারি। মান মন্দির নামক রত্নময় স্থল, হে মানমন্দির। আপনাকে নমস্কার করি। ব্রজবাসী ভক্ত বলেন, রাইয়ের মান নামক লতাটি শ্যামতরুকে জড়িয়ে ধরে বর্দ্ধিত হোক। শ্রীরাধা মানের জয় হোক।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন