ভাই-বোনের লড়াই

ভাই-বোনের লড়াই

দ্বাপর যুগে গালিব নামে এক ঋষি ছিলেন। তিনি ছিলেন ‘গালিব সংহিতা’ গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থে তিনি পতিব্রতা নারীর গুণ মাহাত্ম্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে পতিব্রতা নারী আপন তেজে মৃত্যুকেও পরাজিত করতে সমর্থ্য। পতিব্রতা নারী সর্বত্র বন্দনীয় এমন অভিমত ও তিনি তাঁর গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন।

দ্বাপরে একদিন গালিব ঋষি গঙ্গাস্নানান্তর কোমর জলে দাঁড়িয়ে অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে সূর্য্যবন্দনা করছিলেন। ঐ সময়ে চিত্রসেন নামে এক গন্ধর্ব দিব্য বিমানে সহস্র কামিনী সঙ্গে নিয়ে আকাশমার্গে বিচরণ করছিলেন। তার মুখ নিঃসৃত পানের পিক ঋষি গালিবের অঞ্জলিবদ্ধ হাতে এসে পড়ে। ঋষি কুপিত হন। ত্রিকালদর্শী ঋষি চিত্রসেনকে সমুচিত শিক্ষাদানের জন্য শাপ দিতে উদ্যত হতেই ঋষির মনে পড়ে যায়—তপঃ শক্তি ক্ষয়ের কথা। তিনি শাপ দেওয়া থেকে বিরত হয়ে চিত্রসেনের অন্যায় আচরণের শাস্তি বিধানের জন্য দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে উপনীত হয়ে বললেন, ‘প্রভু আপনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন গো ব্রাহ্মণ ধর্ম রক্ষার জন্য। আপনি বর্তমান থাকতে উদ্ধত গন্ধর্ব চিত্রসেন আমার উপাসনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। সে সূর্য্য উপাসনার সময় আমার অঞ্জলিবদ্ধ হাতে আকাশমার্গ থেকে উচ্ছিষ্ট পানের পিক ফেলেছে। আপনি এর বিচার করুন।’

শ্রীকৃষ্ণ ঋষির পাদবন্দনা করে বললেন—”আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আগামী কাল সূর্যাস্তের পূর্বেই আমি চিত্রসেনকে বধ করবো। আমি আপনার এবং আমার মাতা দেবকীর চরণ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করছি—যান ঋষিবর আপনি এবার নিশ্চিন্তে ফিরে গিয়ে উপাসনা করুন। সন্তুষ্ট চিত্তে ঋষি প্রস্থান করলেন দ্বারকার রাজসভা থেকে।

গালিব ঋষি চলে যাওয়ার পর দেবর্ষি নারদ প্রবেশ করলেন দ্বারকার রাজসভায়। সেখানে কৃষ্ণকে না দেখতে পেয়ে তিনি বীণা বাদ্যযোগে সংকীর্তন করতে করতে প্রবেশ করলেন দ্বারকার অন্তঃপুরে। শ্রীকৃষ্ণ আসন হতে উত্থিত হয়ে দেবর্ষিকে অভ্যর্থনা জানালেন। দেবর্ষি নারদ লক্ষ্য করলেন আনন্দময়ের পদ্ম আননে আজ অপ্রসন্নতার ছাপ। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—”ভগবন্ আপনি তো সদাসর্বদা আনন্দময়, শান্তিস্বরূপ, আপনার স্মরণে দর্শনে সমস্ত জগত আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অথচ আজ আপনার মুখ কমলে দেখছি অপ্রসন্নতার চিহ্ন—এর কারণ কি? শ্রীকৃষ্ণ নারদকে গালিব ঋষির ঘটনাটি আনুপূর্বিক বলে চিত্রসেনকে বধের জন্য ঋষি গালিবকে দেওয়া তাঁর প্রতিজ্ঞার কথাও বললেন।

শ্রীকৃষ্ণের মুখে চিত্রসেন বধের প্রতিজ্ঞা শুনে নারদ মনে মনে হাসলেন। হাসতে হাসতে তিনিও প্রতিজ্ঞা করলেন—আমি যদি তোমার যথার্থ ভক্ত হয়ে থাকি, তবে তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়ে চিত্রসেনের প্রাণ আমি রক্ষা করবোই—অন্যথায় আমার দেবর্ষি নামে কলঙ্ক লেপন হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না চিত্রসেনের প্রাণরক্ষা করতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বীণা আমি বাজাবো না, তোমার নাম ও কীর্ত্তন করবো না। মনে মনে এইরূপ প্রতিজ্ঞা করে নারদ কৃষ্ণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চিত্রসেনের কাছে উপনীত হলেন। গন্ধর্ব রাজ যথাবিধি দেবর্ষিকে সাদর সম্ভাষণ সহ পূজার্চনা করে জিজ্ঞাসা করলেন—”দেবর্ষি কোথা হতে আসছেন আপনি? আপনার সর্বাঙ্গীন কুশলদানে আমাকে আনন্দিত করুন।”

 দেবর্ষি বললেন—গন্ধর্বরাজ আমার সর্বাঙ্গীন কুশল কিন্তু তোমার এখন সমুহ বিপদ। যা কিছু শুভ করণীয়, তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করে নাও। কারণ তোমার জীবনের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। মৃত্যুর কথা শুনতেই গন্ধর্বরাজ ভয়ে চমকে উঠলেন। দেবর্ষিকে জিজ্ঞাসা করলেন—আমার মৃত্যু যে নিকটে, আপনি কেমন করে জানলেন। দেবর্ষি গন্ধর্বরাজকে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞার কথা শোনালেন, বললেন—আগামীকাল সূর্যাস্তের পূর্বেই শ্রীকৃষ্ণ তোমার জীবন হরণ করবেন। চিত্রসেন নিজের অজান্তে ভোগ মত্ত হয়ে ঋষি গালিবের চরণে অপরাধ এবং সেই অপরাধের দণ্ড হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের হাতে মৃত্যু হবে শুনে ভয়ে শিউরে উঠলেন। নিজ প্রাণরক্ষার জন্য তিনি ব্রহ্মা, বরুন, ইন্দ্র, কুবের সকলের কাছেই ছোটাছুটি করলেন কিন্তু কেউ তার প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে সমর্থ হলেন না। অগত্যা চিত্রসেন দেবর্ষি নারদের চরণে পতিত হয়ে বললেন—হে দেবর্ষি আমায় রক্ষা করুন। আপনি শ্রীকৃষ্ণের পরমভক্ত, আমার এই বিপদে আপনি ভিন্ন অন্য কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। এই বলে গন্ধর্বরাজ দেবর্ষির পা দুটি জড়িয়ে ধরে উচ্চৈস্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন। দেবর্ষির হৃদয় করুণায় বিগলিত হল। তিনি গন্ধর্বরাজকে বললেন ভয় নাই, এসো আমার সাথে, এই বলে তিনি চিত্রসেনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন ইন্দ্রপ্রস্থের যমুনাতটে।

যমুনার তটভূমে উপনীত হয়ে দেবর্ষি বললেন—শোন গন্ধর্বরাজ আজ অর্ধরাত্রি সময়ে এখানে এক রমনী ব্রতোপলক্ষে স্নান করতে আসবে, ঐ সময় তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি উচ্চৈস্বরে বিলাপ করবে। ঐ রমনী তোমার বিলাপ শুনে তোমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করবে তোমার বিলাপের কারণ কি? তখন তুমি ঐ রমনীকে বলবে আগে আপনি আমাকে কথা দিন যে আপনি আমাকে আশ্রয় দেবেন। সেই রমনী কথা দিলে তখন তুমি কৃষ্ণের তোমাকে বধ করার প্রতিজ্ঞার কথা বলবে। মনে রেখ চিত্রসেন সেই রমনী কথা না দেওয়া পর্যন্ত তুমি যেন ভুলেও সেই রমনীর কাছে, তোমার শোকের বা বিলাপের প্রকৃত কারণ বলবে না। দেখবে সেই রমনীই তোমার প্রাণরক্ষা করবে। চিত্রসেনকে এইভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে দেবর্ষি নারদ সন্ধ্যার কিছু পূর্বেই ইন্দ্রপ্রস্থে অর্জুনের মহলে প্রবেশ করে অর্জুনপত্নী সুভদ্রার কাছে উপনীত হয়ে বললেন—সুভদ্রে, আজকের তিথিটি বড় পবিত্র। এই তিথিতে অর্ধরাত্রি সময়ে যমুনায় স্নানান্তে যদি কোন দীন প্রার্থীকে রক্ষা করা হয় তাহলে অক্ষয় পূণ্য সঞ্চয় হয়। পতিব্রতা রমনীর পক্ষে বিশেষ করে এই তিথি চির সৌভাগ্য প্রদানকারী। নারদের মুখে পূণ্যতিথির কথা শুনে সুভদ্রা ওই দিন অর্ধরাত্রে দেবর্ষির সঙ্গে যমুনায় স্নানের জন্য রওনা দিলেন। সেখানে স্নান শেষ হওয়ার পরে তিনি চিত্রসেনের বিলাপ ধ্বনি বা ক্রন্দন শুনতে পেলেন। সিক্ত বসনে তিনি চিত্রসেনের কাছে উপনীতা হয়ে বিলাপের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। গন্ধর্বরাজ বললেন—’দেবী যদি আপনি আমাকে আশ্রয় দান করে আমার প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমি আপনাকে আমার বিলাপ বা দুঃখের কারণ জানাবো। সুভদ্রা দেবর্ষি নারদকে সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করলেন—আমি অবশ্যই তোমাকে আশ্রয় দিয়ে তোমার প্রাণরক্ষা করবো। এখন বল তোমার বিলাপের কারণ কি?

গন্ধর্বরাজ বললেন—আপনার অগ্রজ ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণ আমাকে কাল সূর্যাস্তের পূর্বে বধ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। আমার অপরাধ, আমি আকাশমার্গে বিমানযোগে বিচরণের সময় অজান্তে ঋষি গালিবের অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে পানের পিক ফেলেছিলাম। গন্ধর্বরাজের মুখে অগ্রজ শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞার কথা শুনতেই সুভদ্রা হতচকিতা কিংকর্তব্যবিমূঢ়া হয়ে পড়লেন। তিনি ভেবে পেলেন না এখন তাঁর করণীয় কি? একদিকে গো ব্রাহ্মণ ঋষি ধর্ম হিতকারী দীনবন্ধু ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা—অন্যদিকে শরণাগত গন্ধর্বরাজকে রক্ষার জন্য নিজের প্রতিজ্ঞা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এই অসামঞ্জস্য অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্থির করলেন আমার প্রাণ যায় যাক, আমি এই শরণাগতের প্রাণ রক্ষা করবোই করবো। এইরূপ সংকল্প করে তিনি গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে সঙ্গে করে রাজমহলে ফিরলেন এবং স্বামী অর্জুনকে সমস্ত ঘটনাটি খুলে বললেন। অর্জুন সব শুনে সুভদ্রাকে বললেন,—’ভয় নেই প্রিয়ে। তোমার প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য পার্থের গাণ্ডীবই যথেষ্ট।’ সুভদ্রা নিশ্চিন্ত হলেন।

অন্যদিকে নারদ ইতিমধ্যে পরদিন প্রভাতেই দ্বারকায় উপনীত হয়ে কৃষ্ণের কাছে গন্ধর্ববধ প্রতিজ্ঞার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই কৃষ্ণ বললেন,—’আজ সূর্যাস্তের পূর্বেই আমি চিত্রসেনকে বধ করবো।’ নারদ তা শুনে মৃদু হেসে বললেন,—’সে না হয় করবেন কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার বোন সুভদ্রা ও ভগ্নীপতি অর্জুন তাকে আশ্রয় দিয়ে তার জীবনরক্ষা করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন’। কৃষ্ণ বললেন,—’দেবর্ষি, অর্জুন সুভদ্রা এটা ঠিক কাজ করেনি। আপনি আমার পক্ষ থেকে ওদের কাছে যান এবং বুঝিয়ে বলুন আমার প্রতিজ্ঞার কথা।’ অনন্তর নারদ আবার ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হয়ে অর্জুন সুভদ্রাকে শ্রীকৃষ্ণের সংবাদ শোনালেন। বললেন—তোমরা চিত্রসেনকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করে কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা রক্ষায় সহায়তা করো। অর্জুন বললেন,—’দেবর্ষি যদিও আমি সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত তবুও আমি শ্রীকৃষ্ণের কথানুযায়ী প্রতিজ্ঞাচ্যুত হয়ে ক্ষাত্রধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হতে পারবো না। আমি তাঁর শক্তিতেই শক্তিমান হয়ে আমার এবং আমার স্ত্রী সুভদ্রার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবো। বরং আপনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে পুনরায় গিয়ে বলুন তিনি যেন তাঁর প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করেন।’

নারদ পুনরায় দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন সবকথা। নারদের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে শ্রীকৃষ্ণ তৈরী হলেন অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। ঐ দিন অপরাহ্নের কিছু পূর্বেই ইন্দ্রপ্রস্থের ভূমিতে শুরু হল অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ। উভয় পক্ষের সৈন্য অশ্ব-গজ-পদ ও রথচক্রভারে কেঁপে উঠলো ইন্দ্রপ্রস্থের ভূমি। অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ রথারূঢ় হয়ে মুখোমুখি সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে পাঁচ বাণ নিক্ষেপ করে প্রণাম জানালেন। শ্রীকৃষ্ণ তদুত্তরে দশ বাণ নিক্ষেপ করে অর্জুনের মস্তকে আশীষ বর্ষণ করলেন। ধীরে ধীরে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম শুরু হল। পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র গুরুশিষ্যের লড়াইয়ে মুখর হয়ে উঠলো। অবশেষে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের উদ্দেশ্যে সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন ও তৎপ্রতিকারে পাশুপত অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। মহাশূন্যে দুই অস্ত্রের লড়াই শুরু হল। অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারিদিক। মহাপ্রলয়ের চিহ্ন ফুটে উঠলো। এইরূপ ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অর্জুন স্মরণ করলেন আপন ইষ্টদেব দেবাদিদেব মহাদেবকে। ভগবান শিব তৎক্ষণাৎ রণস্থলে আবির্ভূত হয়ে দুই অস্ত্রের উদ্দেশ্যে স্তুতি করে অস্ত্রদ্বয়কে প্রশমিত করলেন। অতঃপর দেবাদিদেব কৃষ্ণের কাছে উপনীত হয়ে বললেন—প্রভু। আজ আপনার একি বিচিত্র লীলা দেখছি। আপনার অনুগত ভক্ত অর্জুনের প্রতি আপনার এই ব্যবহার শোভনীয় নয়। ভক্তের প্রতিজ্ঞার কাছে আপনার প্রতিজ্ঞা তো চিরকালই জলাঞ্জলি দিয়েছেন, সেকথা কি ভুলে গেছেন? আপনার যে প্রতিজ্ঞা ভীষ্ম ভেঙে দিয়েছেন, সে প্রতিজ্ঞার চেয়ে চিত্রসেন বধের প্রতিজ্ঞা কি অধিক মূল্যবান? দয়া করে আপনি শান্ত হোন। অর্জুনের ও সুভদ্রার প্রতিজ্ঞা রক্ষাতেই আপনার গৌরব। ভগবান শিবের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র সংবরণ করে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন এবং ভক্ত অর্জুনকে বক্ষলগ্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাঁর যুদ্ধশ্রমজনিত ক্লান্তি দূর করে দিলেন। এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুভয়ে ভীত চিত্রসেনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে তাকে অভয় প্রদান করলেন। ভক্তবৎসল ভক্তের প্রার্থনায় প্রতিজ্ঞা পালন ধর্ম বিসর্জন দিলেন। কিন্তু এই সংবাদ যখন গালিব ঋষির কাছে পৌঁছালো এবং তিনি যখন শুনলেন শ্রীকৃষ্ণ চিত্রসেনকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে অভয়তা প্রদান করেছেন—তখন তিনি কূপিত চিত্তে সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন ও সুভদ্রাকে অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করে দেওয়ার জন্য কমণ্ডলু থেকে হাতে জল নিলেন। তা দেখে সুভদ্রা বললেন—হে ঋষিবর, আমি যদি শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত এবং পতিব্রতা হয়ে থাকি তাহলে ঐ জল আপনার হাতেই জমে থাকবে, আপনার হাত থেকে ধরিত্রী বা কারও অঙ্গে পতিত হবে না। সুভদ্রার সতীত্বের প্রভাবে ঋষি গালিবের হাতের জল হাতেই জমে গেল। ঋষি লজ্জিত হলেন। তা দেখে সুভদ্রা ঋষির কাছে উপনীতা হয়ে চরণ বন্দনা করে বললেন, ‘ঋষিবর, আপনি আপনার গ্রন্থে সতী নারীর মহিমা কীর্তন প্রসঙ্গে বলেছেন—সতী নারী অপরাজিতা। পতিব্রতার সতীত্বের কাছে মৃত্যুও পরাজিত হয়। আজ চিত্রসেন-এর মৃত্যু হলে আপনার গ্রন্থের বাণী যে মিথ্যা হয়ে যাবে।’ গালিব ঋষি বললেন, ‘পতিব্রতার বিরোধ করার শক্তি আমার নেই মা। অনুমতি দাও কমণ্ডলুর জল কমণ্ডলুতেই রাখি।’ সুভদ্রা সম্মতি দিলে ঋষি হাতের জল কমণ্ডলুতে রেখে সুভদ্রাকে আশীর্বাদ করে সেখান হতে বিদায় নিয়ে আশ্রম অভিমুখে রওনা দিলেন। সুভদ্রা ও দেবর্ষি নারদের ক্ষণিক সৎসঙ্গে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের হৃদয়ও পরিবর্তিত হল। তাঁর অন্তরের ভোগ বাসনা প্রশমিত হল এবং তিনিও অন্তে শ্রীকৃষ্ণ কৃপালাভ করে পরমপদ প্রাপ্ত হলেন।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন