ছোট্ট নদী শিপ্রা। এই নদীর তীরে অবস্থিত অবন্তীনগর। বর্তমান নাম উজ্জয়িনী। এখানেই মহর্ষি সন্দিপনীর গুরুকুল আশ্রমে অধ্যয়নরত কৃষ্ণ ও বলরাম। গুরু—গুরুপত্নী ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা সকলেই কৃষ্ণ বলরামের গুরুভক্তি নিয়মনিষ্ঠা ও মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ। এককথায় আশ্রমের সকলের নয়নমণি কৃষ্ণ বলরাম। তাঁদের সুমধুর যুগলকণ্ঠের বৈদিক মন্ত্রের স্পষ্ট উচ্চারণ গুরুদেব পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে শোনেন। এই আশ্রমের এক পড়ুয়ার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। শ্রীকৃষ্ণ বলরামের আশ্রমে আসার প্রথম দিন থেকেই পড়ুয়াটি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং কৃষ্ণকে সে প্রথম দিন থেকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেন। পড়ুয়াটির নাম সুদামা। সে শ্রীকৃষ্ণের শাস্ত্রজ্ঞান, গুরুভক্তি, বাককুশলতা ও রূপমাধুরী দেখে মুগ্ধ হয় এবং নির্জনে একা বসে ভাবে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই ভগবান। ভগবান ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে এত রূপগুণ থাকা সম্ভব নয়। গুরুর কাছে অধ্যয়নের সময় সুদামা শ্রীকৃষ্ণের একদিকের পাশের আসনটিতে বসেন অন্যপাশে বসেন দাদা বলরাম। একদিন অপরাহ্নে অধ্যয়ন শেষে কৃষ্ণ ও সুদামা যখন আলাপমগ্ন ছিলেন তখন গুরুপত্নী তাদের উভয়কে বন থেকে কাঠ কন্দমূল ও ফল সংগ্রহ করে আনার জন্য আদেশ করলেন। আদেশ পাওয়া মাত্র দুই বন্ধুতে বনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
রাস্তায় চলতে চলতে শ্রীকৃষ্ণ সুদামার কাঁধে হাত রেখে বললেন,—’বন্ধু! তুমি তো আমাকে প্রেমের শক্ত বাঁধন দিয়ে বেঁধে ফেলেছো। আমার সাধ্য নেই তোমার প্রেমের বাঁধন ছিন্ন করা।’ কৃষ্ণের মুখে কথাটা শোনামাত্রই সুদামার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। সে সহসা কোন কথা বলতে পারে না। তার যেন মনে হল সে কৃষ্ণের সঙ্গে বনে বিচরণ করছে না—সে বিচরণ করছে ব্রহ্মলোকে। ভাব বিহ্বল কণ্ঠে সে বলে,—’কানাই তুমিই তো সাক্ষাৎ ভগবান।’
কৃষ্ণ বলেন,—’বন্ধু সুদামা, আমরা সবাই তো ভগবানের অংশ। প্রত্যেক প্রাণীর বা জীবের মধ্যে ভগবানের কিছু না কিছু গুণের বিকাশ দেখা যায়। যেমন তোমার মন্ত্রশক্তি, নামভক্তি, ইষ্টনিষ্ঠা ও প্রেম ভগবান প্রদত্ত। সংসারে তোমার মতো বন্ধু পাওয়া দুর্লভ।’ কৃষ্ণের কথা শুনে সুদামা বলেন,—’কানাই, আমি তো সামান্য এক দীন ব্রাহ্মণ মাত্র। জগতে আমার মতো নির্ধন-দরিদ্র আর কেউ নেই।’ কৃষ্ণ সুদামার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেন, ”ও কথা বলো না বন্ধু। সংসারে তোমার মতো ধনবান আর কেউ নেই। প্রেমপূর্ণ হৃদয়ই ভগবানের নিবাসস্থল। তোমার হৃদয়ভরা প্রেম। আর সেই প্রেমে ভগবানকে তুমি বশে রেখেছো। ভগবানের কাছে ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-পণ্ডিত, উঁচু-নীচু, এইসব ভেদ নেই।’ এইভাবে কথা বলতে বলতে দুই বন্ধু বনের গভীরে প্রবেশ করলেন।’ সেখানে যজ্ঞের জন্য কাঠ কন্দমূল, ফলপুষ্প ও কুশআদি সংগ্রহ করে একত্র করে পুনঃ দুই বন্ধুতে বার্তালাপ শুরু করলেন। কুশতৃণের গোছা বাঁধতে বাঁধতে কৃষ্ণ বললেন,—’বন্ধু তুমি তো এক মহান শিল্পী। কুশ তৃণ দিয়ে তুমি নানা অলংকার ও যজ্ঞোপবীত তৈরি করতে পারো শুনেছি। আমি এও শুনেছি যে তোমার তৈরি কুশতৃণের অলংকার ও যজ্ঞোপবীত এর কাছে স্বর্ণাদি রত্ন নির্মিত অলংকারও তুচ্ছ বা ম্লান হয়ে যায়।’ কৃষ্ণের কথা শেষ হতেই সুদামা বলেন,—”বন্ধু, আমিও শুনেছি তুমি একজন ভালো দারুশিল্পী। তুমি নাকি কাঠের খুব সুন্দর সুন্দর মূর্তি তৈরি করতে পারো— তোমার তৈরি মূর্তির কাছে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি ও নাকি তুচ্ছ হয়ে যায়।’ দুই বন্ধুতে এইভাবে যখন পরস্পর পরস্পরের শিল্পকর্মের প্রশংসা করছিল, তখন সহসা চারিদিকে আঁধার নেমে এল। ঝড় শুরু হল। মাথার উপরে শোনা যায় মেঘের গুরু গুরু গর্জন! কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। দুজনেই হতচকিত হয়ে পড়ে। আশ্রমে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকায়। কিন্তু সে বিদ্যুতের চমকানিতে ঘন বনের পথ দেখা যায় না। দেখতে দেখতে আঁধার আরও ঘনীভূত হয়। শ্রীকৃষ্ণকে ভিজতে দেখে সুদামা দুই বাহু দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে রাখে। শ্রীকৃষ্ণের কোন অঙ্গে যাতে বৃষ্টি বা ঝড় না লাগে তার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করে। সুদামা যেন কৃষ্ণের অগ্রজ। কৃষ্ণকে সর্বতোভাবে ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করাই যেন তার একমাত্র কাজ। কৃষ্ণ সুদামার বুকের মধ্যে আশ্রয় নেয়। এইভাবে সারারাত দুই বন্ধুতে মিলে বনের মধ্যে একটা গাছের নীচে অতিবাহিত করে। দেখতে দেখতে সকাল হয়। প্রভাতের আলো ফুটে ওঠে। বনভূমে এখন আর আঁধার নেই—নেই ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডবনর্ত্তন। সারারাত দুই বন্ধু আশ্রমে ফেরেনি। তাই গুরুদেব সন্দিপনী বলরাম ও অন্যান্য বিদ্যার্থীর সঙ্গে বনে প্রবেশ করে কৃষ্ণ সুদামার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে উপস্থিত হলেন সেই গাছতলায়, যেখানে সুদামার বুকের মধ্যে থেকে শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তখনও পর্যন্ত। এই দৃশ্য দেখে গুরুদেব সন্তুষ্ট হলেন। তিনি উভয়কে নাম ধরে ডাকতেই উভয়েই গুরুদেবের কাছে উপনীত হয়ে গুরুদেবকে প্রণাম জানালেন।
গুরুদেব সুদামার মাথায় হাত রেখে বললেন,—’সুদামা তুমি আশ্রমের মর্যাদা রেখেছো। আমি আশীর্বাদ করছি—ইতিহাস একদিন তোমাদের বন্ধুত্বকে অমরতা প্রদান করবে। যুগ যুগ ধরে মানুষ তোমার বন্ধুত্বের কথাকে স্মরণ করে ধন্য হবে। আমি আরও আশীর্বাদ করি সমস্ত বৈদিক জ্ঞান তোমার অধিগত হোক। এখন চল, আমরা সবাই আশ্রম অভিমুখে রওনা হই।’ কৃষ্ণ-সুদামা, গুরু ও সতীর্থদের সাথে বন হতে আশ্রমের অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন।
তারপর কেটে গেছে আরও অনেক দিন। দেখতে দেখতে এসে গেল আশ্রম থেকে বিদায় নেওয়ার পালা যাকে তখনকার দিনে বলা হত সমাবর্তন দিবস। বিদায়ক্ষণে শ্রীকৃষ্ণ সুদামার হাতে একটি কাষ্ঠমূর্তি দিয়ে বললেন—বন্ধু, বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আমার অনুপস্থিতিতে যখন তোমার হৃদয় কেঁদে উঠবে—তখন এই মূর্তির মাঝে আমাকে দেখো।
সুদামা শ্রীকৃষ্ণের কাছ হতে কাঠের মূর্তিটি নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। তারপর মূর্তিটিকে আর একবার ভালো করে নিরীক্ষণ করে সেটি ঝোলায় রেখে দিলেন। ঝোলা থেকে কুশতৃণদ্বারা তৈরী একটি করবন্ধন [কুশের তৈরি বালা] বের করে শ্রীকৃষ্ণের হাতের কব্জীতে বেঁধে দিয়ে বললেন,—”বন্ধু! তৃণনির্মিত এই করবন্ধন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপতে জপতে তৈরি করেছি তোমার জন্য। যদিও তুমি কালজয়ী পুরুষ। তবুও আমার দেওয়া এই করবন্ধন তোমার প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে তোমাকে রক্ষা করবে।’
শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন—”বন্ধু! করবন্ধন নয়-এ আমার রক্ষা—বন্ধন।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন