কৃষ্ণের অতিথি সৎকার

দ্বারকায় প্রবেশ করেছেন মহর্ষি দুর্বাসা। রাজপথ দিয়ে চলেছেন তিনি। চলতে চলতে দ্বারকাবাসীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছেন—আমি মহাক্রোধী দুর্বাসা! আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও কোন আচরণের সামান্য ত্রুটিও আমি সহ্য করি না, তাকে অভিশাপ দিই। আমাকে চাতুর্মাস্য করতে হবে। কে আছে ধার্মিক গৃহস্থ আমাকে আমন্ত্রণ জানাও।

দুই-এক দিনের ব্যাপার হয় তো দু’একজন সাহস নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারে। কিন্তু চারমাস ধরে এই মহাক্রোধী ঋষিকে ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়ে কি শেষে বিপদে পড়বে? দ্বারকাবাসী সাহস করে না দুর্বাসাকে আমন্ত্রণ জানাতে। কারণ ঋষি কখন কার উপর সন্তুষ্ট বা কুপিত হবেন তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। অতএব ডেকে বিপদ বরণ করতে কেউ রাজী নয়।

তবে দুর্বাসার কি চাতুর্মাস্য হবে না? তিনি কি দ্বারকা থেকে ব্যর্থ হয়ে অথবা কুপিত হয়ে অভিশাপ দিয়ে দ্বারকাবাসীর সর্বনাশ করে ফিরে যাবেন? না তা সম্ভব নয়। ঋষির অপমান হলে নগরের অকল্যাণ হবে। অতএব দুর্বাসাকে চাতুর্মাস্য পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। অন্যথায় দ্বারকাবাসী ঋষির শাপের কোপে পড়বেন—তাই শ্রীকৃষ্ণের কর্ণে দুর্বাসার চিৎকার পৌঁছাতেই তিনি এগিয়ে এসে ঋষিকে প্রণাম করে বদ্ধ অঞ্জলি হস্তে বললেন—ভগবন্। আপনি এই সেবকের গৃহে পদার্পণ করে, গৃহকে ধন্য করুন।

দুর্বাসা শ্রীকৃষ্ণের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে তাঁর সঙ্গে চলতে থাকলেন। অন্য সময় ঋষি যখন কোথাও যান, হাজার হাজার শিষ্য নিয়ে যান। এবার দ্বারকায় এসেছেন একা। শ্রীকৃষ্ণ দুর্বাসাকে সঙ্গে করে নিয়ে মহারানী রুক্মিনীর প্রাসাদে উঠলেন এবং ঋষির বিশ্রামের ব্যবস্থা করে ঋষির সেবার ব্যাপারে মহারানীকে সতর্ক থাকতে বললেন। দুর্বাসার কোনও নিয়ম নেই। কখনও সন্ধ্যা আহ্নিক করতে সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে যান। ফিরে আসেন মধ্যরাত্রে। কখনও সাগরতটেই দু’চারদিন ধ্যানস্থ থেকে যান। কখন যে তিনি বাইরে যাবেন, কখন যে তিনি ফিরবেন কেউ জানে না। কখনও চান শীতল জল, কখনও বা গরম জল। কখনও বা অর্ধরাত্রে ভোজন চান—কখনও বা দিনের শেষ প্রহরে যে সময়ে, যে জিনিস অপ্রাপ্য সেই সময়ে সেইসব জিনিস যথা ফলমূল, শাকসব্জী চেয়ে বসেন।

এককথায় ঋষির মর্জি বোঝা ভার। কাজেই মহারানী রুক্মিনীকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ঋষির সেবা করেন।

কিন্তু একমাত্র তার পক্ষেই এই সেবা সম্ভব। কারণ তিনি যে স্বয়ং লক্ষ্মী। দুর্বাসা যা যা প্রার্থনা করেন মহারানী তৎক্ষণাৎ তা সেবার জন্য উপস্থিত করেন ঋষির কাছে। এমনকি ঋষির অসময়ের বস্তু প্রার্থনাও রুক্মিনীকে অপ্রস্তুত করতে পারে না। মহারানী নিজ হাতে সকল সেবা কর্ম সমাধান করেন।

একদিন দুর্বাসা বললেন,—’আজ আমি রথে চড়ে নগর ভ্রমণে বের হব।’ সঙ্গে সঙ্গে রথ প্রস্তুত। দুর্বাসা বললেন,—’রথে অবলা পশুকে সংযুক্ত করে তাকে দিয়ে টানতে তোমাদের লজ্জা করে না? অশ্ব পশু বলে তার কি রথ টানাতে কষ্ট হয় না? তোমরা স্বামী স্ত্রী অশ্বের পরিবর্তে রথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রথ টানতে থাকো আমি ঐ রথে চড়ে রথ চালাবো এবং ভ্রমণ করবো।’ দুর্বাসার কথা শুনে কৃষ্ণ একবার তির্যকভঙ্গীতে মহারানীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। দৃষ্টির অর্থ—এসো মহারানী নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করি।

শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিনী অশ্বের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে রথ টানতে শুরু করলেন—দুর্বাসা চাবুক হাতে নিয়ে সেই রথে চড়ে যথেচ্ছভাবে কারণে অকারণে উভয়ের অঙ্গে কষাঘাত করতে লাগলেন। রথ দ্রুতবেগে চলতে থাকে। চাবুকের আঘাতে মহারানীর ও কৃষ্ণের কোমল অঙ্গে কালশিটে পড়ে যায়। নীরবে উভয়ে তা সহ্য করেন। একবারের জন্যও এমনকি বেদনার্ত চীৎকার করেন না। দ্বারকাবাসী, আত্মীয় স্বজন, কৃষ্ণ পুত্ররা, পুত্রবধুরা সেবক-সেবিকারা এদৃশ্য দেখেন আর নীরবে চোখের জল ফেলেন। অসহ্য বেদনাকর নির্মম দৃশ্য দেখেও তারা জোর করে ক্রন্দনের ধ্বনি চেপে রাখেন। কেউ কেউ বা দূরে সরে যান সহ্য করতে না পেরে।

ঋষি দুর্বাসার সেদিকে দৃকপাত নেই। তিনি আপন মনে বেপরোয়াভাবে উভয়অঙ্গে প্রহার করতে করতে রথে আরোহণের সুখ অনুভব করছেন। দ্বারকার অলিন্দ হতে, প্রাসাদের ছাদ হতে, গবাক্ষ পথ হতে ভেসে আসে রমনীদের কণ্ঠস্বর। এ ঋষি নয়, এ দানব! ক্রুর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন সবাই। অভিশাপ দিতে থাকেন ঋষিকে। কিন্তু সামনে গিয়ে কিছু বলার সাহস কারোর নেই। সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হয়েছেন কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন। কিন্তু পিতার সামনে ঋষির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস তাঁর নাই। তাই তিনি জ্যেষ্ঠতাত বলরামের কাছে উপনীত হয়ে বললেন, ‘তাত! আপনিও কি দুর্বাসার ভয়ে ভীত? ওই নিষ্ঠুর ঋষি অশ্বের স্থানে আমার বাবা-মাকে জুড়ে বাবা মায়ের কোমল অঙ্গে আঘাত করছে, আমার মা-বাবার সম্মান দ্বারকার রাজপথের ধূলায় লুটিয়ে দিচ্ছে—অথচ তা দেখেও আপনি শান্তচিত্তে সহ্য করছেন? আপনার কাছে এর কি কোন প্রতিকার নেই?

বলরাম ক্রোধে আরক্ত হয়ে উঠলেন। মহা অনর্থ কিছু একটা ঘটার পূর্বেই ঋষি রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণকে রথের স্থান থেকে পৃথক করে হৃদয় চেপে ধরে বললেন,—’মধুসূদন তুমি ধন্য। তুমি সত্য সত্যই পুরুষোত্তম ব্রহ্মণ্যদেব। তোমাদের দুজনার কীর্তি জগতের বুকে অমর হোক।’ মহর্ষির কৃপাদৃষ্টিতে উভয়ের অঙ্গে কশাঘাতের চিহ্ন লুপ্ত হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণ মহর্ষিকে নিয়ে রুক্মিনীর সঙ্গে অন্দর মহলে প্রবেশ করলেন। এখবর বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে আপন ভবন ত্যাগ করে দুর্বাসার দিকে যাওয়ার আগেই পেয়ে গেলেন। তিনি আজ অনুজ কৃষ্ণের উপর কিছুটা রুষ্ট হলেন। নতুন নতুন লীলা নাটক রচনা করতে কৃষ্ণের তো জুড়ি নাই কিন্তু বেচারী গৃহবধূকে কষ্ট দিতে এর বিন্দুমাত্র সংকোচ হলো না। বলরাম এও জানেন—ভাইয়ের ইচ্ছা ব্যতীত দুর্বাসার সাধ্য নাই এমন আচরণ করার।

এই ঘটনায় সমগ্র দ্বারকায় দুর্বাসার মান সম্মান ধূলায় লুটিয়ে গেল। দ্বারকাবাসী কেউই আর আগের মতো দুর্বাসাকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানায় না। দুর্বাসা নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছেন। দুর্বাসার এই আচরণ শ্রীকৃষ্ণ পুত্রদের মনে ঋষি মুনিদের প্রতি এক আক্রোশের জন্ম দিল। এই কারণেই কৃষ্ণতনয় শাম্ব পিণ্ডারীক তীর্থে স্ত্রীবেশে মুনি ঋষিদের সামনে এসে উপহাস করেছিলেন। যা পরবর্তীকালে যদুকুলের বিনাশের কারণ হয়েছিল। যাইহোক মহর্ষি দুর্বাসার চাতুর্মাস্য পূর্ণ হয়ে গেল। শেষ দিনে উনি বললেন—আজ আমি পরমান্ন ভোজন করবো। অধিক পরিমাণে পরমান্ন রন্ধন করো।

মহারানী রুক্মিণী পরমান্ন রন্ধন করে একটি বড় স্বর্ণথালায় ঢেলে ঋষিকে পরিবেশন করলেন। ঋষি ভোজনে বসলেন। অল্পমাত্র গ্রহণ করেই ঋষি ভোজন ত্যাগ করে উঠে পড়লেন। বেশি ভোজন করলেন না। ভোজনান্তে আচমন করতে করতে তিনি কৃষ্ণকে আদেশ করলেন,—’কৃষ্ণ, তুমি অবশিষ্ট পরমান্ন নগ্ন হয়ে নিজের সারা শরীরে মেখে নাও এবং মাখা হয়ে গেলে আমার সামনে উপস্থিত হও।’ ঋষির আদেশে পীতাম্বর দিগম্বর হয়ে সারা শরীরে পরমান্ন মেখে নিলেন। তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সারা শরীর শুভ্রবর্ণ ধারণ করলো। কিন্তু কৃষ্ণ ঋষির প্রসাদ পদতলে মাখতে বা লেপন করতে পারলেন না—এতে গোমাতা ও ঋষির প্রসাদ দুইয়ের অবমাননা হবে এই ভেবে। মাখা শেষ হলে তিনি ঋষির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঋষি কৃষ্ণের সর্বাঙ্গ লক্ষ্য করে বললেন,—’পদতলে পরমান্ন লেপন করনি কেন?’ কৃষ্ণ বললেন,—’আপনার প্রসাদ পদতলে লেপন করলে আপনার, গোমাতার অপমান হবে।’ ঋষি বললেন,—’তোমার অঙ্গে যেখানে যেখানে পায়স লেপন করেছো।—তা কোন অস্ত্র-শস্ত্র ভেদ করতে পারবে না কিন্তু পদতল তোমার অরক্ষিত থেকে গেল। ঐ পথ দিয়ে মৃত্যু এসে তোমার নরলীলার যবনিকাপাত ঘটাবে।’

মহর্ষি দুর্বাসা কৃষ্ণ অঙ্গে পরমান্ন লেপন করে কি কৃপা করতে চেয়েছিলেন তা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেল। মহানায়কের মহালীলার অবসান কোন পথে হবে তা দিবালোকের মতো সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন