শ্রুতিমাতা বলেছেন ভগবান জীবের স্বজাতীয় এবং সখা। হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োর খনন কার্য চালাতে গিয়ে গবেষকরা একটি চিত্র পান। পাথরে খোদিত ঐ চিত্রে দেখা যায় একটি গাছের শাখায় দুটি পাখি বসে আছে। একটি পাখি ফল খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে এডাল থেকে ওডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বসছে। অন্য পাখিটি ফল মুখেই দেয় না—সে চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে আছে একই জায়গায়। চিত্রটি পেয়ে গবেষকদের মধ্যে বিচার বিতর্ক শুরু হয়। সকলের প্রশ্ন—চিত্রটি কোন সভ্যতার পরিচয় বহন করে? এক বেদজ্ঞ বিদগ্ধ বলেন, ‘চিত্রটি বৈদিক ভারতের। ঋকবেদের ”দ্বা সুপর্ণা সযজুা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে” এই মন্ত্রানুযায়ী চিত্রটি অঙ্কন করা হয়েছে।”
বেদবৃক্ষের গলিত ফল ‘শ্রীমদ্ ভাগবত’ তারই ইঙ্গিত—ব্রজের নীল যমুনার তটে সখাসনে ক্রীড়ামত্ত লীলাবিহারী শ্রীগোবিন্দ। খেলার নিয়ম—যে হারবে তাকে ঘোড়া হতে হবে। বিজয়ী যে জন আরোহী হয়ে তার উপর চড়বে। খেলতে খেলতে শ্রীদামা বেশ কয়েকবার হেরে যায়। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ঘোড়া করে সওয়ারী হয়ে তাঁর পিঠে চড়ে বসল। বেচারা শ্রীদামা, কৃষ্ণকে পিঠে চাপিয়ে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে হাঁপিয়ে যায়। সে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। খেলা চলতে থাকে, এবার কৃষ্ণ হেরে গেল। শ্রীদামা তখন বলল, ‘এবারে আমার চড়ার পালা। নে কানাই এবার তুই ঘোড়া সাজ, আমি তোর পিঠে চড়ি।’
কৃষ্ণ বাহানা দেখায়—’আজ দেরী হয়ে গেছে। ধেণু নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে—ওই দেখ সূর্য ডুবুডুবু। সাঁজ হয়ে এসেছে, চল ধেণু নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাই। আগামীকাল যখন পুনরায় মাঠে গোচারণ করতে আসবো—তখন তোর জেতার দান দেব।’
শ্রীদামা বলল,—’উঁহু, ওটি হচ্ছে না। আমি দান জিতেছি আজ। আর তুই ঘোড়া হয়ে কালকে চড়াবি পিঠে! আজকে সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন আজ তোর পিঠে না চড়ে ছাড়ছি না।”
কৃষ্ণ বলল, ‘দেখ শ্রীদামা, ফিরতে দেরী হলে মা আমার জন্য চিন্তা করবে। তাই বলছি আজ ফিরে চল, কাল ঘোড়া হয়ে তোকে পিঠে চড়াব।’
শ্রীদামা, কৃষ্ণের কথা শুনে রেগে বলল, ‘দেখ কানু, তুইও গরুর রাখালি করিস, আমিও গরুর রাখালি করি। আমরা দুজনেই রাখাল। তুই তোর মা-বাবার আদরের ছেলে, আমিও আমার মা-বাবার আদরের ছেলে। তোর বাবা রাজা, আমার বাবাও রাজা। তবে হ্যাঁ, আমার বাবার চেয়ে তোর বাবার গরুর সংখ্যা কিছু বেশি। এরজন্য যদি তোর অহংকার হয়—তবে সেই অহংকার তোকে ভুলতে হবে। অহংকার নিয়ে খেলতে নামলে খেলার মজা পাওয়া যায় না।’
—’আহা-হা অত রাগ করছিস কেন ভাই! আমি কখনও বলেছি, যে তোর বাবার চেয়ে আমার বাবার গরু বেশি আছে, আমরা তোদের চেয়ে বেশী ধনী?—শ্রীদামা তুই এসব কথা কেন তুলছিস?
—দেখ কানু, আমি যতবার হেরেছি, ততবার ঘোড়া হয়েছি। তুই খোশ মেজাজে আমার পিঠে চড়েছিস। তোকে পিঠে নিয়ে আমি সারা মাঠে সাত পাক দিয়েছি। কোন কথা বলিনি। খেলার নিয়ম অনুযায়ী আমার হার হয়েছিল, আমি তা স্বীকার করে নিয়েছি। এখন তুই হেরে গেছিস, অতএব আমি তোর পিঠে চড়বোই চড়বো।
—’আমি আজ তোর ঘোড়া হতে পারব না।’—কৃষ্ণের সোজা জবাব।
—’তাহলে তুইও শুনে রাখ যদি তুই আমাকে খেলার দান না দিস, তাহলে কাল থেকে তোর সঙ্গে খেলব না—খেলব না—খেলব না’—
শ্রীদামা ত্রিসত্য করে শপথ নিয়ে বলল, ‘তুই যেদিন হেরে যাস, সেদিন দান দেওয়া নিয়ে নানা গোলমাল করিস। তাই স্থির করেছি কাল তোর সঙ্গে আমরা কেউ-ই আর খেলব না। যদি খেলি তবে তোকে সঙ্গে নেব না।’
শ্রীদামা যেই বলেছে—’আমরা তোর সঙ্গে খেলব না। যদি খেলি তবে তোকে সঙ্গে নেব না,’ অমনি কানুর চোখে জল দেখা দিল। সে কাঁদকাঁদ হয়ে শ্রীদামাকে বলল, ”আমি এক্ষুনি ঘোড়া হচ্ছি তুই চড়। কিন্তু কথা দে আমাকে খেলায় নিবি? কখনও খেলা বন্ধ করবি না?”
—যদি ঘোড়া হয়ে পিঠে চড়তে দিস, তাহলে তোর সব কথা শুনবো। শ্রীমদভাগবত পুরাণের ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ তখন বলে—
”উবাহ কৃষ্ণো ভগবান্ শ্রীদামানং পরাজিতঃ।
………….. …………….. ……………….. ………….।।
পরাজিত শ্রীকৃষ্ণ তখন ঘোড়া হয়ে শ্রীদামাকে পিঠে চড়াল। শ্রীদামা সওয়ারী হয়ে কৃষ্ণের পিঠে চড়ে মুখে বনলতার লাগাম পরিয়ে দিয়ে—তাঁর চুলের গোছা ধরে বলল,—এই ঘোড়া চল চল।
তখন গোধূলি বেলা। সখীসহ রাধারাণী তখন ঐপথে আসেন যমুনায় জল নিতে। দূর হতে তাঁকে আসতে দেখে শ্রীদামা কৃষ্ণের পিঠ থেকে ভয়ে নেমে পালিয়ে গেল।
শ্রীদামা রাধারাণীর ভাই। রাত্রে বাড়ি ফিরলে রাধারাণী সব শুনে ভাইকে তিরস্কার করে বলল,—”কৃষ্ণ হেরে গেলেও, তুই কখনও ঐ মোটা শরীর নিয়ে তার পিঠে চড়বি না। ওর কোমল অঙ্গ তোর ভার কি বহন করতে পারে? ফের যদি কোনদিন শুনি, তুই খেলায় হারিয়ে দিয়ে ওকে ঘোড়া করে পিঠে চড়েছিস—তাহলে তুই সেদিন আমার মরা মুখ দেখবি।” বলতে বলতে রাধারাণী কেঁদে ফেলল।
শ্রীদামা ভেবে পায় না কানুকে ঘোড়া করে পিঠে চড়লে দিদি অত রাগ করে কেন? ব্রজের খেলার মাঠে শ্রীদামা দিদির কাছে বকুনি খাওয়ার পর আর কোনদিন জিতেছে কিনা সে খবর আমাদের জানা নেই। মনে হয় জিতলেও সে খবর রাধারাণীর কাছে গোপন রাখা হত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন