হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে একখানি ছোট্ট কুটির। এই কুটিরে বাস করেন বিদুর ও তৎপত্নী সুলভা। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ও অমাত্য। সমগ্র মহাভারতে তিনি ধর্মাত্মা রূপেই পরিচিত। তৎপত্নী সুলভাও স্বামীর মত ধর্মপ্রাণা। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে—এমন সময়ে একদিন শ্রীকৃষ্ণ এলেন শান্তির প্রস্তাব নিয়ে কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। মহাত্মা বিদুর কৃষ্ণ আগমনের সংবাদ পেয়ে আনন্দে পত্নীকে বললেন—কৃষ্ণ কুরুরাজ ও পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে শান্তিস্থাপনের ব্যাপারে কথা শেষ করে আমাদের গৃহে পদার্পণ করবেন ও আতিথ্য গ্রহণ করবেন। তুমি কৃষ্ণের জন্য যথোপযুক্ত সেবার ব্যবস্থা করে রেখ।
স্বামীর কাছে কৃষ্ণ আসার কথা শুনে বিদুর পত্নীর সারা শরীর-মন-প্রাণ আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তিনি ঘর-প্রাঙ্গণ সমস্ত কিছু গোময় দ্বারা ধৌত করে সুন্দর করে পত্রপল্লব দ্বারা সাজিয়ে রাখলেন। অনন্তর শ্রীকৃষ্ণের আহারের জন্য কী কী রান্না করবেন এই ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন সুলভা। কৃষ্ণ আগমনের সংবাদে হৃদয় তাঁর আনন্দে বিভোর। তিনি স্নানের জন্য গৃহপ্রাঙ্গণস্থিত কূপের নিকট উপনীতা হয়ে ব্যস্তচিত্তে স্নানে মনোনিবেশ করলেন। স্নান করছেন আর হৃদয়ে ভাবছেন হৃদয়েশ্বর কৃষ্ণের কথা। হৃদয়ে কৃষ্ণরূপ ধ্যান করতে করতে তিনি ভাববিহ্বলা হয়ে পড়লেন। এমন সময়ে বাইরের দরজায় মৃদু করাঘাত! বিদুরপত্নী তন্ময়ভাবে জিজ্ঞাসা করেন—কে?
প্রত্যুত্তরে দরজায় করা ঘাতকারী বলেন—”মা, দরজা খোল, আমি এসেছি।”
বিদুরপত্নী কৃষ্ণকণ্ঠ শুনেই আলুথালু বেশে সিক্ত বসনেই ছুটে গেলেন দরজার কাছে। দরজা খুলতেই সেই নয়নাভিরাম ভুবনভুলানো শ্রীমুখের দর্শন হতেই আনন্দ আবেশে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলেন শ্রীকৃষ্ণরূপ—মাধুরী। কৃষ্ণরূপ দেখতে দেখতে আত্মবিস্মৃতা হয়ে ভুলে গেলেন তিনি কৃষ্ণকে আহ্বান জানাতে। তা লক্ষ্য করে কৃষ্ণ বললেন—”মা-মাগো আমি এসেছি তোমার কাছে, খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমায় কিছু খেতে দাও।’ কথাগুলি বলে কৃষ্ণ নিজেই বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এবং নিজহাতে একখানি আসন সংগ্রহ করে তাতে উপবেশন করলেন। উপবেশনের পর পুনরায় বিদুরপত্নীকে লক্ষ্য করে বললেন—”কি গো মা আমায় কিছু খেতে দেবে না? আমার যে খুব ক্ষিধে পেয়েছে।’
কৃষ্ণের কথায় সম্বিৎ ফিরে পান বিদুরপত্নী। ভাবেন তাই তো কি খেতে দিই কৃষ্ণকে? এখনো যে রান্না হয়নি। সবে স্নান শেষ হয়েছে মাত্র। ভাবতে ভাবতে বিদুর পত্নীর সহসা মনে পড়ে ঘরের অভ্যন্তরে রাখা পাকাকলাগুলির কথা। তিনি দ্রুতপদে ঘরে প্রবেশ করে কলার ছড়া হাতে নিয়ে বাইরে এসে শ্রীকৃষ্ণের কাছে উপবেশন করে কৃষ্ণকে কলা খাওয়াতে শুরু করেন। শ্রীকৃষ্ণকে আজ নিজের হাতে খাওয়াবেন এই ভাবনায় বিদুর পত্নীর জগৎ সংসার এমনকি দেহজ্ঞান পর্যন্ত ভুল হয়ে যায়। আনন্দ ভাব—বিহ্বল চিত্তে তিনি শ্রীকৃষ্ণের মুখে কলা ছাড়িয়ে কলার খোসাটা তুলে ধরেন—শাঁসটা ফেলে দেন। কৃষ্ণ পরমানন্দে কলার খোসা চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকেন। বিদুরপত্নী জিজ্ঞাসা করেন,—”কলা মিষ্টি আছে তো?” কৃষ্ণ বলেন,—’খুব মিষ্টি। এতো মিষ্টি কলা এর আগে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না’।
ভক্তের অন্তরের ভাব আস্বাদনে ভগবান ও জানেন না তিনি কি খাচ্ছেন। সহসা প্রবেশ করেন বিদুর। তিনি গৃহমধ্যে প্রবেশ করে কৃষ্ণকে ঐভাবে কলার খোসা খাওয়ানো হচ্ছে দেখে বিস্মিত হলেন। পত্নীর দিকে চেয়ে বিদুর বললেন,—’সুলভা তুমি কৃষ্ণকে একি খাওয়াচ্ছো? বিদুর পত্নীর হাত থেকে কলার ছড়াটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,—’যাও, তুমি ভিতরে গিয়ে ভিজে কাপড় বদলিয়ে এসো। আমি ততক্ষণ খাওয়াতে থাকি।’
সুলভা স্বামীর কথায় চমকে ওঠেন। সম্বিত ফিরতেই তিনি দেখেন যে তিনি কৃষ্ণকে এতক্ষণ ধরে কলার খোসা খাওয়াচ্ছিলেন সিক্ত বসন পরিধান করে। স্বামীর কথায় লজ্জাবনতা হয়ে ঘরের অভ্যন্তরের প্রবেশ করলেন বসন বদলানোর জন্য। ইত্যবসরে বিদুর কৃষ্ণের কাছে বসে কৃষ্ণকে কলা খাওয়াতে শুরু করেন। তিনি খোসা ছাড়িয়ে একটি কলা শ্রীকৃষ্ণের হাতে দেন। শ্রীকৃষ্ণ তা খেয়ে বিদুরের দিকে চেয়ে বলেন—”তাত! এই কলায় সেই মধুর স্বাদ নেই—যা মায়ের হাতে খাওয়ানো কলার খোসায় ছিল।’
শ্রীকৃষ্ণের মুখে এই কথা শুনে বিদুরের দুনয়ন অশ্রুতে ভরে ওঠে। তিনি কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলেন—তোমার কোন স্বাদ প্রিয় লাগে তা আমি জানি কিন্তু আমার পত্নীর হৃদয়ে তোমার প্রতি যে স্নেহ প্রীতি আছে তা আমি কোথায় পাবো? আমার হৃদয়ে আসন্ন যুদ্ধের দুশ্চিন্তা। আমার পত্নীর হৃদয় জুড়ে শুধু তোমার আনন্দঘন রূপের চিন্তা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন