একদিন শ্রীকৃষ্ণ সখাগণের সঙ্গে গোচারণ করতে করতে ব্রজমণ্ডলস্থিত অধুনা পখরপুর নামক গ্রামের নিকট উপস্থিত হলেন। পথশ্রমে সখারা ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত। কিন্তু গ্রামের আশেপাশে কোথাও জলের সন্ধান না পেয়ে তারা অবশেষে কৃষ্ণকে বললেন—’কানু আমাদের প্রবল জলতৃষ্ণা পেয়েছে তুই আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ কর।’ সখারা জলপিপাসায় কাতর শুনে শ্রীকৃষ্ণ কটিদেশে গুঁজে রাখা মুরলীটি হাতে তুলে নিয়ে তাতে মধুর তান তুললেন। মুরলীর সুরলহরীর প্রভাবে সেখানে একটি জলপূর্ণ পুষ্করিণীর সৃষ্টি হল। সখারা সেই পুষ্করিণীর মধুর জলপান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। বাঁশীর তানে যে স্থানে পুষ্করিণীর সৃষ্টি হয় পরবর্তীকালে সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। কৃষ্ণস্মৃতি বিজড়িত জনবসতির নাম হয় পখরপুর। এই পখরপুর হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত কামরগ্রাম। ‘কামর’ শব্দের অর্থ ওড়না বা উত্তরীয়। শ্রীকৃষ্ণ গোচারণ করতে করতে একদিন এইস্থানে আসেন। পথে সখাগণ শ্রীকৃষ্ণের স্কন্দদেশ হতে কৌতুক করার জন্য উত্তরীয়টি অপহরণ করে লুকিয়ে রাখেন। গোচারণের মাঠে শ্রীকৃষ্ণ প্রায়ই নিজের উত্তরীয়টি হয় গাছের শাখায় নয়তো বা কোন তরুতলে স্কন্ধ হতে নামিয়ে রাখতেন। গোধূলি বেলায় যখন ধেনুর দলসহ গৃহাভিমুখে রওনা হতেন তখন দেখতেন কাঁধে তার উত্তরীয় নেই। তিনি তখন বলরামের কাঁধ থেকে নীল উত্তরীয়টি টেনে নিয়ে নিজের কাঁধে রাখতেন। সখারা বলতো—’কানু তুই দাউ-দাদার উত্তরীয় নিয়েছিস কেন?
—’কে বলল এটা দাউ-দাদার উত্তরীয়, এটা তো আমার।’
—দেখ কানু, মিথ্যা বলিস না, তোর উত্তরীয়ের রঙ পীত, দাউ-দাদার নীল, ভালো করে দেখ ওটা কার?
—আরে দাদার উত্তরীয় মানেই আমার উত্তরীয়। আমি আর দাদা কি আলাদা?
—দেখ কানু, তুই প্রতিদিন নিজের উত্তরীয় এখানে ওখানে ফেলে রাখিস নয়তো হারাস। পরে উত্তরীয়ের কথা মনে না পড়লে এর-ওর নিয়ে টানাটানি করিস। এই তো সেদিন ভদ্র-র [এক সখার নাম] উত্তরীয়টা কাঁধে রেখে বলেছিলি আমার। পরের দ্রব্যকে নিজের দ্রব্যবলা কি ঠিক?
—আমি কি তোদের থেকে আলাদা, তোদের সব দ্রব্যই আমার দ্রব্য। আবার আমার সবকিছুই তো তোদের। রাগ করিস না। ভুল করে না হয় ‘দাউ-দাদার’ টা নিয়ে ফেলেছি। ঠিক আছে আর কোনদিন এমন ভুল হবে না।’ গোচারণের মাঠে প্রায়ই শ্রীকৃষ্ণের উত্তরীয় হারানো নিয়ে সখাদের মধ্যে মধুর কলহ হত। তাই শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে কৌতুক করার জন্য সখারা কামর গ্রামে গোচারণে যাওয়ার পথে উত্তরীয়টি অপহরণ করে নেয়। শ্রীকৃষ্ণ সখাদের সঙ্গে গোচারণ করতে করতে কামর গ্রামের প্রান্তে উপস্থিত হয়ে একটি তরুতলে বসে শ্রীমুখকমল হতে শ্রমজল [ঘাম] মোছার জন্য কাঁধে হাত রেখে দেখেন উত্তরীয়টি নেই। তখন তিনি সখাদের জিজ্ঞাসা করেন তাঁরা কি কেউ তাঁর উত্তরীয়টি নিয়েছে? সখাদের মধ্যে একজন বলেন—’তুই রোজ রোজ উত্তরীয় হারাবি, আর আমাদের বলবি খুঁজে বের করে দিতে। আমরা গোচারণে এসেছি না তোর উত্তরীয় পাহারা দিতে এসেছি। তোর জিনিস তুই খুঁজে বের কর।’ শ্রীকৃষ্ণ এধার-ওধার উত্তরীয়টির সন্ধানে বিচরণ করেন কিন্তু কোথাও খুঁজে পান না। সখাদের ধেণু পাহারায় রেখে তিনি সারাপথ উত্তরীয়টি খুঁজতে থাকেন কিন্তু কোথাও না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে সখাদের কাছে ফিরে এসে বলেন—’নারে, কোথাও পেলাম না, যে পথ দিয়ে এখানে এসেছিলাম। সেই পথের সবটাই ঘুরে ফিরে এলাম—কোথাও উত্তরীয়টা পড়ে থাকতে দেখলাম না। কথাগুলো একটানা বলে শ্রীকৃষ্ণ গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তাঁর হতাশ মুখ দেখে সখারা বলেন—’কানু মন খারাপ করিস না। গোচারণে আসার আগে মনে হয় ওটা বাড়িতেই রেখে এসেছিস। চল ঘরে ফেরার সময় হল, ধেণু নিয়ে গৃহে ফিরে যাই।’ গোচারণ শেষে সখাসহ ধেণুর দল নিয়ে নন্দভবনে ফিরে আসেন কৃষ্ণ। মা যশোদা সারাদিনের শ্রমক্লান্ত গোপালকে আদর আপ্যায়নের জন্য কাছে এসে দেখেন—তাঁর নীলমণির কাঁধে আজ পীত-উত্তরীয়টি শোভা পাচ্ছে না। তিনি গোপালকে জিজ্ঞাসা করেন—বাপ নীলমণি, তোমার উত্তরীয়টি কোথায়?
—গোপাল মনে মনে ভাবছে, যদি বলি হারিয়ে গেছে তাহলে মা বকবে।
কারণ উত্তরীয় হারানো নিয়ে সখারা প্রায়ই মাকে নালিশ করে। মা অন্যদিন মৃদু তিরস্কার করে চুপ হয়ে যান বিশেষ কিছু বলেন না। কিন্তু আজ যে উত্তরীয়টি হারিয়েছি মা তা এক পণ্যব্যবসায়ীর কাছে ক্রয় করে নিজের হাতে তাতে নকশা রচনা করে দিয়েছিলেন তাঁর নীলমণিকে সুন্দর দেখাবে বলে।” গোপালকে চিন্তান্বিত দেখে যশোদা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন—চুপ রইলে কেন? উত্তর দাও উত্তরীয় কোথায়?
—মা, গোচারণের মাঠে সখাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার সময় কদমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। খেলার সময় অন্যমনস্ক ছিলাম, মনে হয় সেই ফাঁকে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে।
—ভালো করে খুঁজে দেখেছ—হাওয়ায় উড়ে গিয়ে দূরে কোথাও পড়েনি তো?
—না মা, দূরে কোথাও পড়েনি। আমার মনে হয় ওটা চুরি হয়ে গেছে।
—সখাদের সব জিজ্ঞাসা করেছ, তারা কেউ দেখেনি কোথাও পড়ে থাকতে?
—খেলা শেষ হতে ভদ্রকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার উত্তরীয়টা কোথায় জানিস? ও বলল হাওয়ায় উড়ে যমুনার জলে পড়ে ভেসে গেছে। বলতে বলতে হঠাৎ শ্রীকৃষ্ণ কেঁদে ফেলেন। মা গোপালের কান্না দেখে গোপালকে বুকে চেপে ধরেন। গোপাল মায়ের বুকে মাথা রেখে উত্তরীয়টির জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। মায়ের হাতের নকশা করা উত্তরীয় গোপালের বড়ই প্রিয়—তা হারিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই মা খুব দুঃখ পেয়েছে। ইত্যবসরে শ্রীদামা-অপহরণ করা উত্তরীয়টি যশোদার হাতের তুলে দিয়ে ইশারায় বলেন—চুপ! যেন কানু জানতে না পারে। যশোদা মুচকি মুচকি হাসেন—ছেলে ও ছেলের সখাদের কাণ্ডকারখানা দেখে। উত্তরীয়টি যে নীলমণির সখারা লুকিয়ে রেখেছিল মজা করার জন্য তা বুঝতে যশোদার বিলম্ব হল না। তিনিও তখন গোপালকে নিয়ে আরও একটু মজা করার জন্য বললেন—”সুবল তুমি জান গোপালের উত্তরীয় কোথায়? সুবল বলে—মা গো কী বলবো—গোপাল যে পদ্মসুরভী গাভীটির দুধ খেতে ভালোবাসে, সেই গাভীটি গোপালের উত্তরীয়টি খেয়ে ফেলেছে।” তা শুনে গোপাল মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে চেয়ে বলে—মা, পদ্মসুরভীর অসুখ করবে না তো?
—দূর বোকা ছেলে, গাভী কখনও বস্ত্র খায়?
—মা আগামীকাল যখন গোচারণে যাবো, তখন তুমি আমাকে আর একটা ঐরকম উত্তরীয় দেবে?
—কেন ঐরকম উত্তরীয় চাইছ?
—ওতে যে তোমার ছোঁয়া লেগে আছে। মাঠে ধেণু চরাতে চরাতে মনে হয় তুমি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছ।
গোপালের কথা শুনে যশোদার নয়নে অশ্রু দেখা দেয়। তিনি নীলমণির মুখের দিকে চেয়ে বলেন,—’আগামীকাল নয়, আমি আজই তোমাকে ঐরকম একখানা উত্তরীয় দেব কিন্তু একটা শর্ত।
ব্যাকুল নয়নে গোপাল জিজ্ঞাসা করেন,—’কি শর্ত মা?’
—সখাদের মাঝে দাঁড়িয়ে তোমাকে নৃত্য করতে হবে। বল রাজী?
গোপাল সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে—সখাদের মধ্যমণি হয়ে মোহননৃত্য শুরু করে। নৃত্যশেষে যশোদা দেন উত্তরীয় পুরস্কার। গোপাল ভাবে আর একটা নতুন উত্তরীয় পেলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন