ব্রজের মাঠে ধেণুগুলি নব তৃণ চর্বন করতে করতে মনের সুখে বিচরণ করছে। তা দেখে সখাগণ কৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয়ে উঠল। সুবল বলল, আয় সবাই চোর-চোর খেলি।’ সুদাম বল, ‘চোর-চোর তো খেলবি কিন্তু চোর হবে কে?’ রাধারাণীর ভাই কানুর সখা শ্রীদামা বলে,—’চোরের রাজা কানাই থাকতে অন্যজনের চোর সাজার প্রয়োজন কি?’ ভদ্র বলে, ‘তাহলে কানাই তুই চোর হয়ে লুকিয়ে পড় আমরা তোকে খুঁজে বের করে ধরে আনবো।’ বলরাম বলে—’কানাই চোর হয়ে লুকোলে, ওকে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। ও ইচ্ছে করে ধরা না দিলে কেউ-ই ওকে ধরতে পারে না।’ কানাই বলে—’ও নিয়ে তোরা চিন্তা করিস না। আমি চোর হয়ে লুকোলে তোরা যদি খুঁজে না পাস কিংবা যদি আমায় খুঁজতে খুঁজতে তোরা ক্লান্ত হয়ে পড়িস—তাহলে আমি নিজেই ধরা দিয়ে দেব। এখন তোরা চোখ বন্ধ কর—আমি তোদের শৃঙ্গ, বেত, উত্তরীর চুরি করে নিয়ে লুকিয়ে পড়ি।’
কৃষ্ণের কথায় বলরামসহ গোপসখারা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে পড়ে। কৃষ্ণ তাদের বেত, শৃঙ্গ, উত্তরীয় ইত্যাদি নিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়ল। কিছুক্ষণ পর গোপসখারা চোখমেলে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে কৃষ্ণকে খুঁজতে আরম্ভ করল। খুঁজতে খুঁজতে তারা শুনতে পেল দূরের বনে বংশীধ্বনি হচ্ছে। সখারা বলরামসহ সেইদিকে ছুটল। কিন্তু যে বন থেকে বংশীধ্বনি ভেসে আসছিল সেখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কৃষ্ণকে ধরা গেল না। পরক্ষণেই আবার অন্যবনে বংশীধ্বনি শোনা গেল কিন্তু সেখানে গিয়েও কৃষ্ণকে পাওয়া গেল না। ভাইয়াকে না পেয়ে বলরাম শঙ্কিত হয়ে উঠল। সখাদের সে বলল—’ভাইকে কেন তোরা মিছিমিছি চোর সাজালি। এখন যদি সে বনে হারিয়ে যায় তাহলে বাড়ী ফিরে গিয়ে যশোদা মাকে মুখ দেখাব কেমন করে? ভাইকে না দেখতে পেলে বড়মা, ছোটমা দুজনেই খুব কাঁদবে। নন্দবাবাও মুষড়ে পড়বে।’ বনে মনে বাঁশীর সুর শুনে ও অনেক ছুটোছুটি করেও যখন কৃষ্ণকে পেল না তখন সবাই হতাশ হয়ে একটি বৃক্ষের তলে উপবেশন করল। বলরাম কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,—’কা-না-ই, প্রাণাধিক ভাই আমার-আর লুকিয়ে না থেকে বেরিয়ে পড়, তোকে না দেখে আর থাকতে পারছি না।’
—”দাউদাদা, আমি এখানে”—বলেই কৃষ্ণ সহসা বনের বৃক্ষের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এল।” কানাইকে দেখতে পেয়ে সবার বুকে যেন প্রাণ ফিরে এল। বলরাম কৃষ্ণকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল—’ভাই কানু, আর তোকে চোর হয়ে লুকোতে দেব না।’
তখন কৃষ্ণ বলল,—’তাহলে দাউদাদা, এস আমরা সবাই এখন একটা নতুন খেলা শুরু করি।’—’কি খেলা?’—সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করল।
—তোদের মধ্যে কেউ একজন আমার চোখ বেঁধে দে। তারপর আমি যখন চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকবো তখন তোরা সব একে একে এসে আমাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করবি—আর ও অবস্থায় যে স্পর্শ করবে আমি তাঁর নাম বলে দেব। যদি ঠিক হয় তাহলে তাঁর চোখ আমার মতো বাঁধা পড়বে, এবং তাঁকেও সব একের পর এক হাত দিয়ে স্পর্শ করতে থাকবে। সেও সবার নাম বলতে বলতে যার নাম ঠিক বলবে তখন তার চোখও বাঁধা হবে। এইভাবে খেলা চলতে থাকবে।
—বাঃ খুব সুন্দর খেলা তো—ভদ্র বলে ওঠে।
সুবল কৃষ্ণের চোখ উত্তরীয় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল, যাতে সে দেখতে না পায়। তারপর খেলা আরম্ভ হল। তোক-কৃষ্ণ কৃষ্ণকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে, গলার স্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করে—’আমি কে? বলতো কানাই?’
সরল কানাই বলে—’কে আবার! তুই?’
—’তুই বললে তো হবে না ভাই, নাম বলতে হবে’।
কৃষ্ণ বলে—’নাম ; না-আ-ম—আচ্ছা তুই বল না তোর নাম কি?’
—’আমি তোককৃষ্ণ।’
—’দূর বোকা নাম বলে দিলি?’ ভদ্র ঝাঁঝিয়ে উঠল তোককৃষ্ণ’র ওপর।
—’আচ্ছা কানু, এবার বল তো, তোকে কে ছুঁয়ে দিল।’
—’মধু-মধুমঙ্গল।’ কৃষ্ণ-চোখ বাঁধা অবস্থায় উত্তর দেয়।
—সখারা সমস্বরে বলে উঠে—’ঠিক! ঠিক! ঠিক!’
এবার মধুমঙ্গলের চোখ বেঁধে দিল কৃষ্ণ। সে কানাইয়ের কানে কানে ফিস ফিস করে বলে ‘তুই যখন আমাকে স্পর্শ করবি তখন নামটা যেন চুপিচুপি বলে দিস।’
—’না ভাই, তাহলে খেলার মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে। বন্ধুরা সব রাগ করবে।’
—’কিন্তু আমি যে ছেলে মানুষ, সরল বোকা ব্রাহ্মণ সন্তান।’
মধুমঙ্গলের কথা শুনে সখারা টিপ্পনী কেটে বলে—’আহা-আহা মরে যাইরে। বাছা আমাদের ছেলেমানুষ, ধেড়ে মরদ! আর ক’দিন পর গোঁফ গজাবে। চোখ বাঁধতে যদি অতভয় তবে কাল থেকে আমাদের সাথে মাঠে আসবি না। আমরা তোকে খেলতেও নেব না। যা ভাগ এখান থেকে।
কৃষ্ণ বলল, ‘তোরা ওকে বকিস না ভাই। দেখছিস না ওভয়ে কেমন জড় হয়ে গেছে। মধুমঙ্গল কাছে আয়, তোর চোখ খুলে দিই।’
কানু মধুমঙ্গলের চোখের বাঁধন খুলে দেয়। মধুমঙ্গল বলে—’এতক্ষণ তোকে না দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল রে কানু!’ কৃষ্ণ সে কথায় কান না দিয়ে বলরামকে বলল,—’দাউদাদা, তাহলে তোমার চোখ বেঁধে দি।’
—’নারে ভাই তুই আমার চোখ বাঁধিস না।’
—’কেন?’
—’তাহলে যে তোকে দেখতে পাব না।’
সুবল-সুদাম, ভদ্র সবাই বলে—’তাহলে এ খেলা বাদ দিয়ে নতুন খেলা শুরু কর।’
কৃষ্ণ বলে—’কি খেলা খেলব তোরাই স্থির কর।’
সবাই আলোচনা করে স্থির করে রাজা-প্রজা খেলা হোক।
কৃষ্ণ বলে—’বেশ তাই হোক কিন্তু রাজা সাজবে কে?’
ভদ্র বলে—’কানাই, তুই আমাদের রাজা।’
কৃষ্ণ বলে—’দূর বোকা! বড় দাদা-দাউজী থাকতে ছোটভাইকে কি রাজা হওয়া সাজে? দাউ-দাদা রাজা হোক—আমি হব সেনাপতি।’
বলরাম বলে—’না, কানু, তুই রাজা হ, আমি সেনাপতি সাজি।’ বলরামের কথা শেষ না হতেই সখাগণ সমস্বরে চীৎকার করে বলে ওঠে ”কানু, তুই আমাদের রাজা হ’, রাখালরাজা। আমরা কেউ হব কোটাল, কেউ হব প্রজা।’ সবার অনুরোধে কানাই রাজা সাজতে বাধ্য হয়।
কদমতলায় মাটির ঢিপি তৈরী করে সিংহাসন তৈরী করা হল। বন থেকে ফুলপাতা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে তা দিয়ে তৈরী হল রাজমুকুট। গোচারণের যষ্টি হল রাজদন্ড। বলরাম উত্তরীয় দিয়ে ছত্র তৈরী করে রাজার মাথায় ধরল। অন্যসব সখারা বনফুলের মালা গেঁথে রাখাল রাজার গলায় পরিয়ে দিল। নবরাজ-বেশে কৃষ্ণচন্দ্র মাটি দিয়ে নির্মিত সিংহাসনে আরোহন করল। কোটাল বেশে ভদ্র, উচ্চরবে শৃঙ্গধ্বনি করে প্রজারূপী সখাদের সমবেত করল। চারণকবি—’বন্দীগণ—রাজার বন্দনাগীতি শুরু করল। উপস্থিত প্রজাবেশী তরুণগোপ কিশোররা বন থেকে নানা ফলমূল সংগ্রহ করে রাজাকে উপহার প্রদান করল। রাজা ফলমূল কিঞ্চিৎমাত্র গ্রহণ করে উপস্থিত প্রজাদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করল।
সবশেষে বসল বিচার সভা। যারা অপরাধী তাদের দণ্ড প্রদান করা হবে। প্রহরীবেশী একজন সখা, জনৈক সখারূপ অপরাধীকে লতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, রাজার সম্মুখে হাজির করে বলল,—’মহারাজ এ আপনার বিনানুমতিতে গাছ থেকে পাকা আমলকী পেয়ে খেয়েছে,’ রাজা হুকুম দিল,—’ওকে চ্যাঁংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে যমুনার যেখানে অল্প জল আছে সেখানে নিক্ষেপ কর।
রাজাদেশে প্রহরীরা তাঁকে চ্যাঁংদোলা করে তুলে নিয়ে যায় যমুনার জলে নিক্ষেপের জন্য। প্রহরী দ্বিতীয় অপরাধীকে উত্তরীয় দ্বারা বন্ধন করে রাজার সম্মুখে পেশ করল।
রাজা প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করল,—’এর অপরাধ কি?’
—’মহারাজ এ গোচারণে ফাঁকি দিয়ে গাছের নীচে শুয়েছিল।
—’একে যমুনার তপ্ত বালুকনায় দুদণ্ডের জন্য শুয়ে থাকার দণ্ড দিলাম।’
এইভাবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কোন অপরাধীকে বন থেকে ফল সংগ্রহ করে আনার শাস্তি প্রদান করছে, কাউকে বলছে—বসে বসে পুষ্পমালা রচনা কর। কাউকে বলছে দোনা (পাতার তৈরী ঠোঙা) ভর্তি করে যমুনা থেকে জল আনয়ন কর। কাউকে রাজ সন্নিধান হতে কয়েক মুহূর্তের জন্য নির্বাসন দণ্ডপ্রদান করা হচ্ছে—এর চেয়ে কঠোর সাজা বৃন্দাবনের বনরাজ্যে অপরাধীদের দেওয়া সম্ভব ছিল না। খেলতে খেলতে সূর্য্যদেব মধ্যাহ্নগগনে উদিত হলে মা যশোদার নির্দেশে সেবিকারা মধ্যাহ্নকালীন ভোগ নৈবেদ্য নিয়ে উপস্থিত হলে রাজসভা ভেঙ্গে যেত। সকলে যমুনার শীতল সলিলে অবগাহন করে যশোদা ও অনান্য ব্রজময়ীদের প্রেরিত সুস্বাদু-উপাদেয় ভোগ গ্রহণ করে মধ্যাহ্ন ভোজন সমাধা করে কোন ছায়াঘন বৃক্ষতলে পত্রশয্যা রচনা করে তার উপর রাজাকে শুইয়ে দিত। বলরাম গাছের ভগ্ন ডাল দিয়ে রাখালরাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে ব্যজন করত। ভদ্র সুবলাদি অন্যসখারা পর্যায়ক্রমে মহারাজের হস্তপদ কিছুক্ষণ মর্দন করে নিকটেই উত্তরীয় বিছিয়ে শুয়ে পড়তো। অপরাহ্নের পড়ন্তবেলায় সখারা ম্রিয়মান হয়ে পড়ত—রাখালরাজের সঙ্গে রাত্রিকালীন ভাবী বিচ্ছেদের আশঙ্কায়। বেলা পড়লেই তারা সূর্য্যের দিকে বিষণ্ণ নয়নে চাইত। কানুর অগোচরে সূর্য্যের দিকে চেয়ে তাঁরা প্রার্থনা করত—”হে দেব দিবাকর, আর কিছুক্ষণ গগনে বিরাজ কর। আমরা কানুর সাথে আর একটু খেলা করি। তুমি অস্ত গেলে রাত্রি নামবে ব্রজের বুকে। কানুকে ছেড়ে সারা রাত আমরা নিদ্রাহীন চোখে বিছানায় পড়ে পড়ে ছটফট করি তা কি তুমি দেখতে পাও না?”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন