গোঠের মাঠে একঝলক

নন্দলালা ধেণু চরাতে যায় সখাদের সঙ্গে। কখনও গিরিগোবর্ধনের প্রান্তে, কখনও যমুনা তীরস্থিত বৃন্দাবনের বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। বাড়িতে নন্দলাল থেকে মা যশোদা, রোহিনী ও নন্দবাবার শাসনছায়ায় কিন্তু গোচারণের মাঠে দাদা বলরাম সঙ্গে থাকলেও সখা ভদ্রসেনের শাসনাধীনে থাকে দুরন্ত কানাই।

ভদ্রসেন ব্রজরাজ নন্দকুমারের ছোটভাই নন্দনজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ছোটপুত্রের নাম স্তোক কৃষ্ণ, ভদ্রসেনের মায়ের নাম অতুলা। কিন্তু ভদ্রসেন নন্দযশোদাকেই মা ও বাবা বলে ডাকে কানাই-এর মতো। কারণ সে ছোটবেলা থেকেই নন্দ যশোদার কোলে মানুষ হয়েছে। তাই কানাই যাকে যা বলে সে তাই বলে। এমনকি সে নিজের ছোট ভাইকেও পরিচয় দেয়, কানাই-এর মতো কাকার ছেলে বলে।

যাই হোক গোচারণের মাঠে ভদ্রসেনের যত চিন্তা কানাইকে নিয়ে। কানাই বড় চঞ্চল, দুরন্ত ও জেদী। কোমল শরীর বড় দূর্বল। দূর্বল সুকুমার কানাই-এর জন্য ভদ্রসেন সবসময় চিন্তান্বিত। দূরন্ত কানাই কখন কি করে বসে ঠিক নাই। তাই সবসময় সে কানাইকে চোখে চোখে রাখে। কানাই ভদ্র-র চেয়ে বয়সে কয়েকমাসের ছোট। মাঠে গিয়ে কানাই আকাশে পাখী উড়তে দেখলেই তার ছায়ালক্ষ্য করে ছুটতে থাকে, কখনও বা কোন খরগোশ কিংবা হরিণ দেখলে তার পিছু পিছু ছুটে যায়। আবার যখন সখাদের সঙ্গে খেলা করতে থাকে তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তির বোধ পর্যন্ত কানাই-এর হয় না। খেলতে খেলতে রৌদ্রতাপে কানাই-এর মুখ পুড়ে লাল হয়ে যায়—সেদিকেও তার নজর নাই। তাই ভদ্রকেই সবদিক সামলাতে হয় ভদ্রসেনের বলিষ্ঠ শরীর। বাবার মতো সেও মল্লবীর। কানাইয়ের মতো সেও পীতবসন পরে—কিন্তু উত্তরীয় তার বলরামের ন্যায় নীল। কখনও কখনও তার উত্তরীয় বলরামের সঙ্গে বদলও হয়ে যায়। বলরামের মতো সেও মাথায় হাঁসের পালক গুঁজে নেয়। কানাইয়ের সখাদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় মধুমঙ্গল। কিন্তু সে ব্রাহ্মণের ছেলে, সে গরু চরাতে আসে না, আসে খেলতে। বলরাম সবার চেয়ে বড়, বিশাল, অর্জুন, ঋষভ, বরুথপ, শ্রীদাম-এরা সবাই ভদ্রর চেয়ে বড় কিন্তু বলরামের চেয়ে ছোট। এদের মধ্যে বড় ছোটর পার্থক্য কেবলমাত্র কতিপয় দিনের। অংশু, তেজস্বী, স্তোককৃষ্ণ, দেবপ্রস্থ, কানাইয়ের চেয়ে ছোট। কানাই মাঝে মাঝে নিজের গায়ের উত্তরীয় এখানে ওখানে ফেলে আসে। কোথায় ফেলেছে মনে থাকে না—তাই ভদ্রর কাঁধের উত্তরীয় টেনে নিয়ে নিজের কাঁধে রেখে দেয়। তা দেখে ভদ্র বলে—কি রে আমার উত্তরীয় নিলি যে?

—কানাই বলে, ‘এটা তোর নয় আমার।’

—তোর উত্তরীয় তো পীতবর্ণের, নীল তো তুই গায়ে পরিস না?

—তাতে কি হয়েছে? পরি না এখন পরলাম। তাছাড়া এটা আমার না হোক দাদার তো বটে—দাদা তো নীল উত্তরীয় পরে।

কানাই কখন কি যে চায়, কি যে পরে—কি যে করে কিছুই বোঝা যায় না। গোচারণের মাঠে একদিন হয়েছে কি কতকগুলি ঝরা ফুল ও পতিত ফল দেখে কানাই জেদ ধরেছে এই ফুল ও ফলগুলিকে আবার গাছের ডালে আগের মতো লাগিয়ে দিতে হবে। সখারা কেউ কানাইকে বুঝিয়ে পারছে না যে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু কানাই কারও কথা শুনতে রাজী নয়। কানাই ভদ্রকে লক্ষ্য করে বলে—তুই তো এটা করতে পারিস, তাড়াতাড়ি কর নইলে আমি তোদের সঙ্গে খেলবো না-খেলবো না-খেলবো না, এক্ষুণি বাড়ি গিয়ে মাকে বলবো তোরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস।

বেচারা ভদ্র কি করবে ভেবে না পেয়ে বলে—আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি কী করা যায়। ভদ্র কোনরকমে গাছে উঠে ফুলগুলিকে কাঁটায় গেঁথে লাগিয়ে দেয়। পতিত ফলগুলিকে কোনরকমে গাছে আটকে রাখে। কানাই তখনকার মতো শান্ত হয়। কিছুক্ষণ পর একটি খরগোশ আসে—এসে কানাইয়ের পা শুঁকতে থাকে। ভদ্র বলে কানাই খরগোশ তোর কাছে ফল চাইছে—তুই ওকে ফল খেতে দে। নইলে ও তোর সঙ্গে ঝগড়া করবে। কানাই ভদ্রর কথা বিশ্বাস করে বলে আমাকে ফল এনে দে,—ভদ্র আবার গাছে উঠে সেই পতিত ফলগুলি পেড়ে এনে কানাইয়ের হাতে দেয়। কানাই ফলগুলি একটা একটা করে খরগোশকে খেতে দেয়। কানাই খরগোশকে জিজ্ঞাসা করে—কিরে তোর বুঝি খুব ক্ষিধে পেয়েছে—নে ফল খা। খরগোশ দুপায়ের ফাঁকে ফল চেপে ধরে খেতে থাকে। তা দেখে কানাইয়ের খুব আনন্দ হয়। বলে—খা খা যতখুশী খা। বলে বাকী ফলগুলি যেই খরগোশকে দিতে যায় অমনি ভদ্র কানাই-এর ফলশুদ্ধ হাত চেপে ধরে বাধা দেয়, বলে : ছোট্ট প্রাণী, ছোট্ট পেট, অত ফল খেলে রোগ হয়ে মরে যাবে যে?

ভদ্রকে যেমন কানাইকে সামলাতে হয় তেমনি মাঠের পশুর দিকে নজর রাখতে হয়। তবে সব থেকে বেশি নজর তার কানাই-এর প্রতি। কারণ কানাই যেখুব সুকুমার ও দুর্বল। ধেণু বা গাভী নিয়ে সখারা বনের কোন পথ ধরে যাবে তাও ঠিক করে ভদ্রসেন। বলরামকে যে যা বলে সে তাতেই হ্যাঁ দেয়। যদি কেউ বলে—আজ পূর্বদিকে চলো—বলরাম বলে—হ্যাঁ চলো। ধেণু নিয়ে কখন কোন পথে যাবে তা নিয়ে যদি সখাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়—তখন সবাই একসঙ্গে বলে—ভদ্রকে জিজ্ঞাসা করো ও যা বলবে তাই হবে। এরপর সবাই যখন ভদ্রকে জিজ্ঞাসা করে—আজ কোন পথে যাবো? ভদ্র বলে—দাঁড়া কানাইকে জিজ্ঞাসা করি। কানাইকে জিজ্ঞাসা করতেই কানাই বলে—যেদিকে তুই যাবি, সেদিকেই আমি তোর সাথে ধেনু চরাতে যাবো। ভদ্র তখন তার ইচ্ছামত একটা পথ ধরে ধেণু নিয়ে চলতে থাকে। সখারা জিজ্ঞাসা করে : কিরে আজ ঐ পথটা দিয়ে গেলি না যে।

ভদ্র উত্তর দেয়—ও পথে কাঁটা আছে, কাঁকর আছে—আমাদের কানাইয়ের কোমল পায়ে ব্যথা লাগবে। কাঁটা পাথরে ভরা পথে কি কানাইকে নিয়ে যাওয়া যায়? মা যশোদা, শ্রীদামের দিদি [রাধারাণী] জানতে পারলে কানাইকে আর আমাদের সঙ্গে আসতেই দেবে না। সখারা সব মেনে নেয় ভদ্রর কথা।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন