শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার অন্দরমহলে স্বর্ণপালঙ্কে পট্টমহিষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বার্তালাপ করছেন। কথায় কথায় রাধা ও গোপীদের প্রসঙ্গ উঠতেই কৃষ্ণের কমল নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তিনি গদগদ স্বরে পট্টমহিষীদের দিকে চেয়ে বললেন,—”গোপীরা জন্মজাত সন্ন্যাসী। সংসারে যাঁরা সাধুসন্নাসী হয় তাঁরা শুধু বস্ত্রের রঙ পরিবর্তন করে সাধুসন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে। কিন্তু আমার রাধাসহ ব্রজগোপীরা শরীর-মন-প্রাণরূপ বস্ত্রকে আমারই প্রেমের রঙে রাঙিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। রাধা আমার রাধা—শুধু প্রেম দিয়ে তৈরী। আমার সুখে সুখী হওয়াই গোপীদের একমাত্র কাম্য”—বলতে বলতে কৃষ্ণের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি শয্যায় বিবশ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। কৃষ্ণের দশা দেখে পট্টমহিষীরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। মনে মনে ভাবেন—’আমাদের সেবায় কী এমন ত্রুটি আছে যা প্রভুর পূর্ণ চিত্ত বিনোদনে সমর্থা নয়? রাধাসহ ব্রজগোপীদের সেবায় এমন কী মহৎ গুণ আছে—যাঁদের কথার প্রসঙ্গ উঠতেই প্রভু ভাবাবেশে তন্ময় হয়ে যান? যখনই কথায় কথায় রাধা গোপীদের প্রসঙ্গ ওঠে তখনই প্রভুর দুনয়ন কেন অশ্রুতে ভরে যায়? আমাদের কী এমন নেই যা রাধা, ব্রজগোপীদের আছে? রাধা-গোপীরা তো ব্রজের সামান্যা-গোয়ালিনী? তাঁদের প্রতি প্রভুর এত দূর্বলতা কেন? দ্বারকার পট্টমহিষী রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, ভদ্রা, মিত্রবিন্দা, সত্যা ও লক্ষণার মনে অভিমান বা অহংকার প্রবল হয়ে ওঠে। প্রভুর প্রতি তাঁদের প্রেম রাধা ও ব্রজগোপীদের চেয়ে অনেক বেশী। তবু প্রভুর দূর্বলতা কেন ঐ গোপীদের প্রতি?’ শয্যায় শায়িত কৃষ্ণ সহসা আর্তনাদ করতে থাকেন মহিষীদের ভাবনায় বিরতি পড়ে। তাঁরা ব্যাকুল হয়ে প্রভুকে জিজ্ঞাসা করেন,—’প্রিয়তম, আপনার কি হয়েছে? এমন আর্তনাদ করছেন কেন?’ কৃষ্ণ ব্যথা-কাতর স্বরে বললেন,—’মাথায় আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, উঃ মরে গেলাম! আর সহ্য করতে পারছি না। অবিলম্বে বৈদ্যকে সংবাদ দাও? মহিষীরা শ্রীকৃষ্ণের শিরঃপীড়া হচ্ছে শুনে চিন্তান্বিতা হয়ে পড়লেন। এমন সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন। মহিষীরা তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের শিরঃপীড়ার কথা জানাতেই, তিনি (নারদ) ভাবলেন—”শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় শরীরে রোগ? নিশ্চয়ই রোগের অজুহাতে প্রভু কোন নতুন লীলা নাটকের সূচনা করতে চলেছেন। নিজের ভাবনা গোপন করে তিনি শয্যায় কৃষ্ণসমীপে উপস্থিত হয়ে বললেন,—’দ্বারকায় কি কোন কুশল বৈদ্য নেই? আমি কি অশ্বিনীকুমারদের আহ্বান করে আনবো?’
—’নারদজী, প্রয়োজন বৈদ্যের নয়, প্রয়োজন ঔষধের, ঔষধ না মিললে বৈদ্য কি করবে?’
গুরুগৃহে অধ্যয়নের সময় আমি সমগ্র আয়র্বেদ শাস্ত্র শিক্ষা করেছি।—ব্যথা কাতর স্বরে কৃষ্ণ বললেন।
‘আপনি এসময় বেশী কথা বলবেন না। রোগ প্রশমনের জন্য ঔষধ কোথায় পাওয়া যাবে বলুন। নারদের পক্ষে ত্রিভুবনের কোন স্থান অগম্য নয়।’ নারদ অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠেন প্রভুর রোগ নিরাময়ের জন্য। দ্বারের বাইরে গরুড়কে দেখে ক্রোধ প্রকাশ করে বললেন,—”এখনও পর্যন্ত প্রভুর জন্য একটু ঔষধ সংগ্রহ করে দিতে পারলে না? তুমি কেমন সেবক হে?’
কৃষ্ণ বললেন—ওকে অনর্থক তিরস্কার করছেন দেবর্ষি। ঔষধ সর্বত্রই রয়েছে কিন্তু কেউ যদি না দেয় ও কি করবে?’
ইতিমধ্যে পট্টমহিষীরা সেবক পাঠিয়ে দ্বারকায় বৈদ্যরাজকে ডেকে নিয়ে এসেছেন। বৈদ্যরাজ কৃষ্ণকক্ষে প্রবিষ্ট হয়ে নাড়ী পরীক্ষা করলেন। শিরদেশে হাত রাখলেন, চক্ষু কর্ণ, জিহ্বা, সব পরীক্ষা করলেন। ঔষধও দিলেন। কিন্তু কোন উপশম হল না। বরং মাথার যন্ত্রণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। অসহায় হয়ে রাজবৈদ্য তখন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন,—’আপনার ইতিপূর্বে কখনও কি শিরঃপীড়া হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে তবে সেইসময় যে ঔষধ প্রয়োগ করে আপনার রোগ নিরাময় হয়েছিল সেই ঔষধের নাম কি আপনার মনে আছে?’
কৃষ্ণ বললেন,—’ঔষধের নাম তো মনে আছে কিন্তু ঔষধের অনুপান অমিল। রাজবৈদ্য, পট্টমহিষীগণ ও দেবর্ষি একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন—’ঔষধের অনুপান কি প্রভু?’
ব্যথা কাতরতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ রহস্যময় হাসি মিশিয়ে কৃষ্ণ বললেন,—’যদি কোন প্রেমিক ভক্ত তাঁর নিজের পায়ের ধুলো আমাকে দেয়, তবে সেই ধুলোর অনুপানে ঔষধ আমি নিজেই তৈরী করে মাথায় প্রলেপ দিলেই সুস্থ হয়ে যাব। গুরুগৃহে সন্দীপনজী আমাকে সমস্ত রকমের ঔষধ তৈরীর প্রণালী শিখিয়ে দিয়েছিলেন—ঔষধও আমার কাছেই আছে। এখন দরকার শুধু ঐ অনুপানের।’
ভক্তবৎসল, ভক্তপ্রাণ ভগবানকে ভক্তের অন্তরের পীড়াই ব্যথিত করে তাই ভক্তের চরণধূলির স্পর্শেই তিনি সুস্থ হন। রুক্মিণী, সত্যভামাদি পট্টমহিষীরা ঔষধের অনুপানের নাম শুনে বললেন—’চরণধূলি তো আমাদের সবার পায়েই লেগে রয়েছে। আমরা ওনার প্রেমী ভক্তও, এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু শাস্ত্র বলে পতি পরমগুরু। পতির মাথায় প্রলেপ দেওয়ার জন্য চরণধূলি দান করলে পাপ হবে, অনন্য নরকে বাস করতে হবে। সুতরাং চরণধূলি কেমন করে ওনাকে দেব?’
সত্যভামা রুক্মিণীকে বললেন—’আপনি আপনার চরণধুলি দিয়ে দিন দিদি!’
‘ওনাকে চরণধূলি দিয়ে কি অনন্তকালের জন্য নরকে যাব বোন?’ রুক্মিণী উত্তর দিলেন সত্যভামাকে। শ্রীকৃষ্ণকে চরণধূলি দিতে দ্বারকার ষোলহাজার একশ আট রানীদের মধ্যে কেউই রাজী হলেন না। পাপের ভাগী হতে কেউ রাজী নয়।
দেবর্ষি নারদ দেখলেন দ্বারকার মহারানীরা যখন চরণধূলি দিতে পারলেন না তখন কৃষ্ণের পুত্ররা এবং দ্বারকার প্রজারাও ধূলি দিতে সম্মত হবেন না। তিনি ভক্তের চরণধূলি সংগ্রহের জন্য ত্রিভুবন পর্যটনে বের হলেন। প্রথমে গেলেন স্বর্গে। দেখলেন সেখানে ভক্তই নেই, চরণধূলি দূরের কথা। যমলোকে উপনীত হলেন দেবর্ষি। যমরাজ করজোড়ে বললেন—’আমি কৃষ্ণচরণের এক ক্ষুদ্র অধম সেবক। আমায় মাপ করবেন দেবর্ষি।’ মহর্লোক, জনলোক, তপোলোকের ঋষি-মহর্ষিরা নারদের মুখে চরণধূলি দান করুন প্রভুর রোগ নিরাময়ের জন্য—’এই কথা শুনতেই সকলে কানে আঙুল দিয়ে বললেন—’শান্তম্ পাপম্। শান্তম্ পাপম্’। ব্রহ্মালোকে উপনীত হয়ে ব্রহ্মাজীকে বলতেই, তিনি নারদকে ধমক দিয়ে বললেন—”পুত্র নারদ, তুমি বড়ই দুর্বিনীত হয়েছ। পিতার কাছে এইরূপ অনুচিত প্রস্তাব রাখার আগে তোমার লজ্জা আসা উচিত ছিল। নারদ ব্যর্থ মনোরথে শিবলোকে গেলেন। শিবকে বলার আগেই সর্বজ্ঞা পার্বতীমা নারদকে বললেন—’তুমি এখান থেকে অন্যত্র যাও নারদ। এখানে তোমার প্রয়োজন পূর্ণ হবে না।’
মানুষ, দেবতা যখন কোন কিছু পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তখন স্থান-অস্থান, পাত্র-অপাত্র বিবেচনা করে না। দেবর্ষি নারদ তাই উর্দ্ধলোক থেকে অধঃলোকে উপনীত হলেন। বলি, প্রহ্লাদ ইত্যাদি ভক্তদের কাছে উপনীত হয়ে চরণধূলি দানের প্রস্তাব রাখতেই তারা বললেন—আমাদের হৃদয়ে তো ভক্তিই নেই, সুতরাং আমরা চরণধূলি দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাব কী করে? পৃথিবীতেও ঐ একই সমস্যা। যে ভক্ত সে স্বীকার করতেই চায় না যে সে প্রভুর ভক্ত। শ্রীকৃষ্ণ তো পরের কথা। মর্ত্যের ভক্ত দেবর্ষি নারদকে পর্যন্ত নিজের পায়ের ধূলি দিতে সাহস করে না—একথা ভাবতেই তাদের প্রাণ কেঁপে ওঠে। ত্রিভুবন পর্যটন করে ব্যর্থ নিরাশ হৃদয়ে দ্বারকায় ফিরে এলেন দেবর্ষি নারদ। কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে ক্রন্দন জড়িত কণ্ঠে বললেন—”ত্রিভুবনে কোন ভক্ত, আপনাকে তাঁদের পদধূলি দিতে রাজী হল না। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেও পদধূলি সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি।”
—’নারদজী আপনি পদধূলি সংগ্রহের জন্য ব্রজধামে গিয়েছিলেন?’ কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন।
—’ত্রিভুবনে কোথাও যখন মিলল না, তখন ব্রজে কি ঐ পদধূলি মিলবে?’ নারদ জিজ্ঞাসা করলেন।
—’মিলবে কী মিলবে না, তা জানি না, তবে একবার সেখানে যেতে তো দোষ নেই?’ কৃষ্ণ বললেন।
কৃষ্ণের কথায় নারদ বীণায় নামগানের ঝংকার তুলতে তুলতে ব্রজধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে যেতে যেতে নারদ ভাবছেন—”পদধূলি ব্রজরাজনন্দ হয়তো দিয়ে দেবেন, গোপসখারাও দিয়ে দিতে পারেন। ব্রজেশ্বরী মা যশোদা আমার মতো ঋষির হাতে পদধূলি দেবেন কী না দেবেন-এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে কিন্তু গোপীরা কোন ক্রমেই আমা হেন ঋষির হাতে পদরজঃ তুলে দিতে সাহসী হবেন না।” এইরূপ ভাবতে ভাবতে নারদ ব্রজধামে উপনীত হলেন। তাঁর শ্রুতিমধুর নাম সংকীর্তনের সুর গোপীদের কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করতেই তারা দ্রুত ছুটে এসে নারদের কাছে উপস্থিত হয়ে পর্যায়ক্রমে ভূমিলুণ্ঠিত হয়ে তাঁকে প্রণাম জানালেন। প্রণামান্তে দেবর্ষিকে তাঁরা সকলে ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন—’আপনি কোথা থেকে আসছেন দেবর্ষি?’
দেবর্ষি উত্তর দিলেন—’দ্বারকা থেকে।’
আমাদের প্রাণনাথের সব কুশল তো? রাধাসহ ব্রজগোপীরা জিজ্ঞাসা করলেন।
গোপীদের জিজ্ঞাসার কোন উত্তর না দিয়ে নারদ নতমুখে নীরব রইলেন। নারদকে বিষণ্ণ হয়ে মুখ নীচু করতে দেখে—রাধারাণী ও গোপীদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রিয়তম-প্রাণনাথের অজানা অনিষ্ট-আশঙ্কায় তাঁদের বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। প্রাণবল্লভের সমাচার জানবার জন্য তাঁরা আকুল হয়ে নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন,—”দেবর্ষি মৌন থেকে আমাদের প্রাণসংহারের চেষ্টা না করে বলুন, কেমন আছেন আমাদের ব্রজনাথ?”
নারদ মৌনভঙ্গ করে বললেন,—’আপনাদের ব্রজনাথের ভয়ানক ব্যাধি হয়েছে।’ ‘ব্যাধি’—এই শব্দটা কানে আসতেই রাধারাণী মূর্ছা যাবার উপক্রম হতেই ললিতাসখী তাঁকে ধরে অঙ্গ সংলগ্ন করে কোনরকমে প্রকৃতিস্থা করলেন। পরে গোপীরা পুনরায় দেবর্ষিকে জিজ্ঞাসা করলেন,—”ব্রজনাথ গোপবল্লভের কি ব্যাধি হয়েছে?’
—’অসহ্য শিরঃপীড়ায় তিনি শয্যাশায়ী’
কাতরস্বরে গোপীরা বললেন,—’দ্বারকায় কি কোন বৈদ্য নাই।’
—”দ্বারকা নগরীতে বৈদ্যের কোন অভাব নেই। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আয়ুর্বেদে পারদর্শী। ঔষধও তিনি জানেন এবং ওই ঔষধ সবার কাছেই আছে কিন্তু কেউ তা দিতে রাজী নয়। ঔষধের খোঁজে আমি ত্রিভুবন ঘুরেছি। সর্বত্র হতাশ হয়ে এখন এসেছি ব্রজধামে তোমাদের কাছে।”
—’সবার কাছে ঔষধ আছে! কিন্তু কেউ তা দিতে রাজী নয়। ঔষধের নাম কি দেবর্ষি?’ গোপীরা সমবেত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন।
—’ঔষধ, ঠিক ঔষধ নয়, অনুপান বলতে পার।’
—অনুপান। কি এমন দুর্লভ অনুপান, যা আপনি ত্রিভুবন ঘুরে সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন না?
—’অনুপান দুর্লভ নয়! দুলর্ভ অনুপানদাতা।’
—’দুর্লভ যদি না হয় তাহলে নিঃসঙ্কোচে বলুন অনুপান কি? গোপীদের ব্যাকুল হৃদয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
—কোন প্রেমিক ভক্তের নিজচরণের ধূলি প্রভুর শিরঃপীড়া রোগ প্রশমনের জন্য, ঔষধের অনুপান হিসাবে ব্যবহৃত করতে হবে।’
গোপীরা বললেন,—’হে দেবর্ষি, ঔষধের এই সামান্য অনুপান ত্রিভুবনে আপনাকে কেউ প্রদান করল না।’ গোপীরা বসে পড়লেন যমুনাতটস্থিত ব্রজভূমিতে। তারপর চরণভূমিতে ঘষে ঘষে চরণে রেণু বা ধূলি লাগিয়ে, পরে তা ঝেড়ে তরুপত্রে রেখে দেবর্ষির হাতে দিয়ে বললেন,—”আপনার যত খুশী পদধূলি নিয়ে যান। আমরা প্রত্যেক গোপী তরুপত্রসমূহে পদধূলি সংগ্রহ করে দিয়েছি। এবার আপনি নিশ্চিন্তমনে দ্বারকায় গিয়ে প্রভুকে নিরাময় করে দিন, যান, দেবর্ষি অনর্থক এখানে দাঁড়িয়ে বিলম্ব করবেন না।”
—”আপনারা কী করছেন, তা কি, একবার ভেবে দেখেছেন?’ অশিক্ষিতা-মূর্খ গোপীদের প্রতি নারদের দয়া দেখা দিল তাই তিনি পুনরায় বললেন,—”শ্রীকৃষ্ণ শুধু যোগেশ্বর, ব্রজনাথ নন—তিনি সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম। তাঁকে চরণধূলি দিতে কোন ঋষি-মহর্ষি, শিব-ব্রহ্মাদি দেবগণও সাহস করেন না। জেনে বুঝে তাঁকে চরণধূলি দেওয়ার পরিণতি অনন্তকাল ধরে নরকযন্ত্রণা ভোগ।”
—এত কথা না বলে, আপনি চরণধূলি নিয়ে অবিলম্বে দ্বারকায় যান। না জানি প্রাণনাথ আমাদের কত কষ্ট পাচ্ছেন শিরঃপীড়ায়। শুনুন দেবর্ষি আমরা ভগবান পরব্রহ্ম এসব বুঝি না। জানিও না। আমরা জানি, শুধু তিনি আমাদের প্রাণনাথ, তাঁর সুস্থতাই আমাদের একমাত্র কাম্য। যেসব পাপ ও নরকের কথা আপনি বললেন—ওসব তো আমাদের শ্যামসুন্দর আগেই মেরে রেখেছেন। আপনি কি জানেন না, আমাদের প্রাণনাথের অঘাসুর (পাপ) নরকাসুর (নরক) বধের কথা? আপনি শীঘ্র দ্বারকায় গিয়ে প্রভুকে পদধূলি দিয়ে সুস্থ করে তুলুন। এতে যদি আমাদের নরকভোগ করতেই হয় অনন্তকাল ধরে তা করবো কিন্তু আমাদের প্রাণনাথ যেন সুস্থ থাকেন।
নারদ অবাক হয়ে গোপীদের অপলকনেত্রে দেখতে দেখতে প্রথমে চরণধূলি নিজের সারা গায়ে, মাথায় খানিকটা মেখে নেন। পরে নিজের উত্তরীয়ের প্রান্তে পদধূলি বেঁধে মাথায় রেখে দ্বারকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। পথে যেতে যেতে নারদ ভাবেন—’আমরা ঋষিমুনিরা মিছেই ভক্ত বলে গর্ব করি।’ ভাবতে ভাবতে দ্বারকার অন্তঃপুরে তিনি যখন পৌঁছালেন তখন তাঁর সারা শরীর গোপীদের পদধূলিতে স্নাত দেখে শ্রীকৃষ্ণ শয্যাত্যাগ করে উঠে এসে নারদকে সহর্ষেআলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। অতঃপর গোপীদের চরণধূলি শিরে ধারণ করে রোগমুক্ত হন তিনি। রুক্মিণী-সত্যভামাদি মহিষীগণ বিস্ময়ে নিরুত্তর। শ্রীকৃষ্ণ মহিষীদের দিকে কটাক্ষপাত করে বললেন—”ব্রজের গোপীরা তো পাগলী কিন্তু পাগলীরা কখনও কখনও এমন কাজে করে, যাতে অনেকের কল্যাণ হয়। তোমরা তো নিজের চোখেই দেখলে সব।”
দ্বারকার মহিষীদের তিনি বুঝিয়ে দিলেন—রাধা-গোপীদের নামকথা প্রসঙ্গে এলে, কেন তাঁর আঁখিতে অশ্রু দেখা দেয়! সারাশরীর রোমাঞ্চিত হয়। মহিষীরা লজ্জায় অধোবদন রইলেন।
অতঃপর শ্রীকৃষ্ণ নারদের দিকে চেয়ে বললেন—’দেবর্ষি, আপনি ভক্তিমার্গের পরমাচার্য শিরোমণি বিশেষ। যে ঔষধের অনুপানের জন্য আপনি ত্রিভুবন ঘুরলেন তা নিজের কাছে থাকতে দিলেন না কেন?’
নারদ বললেন—’আমি যদি আপনাকে পদধূলি দিতাম, তাহলে গোপাঙ্গনাদের পবিত্র পদরজতে স্নান করার সৌভাগ্য কি অর্জন করতাম? গোপাঙ্গনাদের পদরজতে স্নান করে আমি অনুভব করেছি—
তস্মিন তৎসুখসুখিত্বম্।
যথা ব্রজ গোপিকানাম।।
গোপীরা প্রেমের পবিত্র নিশান। এ অনুভব দেবর্ষি নারদের একার নয়, বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তের। ভক্ত ও ভগবানের জয় হোক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন