মহাভারতের যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পাণ্ডবরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। শতকৌরব নিহত এমতাবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন,—’ধর্মরাজ যুদ্ধ তো সমাপ্ত হল। ধর্মের জয়ও হল, অধর্মের পতন হল। এবার রাজ্য অভিষেকের আয়োজন করুন এবং রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতের তুলে নিয়ে ন্যায় ধর্মের সঙ্গে রাজ্য ভোগ করুন।’
যুধিষ্ঠির বললেন—লক্ষ লক্ষ যুবকের রক্ত ঝরিয়ে লক্ষ লক্ষ নারীকে বিধবা সাজিয়ে, হাজার হাজার মায়ের কোল শূন্য করে যে রাজ্য আমি পেয়েছি তা ভোগ করার ইচ্ছা আমার নেই। রাজ সিংহাসনে বসার কোন অভিরুচি আমার নেই। যুদ্ধে রক্ত, অশ্রুপাত শোক ও বেদনা দেখে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। ভাবছি কি লাভ এই রাজ্য ভোগ করে? রক্ত, অশ্রুর মূল্যে যা পেয়েছি তা যে কখনই সুখাবহ হবে না তা আমি বুঝতে পেরেছি, তাই আমি চাই…।
—কি চান আপনি?
—ভাবছি গঙ্গার তীরে কোন এক নির্জন জায়গায় গিয়ে সাধন ভজন-তপস্যাদি করে নিজকৃত পাপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করবো। তারপর পাপমুক্ত শুদ্ধ হৃদয়ে ফিরে এসে শান্তিতে রাজ্য শাসন করবো। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে বললেন,—’হে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, তবু তুমি আর কোনদিনই শান্তিতে রাজ্যপালন করতে পারবে না। কেন না খুব সম্প্রতি পৃথিবীতে কলি প্রবেশ করবে। তার লক্ষণ যদি দেখতে চাও তবে তোমরা পাঁচভাই আজ পাঁচদিকে ভ্রমণে বেরিয়ে যাও। ভ্রমণে বেরিয়ে তোমরা পাঁচভাই পাঁচরকম আশ্চর্য্য ঘটনা দেখতে পাবে। সন্ধ্যার পরে তোমরা পাঁচভাই যখন ফিরে আসবে তখন তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’
পাঁচ ভাই শ্রীকৃষ্ণের কথামত সেদিন পাঁচদিকে ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লেন। যুধিষ্ঠির বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় গিয়ে দেখেন একটি হাতী দাঁড়িয়ে আছে—তার দুটি শুঁড়। দুই শুঁড়ওয়ালা দেখে যুধিষ্ঠির আশ্চর্য্য হয়ে যান। অর্জুন দেখেন দ্বিতীয় আশ্চর্য্যজনক ঘটনা। তিনি দেখলেন, একজায়গায় একটি পাখী রয়েছে। ওই পাখীর পাখায় বেদমন্ত্র ও ধর্মের সার লেখা রয়েছে কিন্তু পাখীটি একটি মরদেহের মাংস ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।
অন্যদিকে ভীম দেখেন, একটি গাভী তার নবজাত বাছুরকে এমনভাবে লেহন করছে যে বাছুরটির সারা গা বেয়ে লোম উঠে গিয়ে রক্ত ঝরছে—তবুও গাভীটি লেহন করে চলেছে।
সহদেব চলতে চলতে একজায়গায় থেমে গেলেন বিস্ময়কর একটি ব্যাপার দেখে। একজায়গায় ছয়টি কূয়ো আছে—চার প্রান্তের চারটি কূয়োয় জল আছে কিন্তু মাঝের দুটি খালি।
নকুল ঘুরতে ঘুরতে দেখলেন আর এক আশ্চর্য্য ঘটনা। তিনি এক পাহাড়ের পাদদেশে উপনীত হয়েছিলেন। সেখান থেকে পাহাড়ের দিকে তাকাতেই তিনি দেখলেন-পাহাড়ের উপর থেকে একটি বড় পাথরের চাঁই বিপুল বেগে গড়িয়ে পড়ছে, গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও তার গতি থামছে না বা আটকে যাচ্ছে না কিংবা অন্য কোন বড় পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়েও তার গতি প্রতিরোধ হচ্ছে না, শেষে গড়াতে গড়াতে পাথরের চাঁইটি একটি ঘাস পাতায় এসে আটকে গেল। কি আশ্চর্য্য! ভাবতে ভাবতে নকুল ফিরে গেলেন হস্তিনাপুরে। অপরদিকে অন্য চার ভাই ও সন্ধ্যার আগেই নগরে ফিরে গেছেন।
পাঁচভাই সন্ধ্যার কিছুপর কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে আপন আপন দেখা আশ্চর্য্য ঘটনাবলীর আনুপূর্বিক বিবরণ দিলেন এবং ঐ পাঁচ ঘটনার রহস্য কি তা জানতে চাইলেন।
শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে যুধিষ্ঠিরের দেখা দুই শুঁড়ওয়ালা হাতীর রহস্য বিশ্লেষণ করে বললেন, ধর্মরাজ কলিযুগে যারা শাসক হবেন—তারা সব ঐ দুই শুঁড়ওয়ালা হাতীর মতো অর্থাৎ এরা দুই দিক থেকে প্রজাদের শোষণ করবেন।
অর্জুনের দেখা দ্বিতীয় আশ্চর্য্য ঘটনার রহস্য হচ্ছে—কলিতে ধর্ম নিয়ে নানা মত ও সম্প্রদায় হবে তারা শাস্ত্রের বিষয় নিয়ে প্রবচন ও দেবে, নিত্য বস্তু কি অনিত্য বস্তু কি তা নিয়ে বড় বড় গ্রন্থও লিখবে কিন্তু ঐ সমস্ত ধর্ম প্রবক্তারা অনিত্য বিষয়ভোগেই আসক্ত হবে। তাদের কামনা নিত্য অপেক্ষা অনিত্য বস্তুতেই বেশী থাকবে। তাদের বাইরে ধর্মের বেশ, মুখে ধর্মের বুলি কিন্তু অন্তরে থাকবে তীব্র ভোগ আকাঙ্ক্ষা।
মধ্যম পাণ্ডব দেখেছেন একটি গাভী তার নবজাত বাছুরের গা এমনভাবে লেহন করছে যে, বাছুরটির গা হতে রক্ত ঝরে যাচ্ছে—তবু গাভীটির লেহনে বিরাম নেই—এর অর্থ হচ্ছে কলিতে মানুষ পুত্রকন্যার প্রতি এত মোহগ্রস্ত বা আসক্ত হবে যে পুত্র-কন্যা বা সন্তান-সন্ততিরা নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে শিখবে না অর্থাৎ তারা স্বাবলম্বী হতে পারবে না—তাদের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়বে। ফলে তারা দুর্বলচিত্ত বা ভীরু হৃদয়ের অধিকারী হবে।
চতুর্থ আশ্চর্য্য হচ্ছে সহদেবের দেখা ঘটনা। দুই দিকের দুই কুয়োর জল আছে মাঝের কুয়োগুলি খালি। এর অর্থ হচ্ছে কলিকালে ধনবান, ঐশ্বর্য্যবান, ক্ষমতাশালী লোক বিবাহ-উৎসবে ভোজে লাখ লাখ টাকা খরচ করবে কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে কেউ যদি দীনদুঃখী ক্ষুধাতুর বা অনাথ থাকে তবে তাকে সাহায্যের জন্য কেউ ভাববে না বা এগিয়ে আসবে না। নিজের স্বার্থপূরণে লক্ষ টাকার তেল পুড়িয়ে ঘর আলো করবে কিন্তু পাড়ার ঘরে যে জীবনদ্বীপের তেল শেষপ্রায়, সেখানে একফোঁটাও তেল ঢেলে সাহায্য করবে না।
নকুলের দেখা পঞ্চম আশ্চর্য্যজনক ঘটনা হচ্ছে পাহাড়ের উপর থেকে একটি বড় পাথরের চাঁই প্রবলবেগে গড়িয়ে পড়ার সময় গাছের গুঁড়িতে না আটকে কিংবা কোন বড় পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে তা না থেমে শেষে একটি ঘাসের পাতায় আটকে গেল। এর রহস্য হচ্ছে, কলিকালে মানুষ ধনবান ও ক্ষমতাবান হবে। কিন্তু তার যখন পতন হবে তখন সেই পতন ধন বা ক্ষমতার দ্বারা প্রতিরোধ হবে না, তাঁর মন নীচের দিকে পড়তেই থাকবে ঐ পাথরের চাঁই-এর মত। অঢেল ধনরাশি তার পতনের গতিরোধ করতে পারবে না। আবার বৃক্ষের গুঁড়ির মতো ক্ষমতার দম্ভও তার পতনকে রুখতে পারবে না কিন্তু ঘাসের ছোট্ট একটি পাতার মত রাম অথবা কৃষ্ণনাম তার পতনোন্মুখ মনের গতিকে থামিয়ে দেবে।
হে পাণ্ডববৃন্দ ঈশ্বরের নামকে আশ্রয় করে মঙ্গলকর্মে ব্রতী হন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন