সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ

কংসের রজককে নিধন করে সংগৃহীত ধৌত নববস্ত্র পরিধান করে কৃষ্ণবলরামসহ গোপসখারা চলেছেন মথুরার রাজপথ দিয়ে। সকলের গাত্রমাপ অনুযায়ী না হওয়ার ফলে সকলের চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। সকলের অঙ্গে বস্ত্র বিসদৃশ-বেমানান হয়ে শোভা পাচ্ছে। বস্ত্র অধিকাংশ ঢিলা হওয়ার জন্য ঠিকমত পথ চলা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় শম্বুকগতিতে চলতে চলতে একসময় সকলেই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন জিজ্ঞাসা করে—এই বস্ত্র পরে পথ চলবো কেমন করে? সহসা সেই পথ দিয়ে যমুনা স্নানের জন্য আসতে থাকেন এক বৃদ্ধ দর্জি। দর্জির নাম গুণক। সে বিশেষ বিশেষ পর্বোনপলক্ষ্যে যমুনায় স্নান করতে আসে। রাজপথের চলমান নাগরিকরা ভাবেন—আজ তো মথুরায় কোন পর্ব বা উৎসব নেই—গুণক আজ কেন রাজপথ ধরে যমুনার দিকে চলেছে? আশ্চর্য্য! চলেছে স্নানে অথচ হাতে রয়েছে কাপড় কাটার কাঁচি। কী ব্যাপার! বিস্মিত নয়নে নাগরিকরা গুণককে লক্ষ্য করে। গুণক চলেছে আজ অন্যদিনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে।

পাঠক আসুন—গুণকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। মথুরার নাগরিকরা বলেন—গুণক একজন উচ্চকোটির সূচীশিল্পী। শুধু মথুরার মধ্যেই তার শিল্পকর্ম সীমিত নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে—বিভিন্ন প্রদেশের রাজসূচী— শিল্পকর্মীরা গুণকের কাছে শিল্পকর্ম শিখতে আসে। অনেক রাজসূচীশিল্পী নিজেদেরকে গুণকের ছাত্র ভেবে গৌরব অনুভব করেন। গুণকের দোহারা ছিপছিপে গৌরবর্ণ শরীর। শরীরের খাঁজে খাঁজে বার্দ্ধক্যজনিত বলিরেখা। মাথাভর্তি শুভ্রকেশ কিন্তু নেত্র তেজদৃপ্ত উজ্জ্বল। স্বভাবে শান্ত, কম কথা বলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে আপন শিল্প কর্মের মধ্যে তন্ময় হয়ে ডুবে যায়। শরীরে বার্দ্ধক্যের প্রভাব পড়লেও দুই হাত ও দুই নেত্রে এখনও তারুণ্যের দীপ্তি অম্লান। প্রয়োজনে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে খুব ধীরে। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে সব কথা কর্ণগোচর হয় না। মথুরার রাজসূচীশিল্পী গুণক। ধনুষযজ্ঞের পূর্বে কংসকে নতুন বস্ত্র তৈরী করে দিতে হবে। সে এককথার মানুষ। কথানুযায়ী সময়মত সে গ্রাহকদের বস্ত্র সরবরাহ করে। এতৎসত্বেও তার একটি দোষ আছে।—তাকে হাজারবার ঘরে বা গৃহে এসে বস্ত্রের মাপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানালেও সে তা পালন করে না—এমনকি মহারাজ কংসের আহ্বানেও না। কংসকেও গুণকের দোকান ঘরে গিয়ে নিজের পোষাকের জন্য মাপ দিয়ে আসতে হয়। অথবা কোন সেবককে ঐ কাজের জন্য পাঠাতে হয়। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে তার মুখের কথাই শেষ কথা। দরাদরি সে একদম পছন্দ করে না। কারও কাপড় বা পোশাক যদি সে তৈরী করে দেব বলে—তাহলে বুঝতে হবে সেটাই তাদের চরম পাওনা। পারিশ্রমিক নিয়ে বেশী দর কষাকষি করলে সরাসরি মুখের উপর বলে দেয়—সময় নেই।

গুণক উচ্চমানের কলাকার। কিন্তু দরিদ্র। সম্পদ সংগ্রহের জন্য যতটা পরিশ্রমের দরকার সে ততটা পরিশ্রম করে না। রাজার ও অন্যান্যদের বস্ত্র তৈরী করে সে যা পারিশ্রমিক পায়, তা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা তার কাছে সেলাই শিখতে আসে তাদের খাওয়ানো-পরানোর উদ্দেশ্যেই ব্যয় করে দেয়। এইভাবে অর্জিত অর্থ পরের সেবায় উৎসর্গ করে। বিশেষ প্রয়োজন না হলে সে তার দোকান ও সেলাই শেখানোর মহাবিদ্যালয় ছেড়ে কোথাও যায় না। তাই গুণককে আজ রাস্তায় কাঁচি হাতে যমুনার দিকে আসতে দেখে নাগরিকরা বিস্মিত হয়। গুণক কাঁচি হাতে নিয়ে পথ দিয়ে আসতে আসতে একসময় শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে উপস্থিত হয় এবং কৃষ্ণের দিকে চেয়ে যুক্ত করে ক্ষীণকন্ঠে বলে—’ভদ্র, যদি অনুমতি করেন তো, আপনাদের সকলের পোষাক কর্ত্তন করে গাত্র মাপ অনুযায়ী সজ্জিত করে দিই।’

কৃষ্ণ সম্মতিসূচক গ্রীবা নেড়ে বলেন—অবশ্যই ভদ্র, আপনার মহানুভবতায় আমরা কৃতার্থ। একটু দ্রুততার সঙ্গে আপনি আপনার কর্ম সম্প্রদানে প্রয়াসী হন, কারণ আমাদের ব্যস্ততা আছে। গুণক কৃষ্ণর কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে কাঁচি দিয়ে বস্ত্র কর্ত্তনে মনোনিবেশ করল। দ্রুতগতিতে কর্ম করতে থাকে সে। সবাইকে দণ্ডায়মান অবস্থায় রেখে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বস্ত্র ঠিক করে সুশোভিত করে দেয়। হাতে যেন তার যাদু আছে। কাঁচি যেন কথা বলতে বলতে সুচারুরূপে তার কর্ম সম্পন্ন করতে থাকে।

গোপবালকরা তাকে আশ্চর্য গতির সঙ্গে সুন্দর কর্ম করতে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়। মথুরায় এসে এই প্রথম তারা এক আশ্চর্য্য অদ্ভুত শিল্পকর্মীর দর্শন লাভ করল। রাজপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মথুরার নাগরিকরাও মুগ্ধ নয়নে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থির হয়ে যায়। ধন্য গুণকের শিল্পকলা। রঙ-বেরঙের বস্ত্রের যতটুকু প্রয়োজন—শরীরকে সুন্দর সুশোভিত করার জন্য ততটুকু রেখে বাকী অংশ সে ছেঁটে ফেলে দিল। কর্ত্তিত বস্ত্রের খণ্ড অংশ রাশিকৃত হয়ে পথে পড়ে রইলো।

দ্রুততার সঙ্গে কর্ম শেষ করে গুণক পুনরায় কৃষ্ণ বলরামের সামনে যুক্ত করে দাঁড়ালো। কৃষ্ণ তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে কাঁধে কোমলকর স্থাপন করে বললেন,—’ইহলোকে তোমার সম্পদ অক্ষয় হোক। তোমার কোনদিন যেন অর্থাভাব না হয়। তোমার শরীর যুবকের ন্যায় বলশালী হোক। সকল ইন্দ্রিয় সতেজ থাক আজীবন। স্মৃতি হোক অটুট।’

মথুরার নাগরিকরা চকিত নয়নে দেখে—গুণকের শরীরের বার্দ্ধক্যের বলিরেখা অদৃশ্য হয়ে গেছে। মাথার কেশ শুভ্র থাকলেও সারা শরীরে তারুণ্যের দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে। কাঁধের উপর থেকে কৃষ্ণের কোমল কর স্বীয় হস্তদ্বয়ের দ্বারা মুঠী বন্দী করে বুকের উপর স্থাপন করে গুণক অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে—’হে ভদ্র, আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন—আমি যেন বাকী জীবন আপনার এবং আপনার সেবকদের সেবায় অতিবাহিত করতে পারি।’

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘হে মহান শিল্পী—আজ থেকে তুমি আমার নিত্যকালের সহচর।’ কৃষ্ণের রক্তিম অধরপল্লব থেকে বাক্য নির্গত না হতেই সমবেত নাগরিকরা উচ্চকন্ঠে বলে উঠল—’ভগবান বাসুদেব কী জয়।’ গুণকের ধ্যানতন্ময়তা সমবেত জনতার জয়ধ্বনিতে ভঙ্গ হয় না। সে জানে না তার দুইহাতের মধ্যে এখনও কৃষ্ণের হাত বন্দী হয়ে আছে। কৃষ্ণ হাত ছাড়িয়ে নিতেই-সে বিভোর, রোমাঞ্চিত শরীরে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে পথের উপরে। কৃষ্ণ বলরাম সখাসহ চলে যায়। চলতে চলতে একসময় তাঁরা রাজপথ ছেড়ে গলিপথ ধরে হাঁটতে থাকে। কৃষ্ণ-বলরাম রাজপথ ছেড়ে গলিপথে হাঁটছে কেন? সখারা ভেবে পায় না দুইভাইয়ের উদ্দেশ্য কী!

অন্যদিকে নাগরিকরা ভাববিভোর রোমাঞ্চিত কলেবর গুণককে তার দোকানে পৌঁছে দেয়। দোকানে পৌঁছে সে বুঝতে পারে না—সে কখন দোকানে এল-তার চোখের সামনে তখন শুধুই নীলমণি যশোদার দুলাল ভাসছে। সে শুনেছিল, পরশপাথর বলে একরকম পাথর আছে—যার স্পর্শে লোহা সোনা হয় কিন্তু এ নীলমণি কেমন মণি যার স্পর্শে সে নিজেই যেন এক নীলমণিতে রূপান্তরিত হয়েছে (ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি)। সে যেদিকে তাকায় শুধু নীলমণি নবঘন শ্যামসুন্দর দেখে। কাঁচি-সূঁচ বাদে দোকানের সমস্ত উপকরণ সুবর্ণে পরিণত হয়ে গেছে। কৃষ্ণ আশীর্বাদে তার ইহলোকের সম্পদ লাভ হয়েছে। গুণকের দুই নয়ন হতে অশ্রু ঝরছে। সে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে দোকান ঘরে। সামনে তার অনেক কাজ-রাজার বাড়ী থেকে লোক আসবে রাজার নতুন পোষাক নেওয়ার জন্য। এখন তাঁর কিছুই মনে পড়ছে না। নীলসুন্দরের ধ্যানে সে তন্ময়। তার হাত, হাতের শিল্পকর্ম এখন থেকে শুধু শ্যামসুন্দর ও তাঁর সেবকের জন্য সংরক্ষিত। অস্ফুট স্বরে সে উচ্চারণ করে—আজ থেকে আমি আর কারও বস্ত্র স্পর্শ করবো না—কারও কাপড় সেলাই করবো না—আমার হাত, হাতের শিল্পের অধিকার শুধুমাত্র কৃষ্ণের।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন