গন্ধর্ব শিল্পী তুম্বুরু সবার অলক্ষ্যে প্রবেশ করেছেন বৃন্দাবনের গোচারণের মাঠে। সুরলোকের সংগীতগুরু ও দেবর্ষি নারদের সহচর তিনি। শিব-পার্বতীর কৃপাধন্য। স্বয়ং মহাদেব তাঁর সংগীতগুরু। পরমপুরুষ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। দেবতা, কিন্নর, গন্ধর্ব, অপ্সরারা সব ব্রজভূমে উপনীত হয়ে স্তব, সংগীত, নৃত্য বাদ্যদ্বারা ব্রজরাজ কুমারের সেবায় নিজেদের সঁপে দিয়েছেন। তুম্বুরু দেবলোকে সংগীত শিক্ষার কার্যে ব্যস্ত থাকেন। কোথাও যেতে বড় একটা সময় পান না কিন্তু যখন দেবর্ষি নারদের কাছে শুনলেন—’আনন্দময় পরমপুরুষ ব্রজভূমে গোপবালকবেশে আবির্ভূত হয়ে পরমানন্দে বনে বনে গোবৎস চারণ করতে করতে বিচরণ করছেন’—তখন তিনিও আর না এসে থাকতে পারলেন না। গন্ধর্ব দেহ নিয়ে ভৌম বৃন্দাবনে প্রবেশ করা যায় না—তাই তিনি মানবরূপ ধারণ করে সবার অগোচরে বৃন্দাবনের অরণ্যে প্রবেশ করলেন। উদ্দেশ্য ব্রজরাজকুমার নন্দনন্দনকেও তাঁর সখাগণকে একটু সংগীত কিংবা সুর-বাদ্য শিক্ষা প্রদান করবেন। নন্দনন্দন ও তাঁর সখাদের শিক্ষাদানের ছলে তিনি একটু সেবা করবেন—এই মনোগত অভিলাষ। বৃন্দাবনের যে স্থলে নন্দনন্দন সখাগণসহ গোবৎস চারণ করেন, তিনি সেই স্থলে উপনীত হয়ে তরুলতার অন্তরালে আত্মগোপন করে দেখতে থাকেন—ব্রজরাজকুমার ও তাঁর সখাগনের দিব্যমধুর গোবৎসচারণলীলা। সখারা উক্তস্থলে গোবৎসের দল নিয়ে উপস্থিত হল। সবার কাঁধে উত্তরীয়। মাথায় রঙ-বেরঙের পাখীর পালক, হাতে রত্নখচিত বৎস চারণের যষ্টি। সবার হাতে শৃঙ্গ শোভা পাচ্ছে। শুধু ব্রজরাজকুমারের কটিবস্ত্রে ছোট্ট একটা বাঁশের মুরলী গোঁজা রয়েছে। তাঁদের শ্রীঅঙ্গের সৌন্দর্য-সুষমার ছটায় সারাবন আলোকিত। গন্ধর্ব শিল্পী অন্তরাল থেকে নয়নপথে ব্রজরাজকুমার সহ সখাগণের সৌন্দর্য্য সুধা পান করছেন। মনে মনে ভাবছেন—”এরা এত সুন্দর। সুরলোকে, গন্ধর্বলোকে, এমনকি অনন্তব্রহ্মাণ্ডের অনন্তলোকে এই সৌন্দর্য্যের প্রকাশ স্বপ্নেও দর্শন করা যাবে না।” সখাদের মধ্যে কেউ কেউ তখন বৃক্ষ থেকে পত্র চয়ন করে পত্রকে ভাঁজ করে পিঁ পিঁ আওয়াজ এমন বাদ্য তৈরী করল। সেই পত্র উদ্ভূত বাদ্যধ্বনি গন্ধর্ব শিল্পীর কর্ণে বেসুরো লাগছে। তিনি ভাবেন—”এই সুযোগে প্রকট হয়ে গোপকুমারদের সংগীত কলার শিক্ষা প্রদান করি। এই সুযোগে যদি ওদের সবাইকে সুরবাদ্য ইত্যাদি শিক্ষাপ্রদান করি—তাহলে আমার গন্ধর্ব্য জীবন ধন্য হয়ে যাবে। যদি সে রকম সুযোগ উপস্থিত হয় তাহলে আমি আমার সমস্ত সংগীতকলা বিদ্যা ব্রজরাজকুমার ও তাঁর সখাদের প্রাণ উজাড় করে শিখিয়ে দেব। কিন্তু এরা যে সব ক্রীড়া চঞ্চল। ক্রীড়ার মধ্যে মধ্যে একবার শৃঙ্গ বাজাচ্ছে—উচ্চ নিনাদে, আবার পরক্ষণেই পাতার তৈরি বাঁশী বাজাচ্ছে পিঁ পিঁ করে। এদের ক্রীড়ার কোন ক্রমও নেই। হবেই বা কি করে—সব গোপকুমার ছাড়া তো অন্য কিছু নয়। তুম্বুরু ভুলে গেলেন তিনি কোথায় বসে ভাবছেন—এইসব ভাবনা। আত্মতন্ময় হয়ে তিনি দেখছেন—আকাশপথে পাখী উড়ছে, নীচে পড়েছে সেই পাখীর ছায়া। এক সখা সেই বনভূমে পতিত পাখীর ছায়ায় ছায়ায় পা রেখে দৌড়াচ্ছে। কেউ ময়ূরের সাথে তাল দিয়ে নৃত্য করছে। কেউ মণ্ডুকের (ব্যাঙ) মতো বসে বসে লাফাচ্ছে, কেউ বন্য হরিণ বা খরগোশের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। কেউ কেউ বানরদের সঙ্গে গাছের ডালে উঠে এডাল-ওডাল করছে। কেউ বা বানরের লেজ ধরে ঝুলছে। বানর ক্ষুব্ধ হয়ে মুখ বিকৃত করলে তারাও প্রত্যুত্তরে মুখ বিকৃত করছে। কোন কোন সখা পাখীর ডাক অনুকরণ করে পাখীর মতো ডাকতে শুরু করে। কেউ জোরে জোরে চীৎকার করছে প্রতিধ্বনি ফিরে এলে তা শুনে সবাই খিল খিল করে হাসছে। একে অপরের হস্তধৃত শৃঙ্গবেত ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয়—কখনও বা তা হাতে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে বেড়ায়। যাঁদের হস্ত হতে বেত-শৃঙ্গ ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তাঁরা ছিনতাইকারী সখাদের পিছু পিছু দৌড়ায়।
খেলা চলতে থাকে। অন্তরালে থেকে দেখতে থাকেন তুম্বুরী। ইতি মধ্যে যশোদা সেবিকা পাঠিয়ে কানাই-বলরামকে গৃহে ডেকে পাঠান, খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য। ক্রীড়ামত্ত কানাই-বলাই সহ সখাগণ সেবিকার কথা কানেই তোলে না। ফলে যশোদা খাবার মাঠেই প্রেরণ করতে বাধ্য হন। সেখানে কানাই-বলাইকে মধ্যমণি করে গোপকুমাররা গোল হয়ে বসে খাবার খেতে শুরু করে। একে অন্যের মুখে খাদ্যবস্তু তুলে দেয়। পশু-পাখী-বৎসদেরও খাবার খাইয়ে দেয়। নন্দনন্দন যা করে যা বলে, তা সবার প্রিয় লাগে। তাঁদের ক্রীড়া কৌতুক দেখে তুম্বুরু মোহিত হয়ে যান। আত্মবিস্মৃত হয়ে তিনি তাঁদের বিনোদ-পরিহাস উপভোগ করতে করতে ভাবেন—”আমি তো এদের ক্রীড়া-বিনোদ দর্শনের জন্য বনভূমে উপনীত হইনি। আমি এসেছি এদের সুরবাদ্যকলা শিক্ষা দিতে। খেলায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে সে সুযোগ কি আমি পাব?” খাওয়া শেষ করে ঐ তো ওরা সব পাতার বাঁশী বাজাচ্ছে। এই সময় ওদের সামনে প্রকাশ হয়ে বলব যে, তোমাদের বাঁশী ঠিকমত তাল লয়ে বাজছে না, আমার কাছে শিখে নাও। তুম্বুরু যখন ভাবছেন আত্মপ্রকাশ করবেন কি করবেন না, তখন শ্যামসুন্দর সহসা কটিবস্ত্রে গোঁজা বাঁশীটি হাতে নিয়ে সুবলের কাছে এসে বললেন—’সুবল তুই বাঁশী বাজাবি?”
সুবল—’বাজাব, যদি তুই শিখিয়ে দিস।’ সুবল শ্যামসুন্দরের কাছে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শ্যামসুন্দর সুবলের হাতে বাঁশীটি তুলে দিয়ে তাঁর পাশে ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে বলে—নিচের ছিদ্রে আঙুল স্থাপন কর, তারপর উপরের ছিদ্রে মুখ লাগিয়ে ফুৎকার দে? কোমল দুই বাহুলতায় সুবলকে ঘিরে শ্যাম শিক্ষা দিতে থাকে। তাঁর সহজ সরল শিক্ষাদানের পদ্ধতি দেখে তুম্বুরু অবাক হয়ে যান। সম্পূর্ণ বাঁশীটি কিভাবে শ্রীকরে রেখে ফুঁ দিতে হয় তা তুম্বুরু যেন নিজেই শিক্ষা নেন—শ্যামসুন্দরের কাছে। শিক্ষাদানের এই অভিনব পদ্ধতি—তিনি সুরগুরু হলেও তাঁর জানা নেই। হঠাৎ ভদ্র এসে সুবলের বাঁশীটি কেড়ে নিয়ে বলে—”সুবল শৃঙ্গ বাজাবে, বাঁশী তুই বাজা কানু।” ভদ্রের এই বাধাদান তুম্বুরুর ভালো লাগে না। বংশীবাদনের শিক্ষাগ্রহণ তাঁর অপূর্ণ রয়ে গেল। ”চুরি করে কোন বিদ্যা শিক্ষা করা বোধ হয় কলাদেবী ভারতীর অভিপ্রেত নয়—তাই ভদ্রের এই বাধাদান’—তুম্বুরু অন্তরালে অব্যক্ত থেকে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন উপরোক্ত কথাগুলি। সুবলের হাত থেকে বাঁশী ছিনিয়ে নিয়ে ভদ্র তখন দাঁড়িয়ে আছে কানাইয়ের সামনে। কানাই ভদ্রকে লক্ষ্য করে বলেন,—”তবে তুই বাঁশী বাজা, আয় কাছে আয়, আমি তোকে শিখিয়ে দিই।”
—’আমার মেয়েদের মতো পিঁ পিঁ করে বাঁশী বাজানো ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে শৃঙ্গ নয়তো শঙ্খ বাজাতে।’ ভদ্র উত্তর দেয় কানাইকে।
—’বেশ শঙ্খ না হয় সন্ধ্যাবেলায় যখন ঘরে ফিরবি তখন বাজাবি, এখন বাঁশী তো বাজা।’ ভদ্রকে কাছে ডেকে কৃষ্ণ বাঁশী বাজানো শেখাতে শুরু করল। ভদ্র বার কয়েকের চেষ্টায় ব্যর্থ—বিরক্ত হয়ে বলল,—’এই ছোট্ট বাঁশীতে কী স্বর বেরোয়?’ তুম্বুরু ভাবেন,—’এইবার কি আত্মপ্রকাশ করবো?’ ওদিকে ভদ্র তখন বলল,—”তুই বাঁশী বাজা কানু, ও তোর হাতেই মানায়। ঐ তমাল বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে তুই বাঁশীতে সুর তোল, আমরা শুনি।” অন্তরাল থেকে অস্ফুট স্বরে তুম্বুরে বলেন,—’উত্তম প্রস্তাব, আগে সুর শুনি পরে না হয় ওদের সামনে আত্মপ্রকাশ করে শিক্ষাদান করবো। আগে না শুনে, না বুঝে ওদের শিক্ষা দেওয়াটা বোধ হয় ঠিক নয়।’ ভদ্রের কথামত কানাই হাতে বাঁশী নিয়ে তমাল তরুমূলে দাঁড়াল। সখারা সব দৌড়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হল। ললিত ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে নন্দনন্দন বাঁশীতে অধর স্পর্শ করে সুর সংযোজন করল। কৃষ্ণের কুঞ্চিত কেশদামে ময়ূর পাখা, নবকিশলয়ের গুচ্ছ, গলায় গুঞ্জা হার, আভূমি লম্বিত মনোহর বনমালা, কপালে কস্তুরী তিলক, করে কঙ্কন, বাহুতে রত্নবলয়, পদকমলে স্বর্ণনূপুর, বক্ষদেশে কৌস্তুভমনিসহ মুক্তা ও শ্বেত স্ফটিক মালা দৃপ্ত মহিমায় শোভা পাচ্ছে। স্কন্ধদেশে পীত উত্তরীয় হাওয়ার তালে তালে নৃত্য করছে। বংশীর ছিদ্রের উপর স্থাপিত রক্তাভ নীল অঙ্গুলির পংক্তি বিন্যাস, নখচন্দ্রিমার গোলাপী কিরণ ছটায় স্নাত পরিধানের মহিমা প্রকাশে উদ্যত। পদনখের কিরণছটায় দৃষ্টি পড়তেই তুম্বুরু ভুলে যান নিজেকে। বাঁশীর সুর কানে প্রবেশ করতেই নিজেকে ফিরে পান তিনি। সুর শুনে তাঁর মনে হল, তিনি যেন রূপসাগরের তলদেশ থেকে উঠে এলেন। বাঁশীর স্বর যে এত সুধাবর্ষণ করতে পারে তা তুম্বুরুর পূর্বে জানা ছিল না। বাঁশীর অমৃতবর্ষী সুরে যে এত মাদকতা, এত যাদু যা জগৎ সংসার—দেহ-গেহ সব ভুলিয়ে দেয়—তুম্বুরু যেন এই প্রথম অনুভব করলেন। কিন্তু অনুভবকে ভাষায় প্রকাশ করতে তিনি অক্ষম। অবাক চোখে তিনি দেখেন বনভূমের আশপাশের শৈলশ্রেণী হতে শৈলখণ্ড তরলিত হয়ে স্রোতধারায় বয়ে চলেছে। সৃষ্টির অনুতে অনুতে সুর সুধার সিঞ্চন। গোবৎস, মৃগ, বানর, সিংহ সব জড়বৎ স্থির! তরুশাখায় অর্দ্ধনেত্রে স্থির হয়ে বসে আছে বিহঙ্গকুল। গাছের একডাল থেকে অন্যডালে লাফ দেবে বলে যে বানর হাত উপরে তুলে লাফ দেওয়ার ভঙ্গী করে উদ্যত হচ্ছিল—সে সেই মুদ্রায় স্থির হয়ে যায়। পাখী পাখা বিস্তার করতে ভুলে যায়। যে পাখা মেলে উড়ছিল নীলাকাশে সে পাখী পাখা গুটাতে ভুলে ঐ গগনেই স্থির হয়ে যায়। হরিণ মুখে তৃণ নিয়ে স্তব্ধবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। গাভীর স্তনে মুখ লাগিয়ে নিশ্চল হয়ে স্থানুর দাঁড়িয়ে পড়ে বৎসগুলি—তাদের চোয়ালবেয়ে দুধ মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। সারিবদ্ধ পিপীলিকার গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তরুমূলে শাখায় পত্রে–পুষ্পে রসস্রাব শুরু হয়। যমুনা উজান পথে তমাল তরুমূলে এসে ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ে। ঢেউ-এর ধারায় রাশি রাশি পদ্মফুল কৃষ্ণচরণে এসে লুটিয়ে পড়ে। প্রকৃতি নীরব। ভ্রমর মৌমাছির গুঞ্জন বন্ধ হয়ে যায়। সব শান্ত, সমাধিস্থ। ”কিন্তু অভাগা তুম্বুরু তুমি বঞ্চিত কেন?”—নিজের মনকে প্রশ্ন করেন সুর গন্ধর্ব সংগীত গুরু তুম্বুরু। ঐ সুর লহরীর অমৃতস্পর্শে কেন তার পাষাণ হৃদয়-গন্ধর্বদেহ যা মানবরূপে বৃন্দারন্যে গোপনে প্রবেশ করে এখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা কেন গলিত হয়ে রসময় স্রাবে পরিণত হল না? তবে কি আমার হৃদয়-দেহ সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন বস্তু? ধিক-শতধিক আমাকে। ইচ্ছা হয় এই বনভূমে পাষাণে মাথা ঠুকে প্রাণ বিসর্জন করি কিন্তু আমি যে গন্ধর্ব। দেবতাদের মতো গন্ধর্বরাও যে অমর। ”তাছাড়া এমন কঠিন পাথর কি ব্রজভূমিতে আছে—যেখানে আমি মাথা ঠুকে প্রাণ বিসর্জন দেব?” নিজের দেহ-মন-হৃদয়কে পাষাণ অপেক্ষা কঠিন মনে হচ্ছে তাঁর। ব্রজভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে পাষাণ অপেক্ষা কঠিন ভাবা তাঁর পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠল। তিনি সবার অগোচরে ত্বড়িৎগতিতে বনভূমি ত্যাগ করে ব্রহ্মলোকের দিকে পাড়ি দিলেন। যাওয়ার পথে স্বর্গলোকের দিকে চেয়ে দেখলেন—দেবতারা নন্দন কাননের পারিজাত বৃক্ষতলে পুষ্পাঞ্জলি বদ্ধ হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হয় ব্রজরাজ কুমারের বাঁশীর ধ্বনি সেখানেও প্রবেশ করেছে। নৃত্যরতা, অপ্সরীরা, বাদ্যরত কিন্নর গোষ্ঠী, গীতরত গন্ধর্বরা মূর্তিবৎ স্থির হয়ে দেবলোকে বিরাজ করছেন। মহর্লোক, জনলোক, তপোলোকের অধিবাসীদের অবস্থাও তদ্রুপ। যমলোকে, শিবলোকের অবস্থাও বৃন্দাবনের মতনই দেখলেন তুম্বুরু। সমস্ত লোক পরিভ্রমণ করতে করতে একসময় তুম্বুরু ব্রহ্মলোকে উপনীত হলেন।
তুম্বুরুকে দেখে ব্রহ্মাজী পদ্মাসন থেকে উত্থিত হয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। ব্রহ্মলোকের এক মুহূর্ত সমান ধরা ভূমির অনেকগুলি বছর। বংশীর স্বর এই মুহূর্তে বৃন্দাবনে থেমে গেছে। তাই ব্রহ্মাজী এখন কিছুটা প্রকৃতিস্থ। তিনি তুম্বুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন—”তুমি তো সংগীতের পরমাচার্য্য। বলতে পারো কিছুক্ষণ পূর্বে বংশীতে যে ধ্বনি শুনলাম তা কোন রাগের অন্তর্ভূক্ত? আমার সমগ্র সৃষ্টিকে যা পলে পলে পরিবর্তন করে দেয় আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সেই রাগের কৌশল কি তোমার জানা আছে? আমি তো চারমাথার বুদ্ধি নিয়ে ঐ রাগের তত্ব কৌশল আজও ধারণা করতে সক্ষম হলাম না, বৃদ্ধ হয়েছি তো, মনে হয় স্মৃতি ঠিক কাজ করছে না।” এমন সময় ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ—সেখানে উপস্থিত হলেন। নারদকে দেখে তুম্বুরু তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন—”আমি কি পাষাণের চেয়েও কঠিন?” ব্রজভূমে উপনীত হয়ে পরমেশ্বরের বংশীধ্বনি শুনেও আমার দেহমন বিগলিত হল না। নারদ তুম্বুরুকে বুকে তুলে জড়িয়ে ধরে বললেন—’হে সংগীত আচার্য্য ব্রজভূমিতে তুমি শিক্ষক হওয়ার অভিমান নিয়ে গিয়েছিলে। তুমি বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলে যে, ব্রজভূমিতে কখনও অভিমান বা অহংকার নিয়ে প্রবেশ হওয়ামাত্র তোমার অন্তরস্থিত অহংকারের কমপক্ষে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়াই শ্রেয় ছিল। নারদের কথা শুনে তুম্বুরু নিরুত্তর। নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হতে থাকেন তুম্বুরু।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন