মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন বিষণ্ণ, চিন্তিত! তিনি উদাস চঞ্চল চিত্তে আপন কক্ষের মধ্যে পায়চারী করছেন। ভীমকে ঐরূপ চিন্তিত ও বিষণ্ণ দেখে মাতা কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ভীম আজ সারাদিন অভুক্ত রয়েছে, আমি ভোজনের জন্যে বার বার পীড়াপীড়ি করেও এখনও পর্যন্ত তাঁকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। ভোজন যার প্রিয় সে আজ সারাদিন একদানাও মুখে তোলেনি, মনমরা হয়ে সারাদিন ঘরের মধ্যে পায়চারী করছে দেখে খুব খারাপ লাগছে। তুই একবার ওকে খাওয়ার জন্য বল না?”
খাওয়ার জন্য যে মায়ের অনুরোধ আহ্বান কানে তোলেনি সে কি অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনবে? ব্যর্থ হয়ে তাই যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের শরণ নিলেন। পাণ্ডবদের পরমাশ্রয় সখা কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির-এর কাছে ভীমের সারাদিন উপবাস করার কথা এবং সে কারণে জননী কুন্তীদেবীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা শুনলেন। তিনি যুধিষ্ঠির ও কুন্তীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ”এই নিয়ে ভাববার কিছু নেই, আমি দেখছি কি করা যায়।” তাঁর কথা শুনে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব ও জননী কুন্তী নিশ্চিন্ত হলেন।
ভীমসেন আজ চিন্তিত, বিষণ্ণ-উদাস চঞ্চল কেন? কারণ কী? গতরাত্রে শয়নকক্ষে প্রবেশের পূর্বে তিনি গবাক্ষপথে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শয়নকক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন, তাঁর অগ্রজ মহারানী দ্রোপদীর পদতলে বসে আছেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বিস্ময়ে চমকে উঠলেন, দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন ‘দ্রৌপদীর স্পর্ধা কম নয়, সে আমাদের অগ্রজের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হয় তা জানে না, তাঁর (দ্রৌপদীর) এই ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ অকল্পনীয়। ঐ রকম আচরণ বা ধৃষ্টতা যদি আমার সঙ্গে করে তাহলে আমি কি করে তা সহ্য করবো?’
স্বামী স্ত্রী বা দম্পতি যুগলে আপন কক্ষে কিভাবে উপবেশন বা অবস্থান করবে তা নিয়ে কারও ভাবনা-চিন্তা করা উচিত নয়। প্রেমের ক্ষেত্রে বড়-ছোটর ভেদ থাকে না। পত্নীর মধ্যে প্রণয়জনিত মান-অভিমান দেখা দিলে, পতি তার মান অপনোদনের জন্য অনুনয়-বিনয় করতেই পারেন ঠিক এইরকম এক পরিস্থিতিতেই গবাক্ষ পথ দিয়ে ভীমসেনের দৃষ্টি পড়ে দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের শয়নকক্ষে। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পদতলে কেন বসে আছেন—এটা ভীমের মতো মহাবলশালী ব্যক্তি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। স্বীয় সরল স্বভাব বশতঃ তিনি মনে করছেন দ্রৌপদীর অহংকার হয়েছে। দ্রৌপদীর সঙ্গে তাকেও অনেক কাজ করতে হয়। সেই সময় দ্রৌপদী যদি তাঁর সঙ্গে ঐরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে…আর ভাবতে পারেন না মধ্যম পাণ্ডব। রাত্রিতে শয্যায় শুয়েও ঘুম আসে না চোখে। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত শয্যায় এপাশ-ওপাশ করে যখন দেখলেন কিছুতেই ঘুম আসছে না, তখন শয্যাত্যাগ করে প্রাসাদের প্রাঙ্গণে এলেন এবং ভীমকন্ঠে শুরু করলেন ভজন গান—
”শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ হরে মুরারে, হে নাথ নারায়ণ বাসুদেব
মুকুন্দ গোপাল কৃষ্ণ মধুসূদন শ্রীমাধব।।”
ভীমের মেঘ মন্ত্র কন্ঠের ভজন গান শুনে প্রাসাদের সবার নিদ্রা গেল ভেঙ্গে। মহারানী দ্রৌপদী ধর্মরাজকে বললেন—’ছোট ভাইকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে গান গাইতে নিষেধ কর। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কথামত প্রাঙ্গণে এসে দেখলেন—তাঁর মধ্যম ভাই উল্লসিত হয়ে ভজন গাইছে। তিনি ভাইকে স্নেহসিক্ত স্বরে বললেন, ”ভাইয়া, ভগবানের নাম সংকীর্তন অতি উত্তম কর্ম, তুমি যদি একান্তে বসে এই নাম সংকীর্তন কর, তাহলে আরও উত্তম হয়। কারও নিদ্রায় বিঘ্ন ঘটিয়ে নাম সংকীর্তন করা উচিত নয়। নিজের ধর্ম যেন অপরের কষ্টের কারণ না হয়—এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।”
ভীমসেন অগ্রজের কথা মেনে নিলেন। কিন্তু আরও উদাস হয়ে গেলেন। তাঁর কন্ঠ সুরেলা নয়। এতে তাঁর কি দোষ? তিনি রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে পদব্রজে রাত্রির শেষ প্রহরের কিছুপূর্বে যমুনার তটে উপস্থিত হলেন। নিস্তব্ধ রাত্রি, মেঘ মুক্ত আকাশে শীতল জ্যোৎস্নামৃতবর্ষী চন্দ্রদেব গগনে দীপ্যমান। পদব্রজে ভীমসেন যে প্রাসাদ থেকে অনেকখানি পথ চলে এসেছেন, এ খেয়াল তাঁর নেই। যমুনার তীরে এসে তিনি চারিদিক দৃষ্টিপাত করে দেখলেন—এখানে কেউ শুয়ে নেই। এখানে যদি নাম সংকীর্তন করি তাহলে কারও নিদ্রায় বিঘ্ন ঘটবে না। যমুনার তটে বসে মেঘনিনাদী কন্ঠে শুরু করলেন সংকীর্তন—
”প্রাণ গোপাল, কৃষ্ণ গোপাল, …গোপাল রে।
একবার এসে দাও হে দেখা আমারে।
মুকুন্দ গোবিন্দ গোপাল কৃষ্ণ মধুসূদন
দয়া করে আমায় কর একটু কৃপা বরিষণ
প্রাণ গোবিন্দ পরমানন্দ কৃপা কর কৃপা কররে।।
ভীমসেন নাম সংকীর্তন করতে করতে তন্ময় হয়ে গেলেন। দুঃখী, উদাস-বিষণ্ণমনা চিত্ত তার প্রসন্নতায় ভরে গেল। অর্দ্ধ-উন্মিলিত নেত্রপথ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে। শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে, কন্ঠ নাম রসে ভিজে ভারী হয়ে গেছে। (ভীমসেন মনে মনে ভাবে তাঁর কন্ঠ বড়ই শ্রুতিমধুর)। সাধারণত সঙ্গীতের স্বর শুনে বনের হরিণ মুগ্ধ হয়। কিন্তু ভীমের সঙ্গীত শুনে বনের হরিণ তো দূরের কথা সিংহও ভয় পেয়ে বনের গভীরে পালিয়ে গেল।
এই মুহূর্তে একজন আছেন ইন্দ্রপ্রস্থে যিনি ভীমের নাম-সংকীর্তনে মুগ্ধ হয়ে ঐ রাত্রেই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ভীমের কাছে এসে উপস্থিত হন। তিনি এমনই এক ব্যক্তিত্ব যাকে সুর-তাল-ছন্দাদি বাহ্য উপকরণ দ্বারা বশীভূত বা প্রসন্ন করা যায় না।
তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় সুরবেসুর দেখে না। দেখে সুরে কতখানি প্রেম মিশে আছে। প্রেমের ভাষা প্রেমের স্বাদ গ্রহণের জন্য তিনি সদা পিপাসু। ভীমের কন্ঠস্বর যতই কর্কশ-কটু হোক না কেন, সে তো প্রেমে মত্ত হয়ে নাম-সংকীর্তন করছে, তিনিও সেখানে তদ্রুপ তন্ময় হয়ে মৃদু মৃদু নৃত্য শুরু করলেন। পদ্মনয়ন দিয়ে তাঁর টপটপ করে মাটিতে অশ্রু ঝরে পড়ছে। শরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত—তিনি ধীরে ধীরে করতালি দিতে শুরু করেন। করতালির শব্দে ভীমের তন্ময়তার ঘোর কেটে যায়। সংকীর্তন বন্ধ হয়ে যায়। আঁখি খুলে সামনে কৃষ্ণকে দেখে আশ্চর্য হয়ে ভীম বললেন, ”কৃষ্ণ তুমি এখানে এই সময়ে? (নরলীলায় শ্রীকৃষ্ণ ভীমের কনিষ্ঠ ছিলেন, তাই ভীম তাঁকে নাম ধরেই সম্বোধন করতেন।)
শ্রীকৃষ্ণ আপন উত্তরীয় দিয়ে নিজের নয়নের অশ্রু ও ভীমের নয়নের অশ্রু মুছে দিয়ে বললেন, ‘ভাই ভীমসেন, তুমি যে এত মধুর সুরে সংকীর্তন করতে পার তা আমি আগে জানতাম না। আজ তোমার নাম-সংকীর্তন আমাকে বড় আনন্দ দিয়েছে। আমি প্রসন্ন—তুমি বর প্রার্থনা কর। তোমার মন যা চায় তুমি তাই প্রার্থনা কর। তোমাকে অদেয় আমার কিছু নাই।’
ভীমসেন কৃষ্ণের কথা শুনে একবার মুহূর্তের জন্য ভাবলেন, কৃষ্ণ তাকে উপহাস করছে না তো? অনতিপূর্বে উত্তরীয় দিয়ে নিজের নয়নের এবং তাঁর নয়নের অশ্রু মুছে দিয়েছে কৃষ্ণ … একথা মনে হতেই ভীম নিশ্চিন্ত হল। মনে মনে ভাবল আমার গান যখন কৃষ্ণের ভালো লেগেছে তখন সংসারের অন্যান্য সকলের ভালো লাগুক ছাই না লাগুক, তাতে আমার কী আসে যায়। আমার কীর্তন শুনে কৃষ্ণ খুশী হয়েছে আনন্দ পেয়েছে আমার আর কী পাওয়ার বাকী আছে যা তার কাছে চাইব?’
—’বর প্রার্থনা কর, মধ্যম ভ্রাতা’—কৃষ্ণ পুনরায় অনুরোধ করেন। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ভীম বললেন,—’জগতের মুনি-ঋষিরা বার বার তোমার মায়া নিয়ে নানা কথা বলেন। আমি ওই মায়াকে দেখতে চাই।’
—ভ্রাতা ভীমসেন, আমাকে দেখ। আমার মায়াকে দেখে কী করবে?”—শ্রীকৃষ্ণ অনীহা প্রকাশ করেন।
ভীম বললেন—’তোমাকে তো দেখছি, দেখবও কিন্তু তোমার মায়াকে দেখিনি—তাই হে কৃষ্ণ বর দিতে যদি অভিলাষী হও, তবে তোমার মায়াকে একবার আমায় দেখাও’।
—তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক মধ্যমপাণ্ডব। আগামী রাত্রির প্রথম প্রহরে তুমি পুনঃ এই যমুনা তটে এসে ঐ যে বটবৃক্ষ দেখছ, ঐ বটবৃক্ষের শাখায় আরোহণ করে আত্মগোপন করে থাকবে। বটবৃক্ষের সামনে যে বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর, শাখায় আত্মগোপন করে তা সাবধানে প্রত্যক্ষ করবে। উভয়ে বাক্যালাপ করতে করতে প্রাসাদের দিকে রওনা দিলেন।
ভীমসেন, শ্রীকৃষ্ণের কথামত পরের দিন রাত্রির প্রথম প্রহরে নিদিষ্ট স্থানে উপনীত হয়ে বটবৃক্ষে আরোহণ করে শাখায় আত্মগোপন করে রইলেন। বটবৃক্ষের সামনে যে বিশাল উন্মুক্ত সমতল প্রান্তর ছিল তার আশেপাশে কোন তরুলতা ছিল না। যমুনার তট হতে কিছুটা দূরে বনের মধ্যে অবস্থিত এই প্রান্তর। প্রান্তরের মধ্যে শুধু ঐ বটবৃক্ষটি মাথা তুলে একাকী দাঁড়িয়ে আছে। ভীমও একাকী ঐ বৃক্ষের পত্রশাখার অন্তরালে লুকিয়ে রইলেন। চন্দ্রকৌমুদী স্নাত বন প্রান্তর বড়ই মনোরম। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক-বন্যপশুর রাত্রি বিচরণ-অদূরেই যমুনার কলকল নাদ প্রাকৃতিক পরিবেশকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। ভীমসেন বৃক্ষশাখা থেকে প্রান্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখেন কতগুলি জ্যোতির্ময় দেহধারী পুরুষ ঐ প্রান্তরে সমবেত য়ে প্রান্তরটিকে দিব্য-সর্ম্মার্জনী দিয়ে পরিষ্কার করছেন। পরিষ্কার অন্তে তরল সুগন্ধি দিব্য পাত্র হতে পারিজাত-মন্দার পুষ্প যোগে প্রান্তরময় ছিটিয়ে দিচ্ছেন। বিস্তৃত প্রান্তরে বহুমূল্য আস্তরণ বিছিয়ে দিলেন। অতঃপর আরও অনেক জ্যোতির্ময় দেহধারী পুরুষ (বোধহয় সব দেবতাই হবেন, ভীম ভাবছেন) অনেকগুলি রত্নখচিত সিংহাসন সহ সেখানে উপনীত। সিংহাসনগুলিকে শ্রেণীবদ্ধভাবে স্থাপন করলেন। প্রান্তর মধ্যে এক দিব্য বেদী নির্মাণ করে তার উপর একখানি জ্যোতির্ময় বৃহৎ সিংহাসন স্থাপন করলেন। দেখে মনে হয় কোন রাজাধিরাজ ঐ সিংহাসন অলঙ্কৃত করবেন। এর কিঞ্চিত নিম্নভূমিতে আর একখানি অপেক্ষাকৃত কম জ্যোতির্ময় রত্নসিংহাসন স্থাপন করা হল। এর কাছেই পূর্বাপেক্ষা আরও কম জ্যোতির্ময় ছয়খানি সিংহাসন তিন জোড়ায় অর্থাৎ পরস্পর সংলগ্ন করে পাশাপাশি স্থাপিত হল। বটবৃক্ষের শাখা থেকে ভীম দেখছেন এইসব দৃশ্য আর ভাবছেন—আজ নিশ্চয়ই এখানে দেবতাদের কোন সভা-টভা হবে। বৃহৎ জ্যোতির্ময় ও অপেক্ষাকৃত কম জ্যোতির্ময় সিহাসনগুলির চারপাশে অজস্র সিংহাসনের পংক্তি রচনা করা হল। আকাশে চন্দ্রদেব কিরণ দিচ্ছেন। দেবতাদের শরীরও জোতির্ময় আলো দিয়ে তৈরী-তৎসত্বেও প্রজ্বলিত মশাল হস্তে দেবসেবকরা স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। সশস্ত্র প্রহরীরাও আপন আপন স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে দেব-প্রধানরাও উপনীত হলেন। ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, কুবের, যম সকলেই সুসজ্জিত পোষাকে বাহন সহ সেখানে উপস্থিত হতেই-ভীমসেন বাহন দেখে তাদের চিনে ফেললেন। বাহন দূরে সরিয়ে রেখে, দেব সেবকরা তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট পংক্তিস্থিত সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন।
দেবতা, গন্ধর্ব, কিন্নর প্রধান সব সমবেত হয়েছেন। মহর্লোক, জনলোক, তপোলোক তথা সত্যলোক হতে সব মহর্ষিরাও এসেছেন। পৃথিবীর প্রধান প্রধান তপস্বী-মুনি-ঋষি বিদ্বানরাও উপস্থিত হয়ে আপন আপন আসন গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরও রয়েছেন। অনেকের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে চিনে নিতে ভীমসেনের অসুবিধা হল না।
শেষে এলেন হংসবাহনে চেপে সাবিত্রীসহ ব্রহ্মা। গরুড়াসনে উপবিষ্ট হয়ে এলেন লক্ষ্মী নারায়ণ, বৃষভারূঢ় হয়ে এলেন শিব-পার্বতী। তিন দেব-দম্পতি পূর্বকথিত তিন জোড়া রত্ন সিংহাসনের উপর উপবেশন করলেন। বট-শাখায় আরূঢ় হয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ভীমসেনের হৃদয়ে একটি প্রশ্ন উত্থিত হয়ে তাঁর সমগ্র হৃদয়কে তোলপাড় করে তুললো। তাঁর ভাবনায় স্পন্দন হতে লাগলো—ঐ বিশাল উঁচু জ্যোর্তিময় সিংহাসনে কে বসবেন? অল্প নিম্নে অপেক্ষাকৃত কম জ্যোতির্ময় সিংহাসনেই বা কে উপবেশন করবেন? ভীমসেনের এই ভাবনাজনিত আলোড়ন বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। তিনি অবাক চোখে চেয়ে দেখলেন, তাদের প্রিয়সখা শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র আসছেন। সমস্ত দেবতারা, তাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। ইন্দ্রাদি দেবতাদের দিকে তিনি নামমাত্র দৃষ্টিপাত কলেন। ত্রিদেব দম্পতির সাথে অল্পক্ষণের জন্য কুশলাদি বিনিময় করে তিনি অপেক্ষাকৃত কম জ্যোতির্ময় দ্বিতীয় রত্নসিংহাসনের উপর উপবিষ্ট হলেন। হঠাৎ সব উঠে দাঁড়ালেন। মিলিত কন্ঠে জয়ধ্বনি উচ্চারিত হল—”আদ্যাশক্তি যোগমায়া কী জয়! যোগমায়া কী—জয়! পরমজননী কী—জয়! সবাই যুক্ত করে মস্তকনত করে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। অপলক নেত্রে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ভীমসেন দেখছেন মহারানী দ্রৌপদী প্রবেশ করছেন এবং কারও দিকে দৃষ্টিপাত না করে তিনি সর্বাপেক্ষা জ্যোতির্ময় বৃহৎ সিংহাসনখানি অলংকৃত করলেন। ত্রিদেব দম্পতিসহ সকলে নতশিরে প্রণাম জানালেন—তিনি মৃদু হাসির বিনিময়ে তাদের প্রণাম গ্রহণ করলেন। অল্প নিম্নস্থিত জ্যোতির্ময়ী সিংহাসনে সমাসীন কৃষ্ণের দিকে চেয়ে দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করলেন—’সব এসে গেছে? কৃষ্ণ বললেন, পাণ্ডবরা কিছুক্ষন আগে এসেছেন।’
দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভীম কোথায়? ভীমকে দেখছি না কেন?’ তাঁর রক্ত পাণ না করা পর্যন্ত আমার হৃদয়ের প্রজ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত হবে না। দ্রৌপদীর তেজদৃপ্ত কন্ঠের বাক্য শুনে বটবৃক্ষস্থিত ভীমসেনের সারা শরীরে ঘাম দেখা দিল। তাঁর মত বীরও ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন। যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব যে স্থানে আসন অলংকৃত করে বসে আছেন, দ্রৌপদী সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন। আমার হৃদয়ের প্রজ্বলিত ক্ষুধাগ্নিকে শান্ত করার দায়িত্ব তোমাদের এটা যেন স্মরণ থাকে। বল, ভীমসেন কোথায়? চারভাই উঠে দাঁড়িয়ে কম্পিত স্বরে বললেন—’ও রাজপ্রাসাদে নেই’।
—’অনুসন্ধান করে দেখ সে কোথায়?’ দৃপ্ত কন্ঠে আদেশ করার ভঙ্গিতে বলেন মহারানী দ্রৌপদী।
উক্ত সভায় দেবর্ষি নারদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে যুক্ত করে বললেন—’যদি অনুমতি দেন তাহলে বলি, ভীম কোথায়।’ দ্রৌপদী অনুমতি দান করলে নারদ বললেন—’ভীমসেন বর্তমানে এই প্রান্তরের নিকটবর্তী বৃক্ষের শাখায় লুকিয়ে বসে আছেন।
দ্রৌপদী কড়া সুরে নির্দেশ দেন—’ধরে নিয়ে এস তাকে।’ আদেশ পাওয়া মাত্র দেব সেবকরা জলন্ত মশাল হাতে বটবৃক্ষের দিকে এগিয়ে যান। ভীমসেন তাদের আসতে দেখে ভয়ে বটবৃক্ষ থেকে নীচে লাফিয়ে পড়লেন। নীচে পড়েই ভীমসেন চকিত নয়নে এদিক ওদিক চাইতে থাকেন। কোথায় দেব-সেবক? কোথায় দেবতা? দেবসভাই বা গেল কোথায়? ঋষি-মুনি-পাণ্ডব দ্রৌপদী সব উধাও। কোথাও কিছু নেই। বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরও পরিস্কৃত। ভীমসেন বিস্মিত ভয়ার্ত হৃদয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে চলতে শুরু করেন। পথে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি ভীমকে দেখে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই ভীমসেন, তোমাকে এত ভীত সন্ত্রস্ত, বিষণ্ণ চঞ্চল দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি আমার মায়ার দেখা পেয়েছ?”
—’দেখেছি কৃষ্ণ, তোমার মায়াকে আমি দেখিছি, কিন্তু কৃপা করে এইরকম মায়া তুমি আমাকে আর কখনও দেখিও না।’ অনুনয়ের সুরে ভীম কৃষ্ণকে অনুরোধ জানায়।
ভীমসেনের সঙ্গে কৃষ্ণ রাজভবনে ফিরে আসেন। ভীমের মুখ নীচু হয়েই আছে, তিনি কারও সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে পারছেন না। সবসময় উদাস বিষণ্ণ হয়েই থাকছেন, মাতা কুন্তী তা লক্ষ্য করে, কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ভীমসেন সেদিন রাত্রে বটতরু শাখায় লুকিয়ে থেকে যা দেখেছিলেন মাকে সব প্রকাশ করে বললেন। মা সব শুনে বললেন, ‘এতে ভয় পেয়ে বিস্মিত হওয়ার কি আছে?” ভীম বললেন, ‘মা, শ্রীকৃষ্ণ যা দেখিয়েছে তা নিরর্থক নয়।’ আমি বুঝেছি দ্রৌপদী স্বয়ং আদ্যাশক্তি যোগমায়া, কিন্তু ওর হৃদয়ের অপূর্ণ পাত্র আমার রক্ত ছাড়া পূর্ণ হবে না, এই কথাটা মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। মাতা কুন্তী ভীমকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কাল প্রাতে দ্রৌপদী যখন আমায় প্রণাম করতে আসবে, তখন তুই আমার পেছনের কক্ষে লুকিয়ে থাকবি—তাহলে তোর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
পরদিন প্রভাতে দ্রৌপদী যখন শশ্রুমাতা কুন্তীদেবীর চরণ বন্দনা করার জন্য উপনীত হন তখন কুন্তীদেবী বৌমাকে আশীর্ব্বাদ করার পর বললেন, ‘বৌমা আজ আমি তোমার কাছে কিছু প্রার্থনা করবো। তুমি কথা দাও তা পূরণ করবে?’
দ্রৌপদী বললেন,—”নিঃসঙ্কোচে বলুন, কি আপনার প্রার্থনা বৌমা?”
তুমি আমার পঞ্চপুত্রের জীবন বরদান কর।
দ্রৌপদী বর প্রার্থনা শুনে সহসা চমকে উঠেন, পরে নতশিরে শশ্রুমাতাকে বলেন, ‘তথাস্তু! মাতাজী।’
এই ঘটনা যদি ইন্দ্রপ্রস্থের অন্দরমহলে না ঘটতো—তাহলে মহাভারতের যুদ্ধস্থলে আমরা কী ভীমকে পেতাম? এর উত্তর আমার, জানা নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন