সেদিন দ্বারকার রাজপথে বহুলোকের সমাগম হয়েছে। বালক-বৃদ্ধ-যুবা-নারী সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক বহুরূপীর বিচিত্র সাজ ও নৃত্য দেখে আনন্দ উপভোগ করছে। বহুরূপী কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না কিন্তু সবাই তার নাচ বিচিত্র সাজ এবং কণ্ঠ নির্গত গান উপভোগ করছে—বহুরূপী নৃত্যের তালে গানের ছন্দে বলছে—”বহুরূপে বহুরূপী কৃষ্ণ কানাই, তাঁর কাছে আমা হেন ক্ষুদ্র বহুরূপীর তুলনা হয় না ভাই।” কৃষ্ণকে বহুরূপী বলায় সমবেত জনতার মধ্যে অনেকেই ক্রোধে লাল হয়ে উঠলেন। এমন সময় সেখানে উপনীত হলেন কৃষ্ণ অগ্রজ বলরাম। তিনি বহুরূপীর চালচলন কথাবার্তা শুনে বিস্মিত হলেন—বহুরূপীকে বললেন,—’চলো আমাদের রাজসভায়—সেখানে তোমার এই বিচিত্র বহুরূপীর বেশ দেখাবে এবং গান শোনাবে—যদি সবাই তোমার বেশ দেখে , কথা শুনে খুশী হয় তাহলে তুমি আশাতীত পুরস্কার পাবে।’ বলরামের কথায় সম্মতি জানিয়ে বহুরূপী চললেন দ্বারকার রাজসভায়, সঙ্গে বলরাম ও দ্বারকার অগণিত নরনারী। রাজসভায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত মহারাজ উগ্রসেন—পাশে অন্যান্য আসনে উপবিষ্ট দ্বারকার বিশিষ্ট মন্ত্রীমণ্ডলী ও নাগরিকবৃন্দ। শ্রীকৃষ্ণও রয়েছেন সেখানে একটি আসন অলংকৃত করে। এমন সময় সেখানে বলরাম-এর সঙ্গে বহুরূপী উপস্থিত হয়ে গান ধরলেন—”বহুরূপে বহুরূপী কৃষ্ণ কানাই—বিশ্বজগৎ এত বড় বহুরূপী কভু দেখে নাই।” বহুরূপীর মুখে একথা শুনে রাজসভার লোক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন—কে বললেন—”কি অসভ্য এই বহুরূপী, কোন শিষ্টাচার নেই—আমাদের কৃষ্ণকে বলে কিনা বহুরূপী। কেউ বলেন এই অভদ্র বহুরূপীটাকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিৎ। কেউ বলেন ওকে কারাগারে ভরে দাও। বহুরূপীর বেশে ওটা একটা অসভ্য ছাড়া কিছুই নয়।
সভার একপ্রান্তে বসে শ্রীকৃষ্ণ ভালো করে লক্ষ্য করলেন বহুরূপীকে। বহুরূপীকে দেখতে দেখতে শ্রীকৃষ্ণের অধরে ফুটে উঠলো হাসি। তিনি বহুরূপীকে চিনতে পেরেছেন তাই হাসছেন। অন্যদিকে বহুরূপীও কৃষ্ণের হাসি লক্ষ্য করে কৃষ্ণের হাসির চেয়ে জোরে হেসে উঠলেন। বহুরূপীর জোর হাসিতে সভাসদরা রেগে উঠলেন এবং কিছু সভাসদ বহুরূপীকে কটু বচন শোনাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই—কৃষ্ণ হাতের ইশারায় নিষেধ করলেন। দাদা বলরামের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”দাদা এই বহুরূপীকে তুমি কোথায় পেলে?’ বলরাম বললেন, ‘দ্বারকার রাজপথে এই বহুরূপী আপন ভাবভঙ্গী দ্বারা অনেক নরনারীকে হাসাচ্ছিল ও আনন্দ প্রদান করছিল। তা দেখে আমি ভাবলাম একে রাজসভায় নিয়ে যাই। রাজসভায় রাজা ও অমাত্যবৃন্দ এর ভাবভঙ্গী দেখে আনন্দ পাবে—বিদূষকবেশী এই বহুরূপীকে দেখে আমিও হাসি সম্বরণ করতে পারি নাই। তাই সবাই যাতে আনন্দ পায় সেইজন্য রাজসভায় একে নিয়ে এলাম।
শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপীর দিকে চেয়ে বললেন ওহে বহুরূপী ভাই, তোমার যা রূপ, ঐ রূপ দেখেই লোকের হাসি পায়, তার উপর তোমার যা ভাবভঙ্গী লোক হাসানোর পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু বহুরূপী ভাই তুমি সবার সামনে আমাকে বহুরূপী কেন বললে? বহুরূপী তো তুমিই সেজেছ ভাই—আমাকে আবার দলে টানছো কেন? কৃষ্ণের কথা শুনে বিদূষকবেশী বহুরূপী সঙ্গে সঙ্গে আপন ভাবভঙ্গী পরিবর্তন করে বললেন,—’আজ তো আপনি দ্বারকার সবার হৃদয় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বিরাজ করছেন। পুরনো দিনের কথা ভুলে গেছেন। মনে মনে একবার আপনার পুরনো রূপের কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন প্রভু। শ্রীকৃষ্ণ—”আমি সব সময়ই একরূপ ও একরসে নিবাস করি। তোমার মত ঘন ঘন রূপ বদলিয়ে বহুরূপী সাজা আমার অভ্যেস নেই।”
—আমি যদি আপনার পুরনো রূপরস ধারণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিই তাহলে খারাপ কিছু ভাববেন না তো? শ্রীকৃষ্ণ হাসতে হাসতে বললেন, ‘না না, খারাপ কিছু ভাববো না—তুমি পারলে স্মরণ করিয়ে দাও আমি কখন কখন বহুরূপ ও রসের আশ্রয় থেকে তোমার মত বহুরূপী সেজেছিলাম।’
বিদূষকবেশী বহুরূপী তখন বলতে শুরু করলেন শ্রীকৃষ্ণের নবরস সমৃদ্ধ বহুরূপী লীলা নাট্যকথা, ‘হে প্রভু, আপনি মৎস্যরূপ ধারণ করে করুণরস প্রদর্শন করেছেন, কূর্মরূপ ধারণ করে অদ্ভুতরসের বিকাশ করেছেন, বরাহরূপে বীভৎরস, বামনরূপে হাস্যরস, নৃসিংহরূপ ধারণ করে ভয়ানকরস, পরশুরাম রূপে রৌদ্ররস, রামরূপে বীররস প্রদর্শন করেছেন। হে দীনবন্ধু দ্বারকাধীশ, আপনি তো ভগবান। অনেক অনেক লীলাও করেছেন। আপনি তো রসরাজ, সমস্ত নবরস আপনি আমার কাছেই রেখেছেন। আমি তো কেবল পেট চালানোর জন্য একটি রস হাস্যরসের আশ্রয় নিয়েছি। অতএব আপনি আমায় দেখে কেন হাসছেন প্রভু?
পরম পবিত্র নবরস তোমার অধীন।
শুধু এক হাস্যরসের আশ্রয় নিয়েছে এ দীন।।
বহুরূপীর বলা শেষ না হতেই কৃষ্ণ বললেন, ‘ঠিক আছে; আমি না হয় সমস্ত রস নিয়ে রেখেছি কিন্তু তুমিও তো বহুরূপী সেজে শৃঙ্গাররস চুরি করে নিয়েছো?
একথা শুনতেই বিদূষকবেশী বহুরূপী সঙ্গে সঙ্গে বিদূষকরূপ বদল করে মনোহর গোপীরূপ ধারণ করে শৃঙ্গার রস প্রদর্শন করতে আরম্ভ করলেন। সভাস্থ সব লোক তা দেখে হেসে লুটোপুটি। গোপীরূপী বহুরূপী পালা করে মাখন চুরির কাহিনী শোনাতে শুরু করলেন। দ্বারকার রাজসভা তা শুনে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠলো। শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হয়ে আপন কন্ঠের বহুমূল্য মোতি রত্নহার বহুরূপীকে দিয়ে দিলেন। বহুরূপী তা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে রত্নমালার প্রতিটি দানা ভেঙে ভেঙে দেখলেন এবং কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন—
মোতি রত্নমালায় নাহি মোর কাম।
আমি চাই তব প্রেম-তব নাম।।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘তুমি বড় চতুর অভিনেতা, বহুরূপীভাই।’ বহুরূপী বললেন—ঠিক আছে প্রভু—আমি তাহলে এখান হতে খালি হাতেই ফিরে যাই। যাওয়ার সময় দ্বারকার রাজপথের অলিতে গলিতে চীৎকার করে বলে যাবো দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধুর হৃদয়ে রত্নভাণ্ডার খালি হয়ে গেছে। আমার মতো দীন দরিদ্র যারা তাদের তিনি আশীর্বাদ করতেও ভুলে যান। বহুরূপীর মুখের কথা শেষ না হতেই শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপীকে কাছে ডাকেন। বহুরূপী কৃষ্ণের কাছে গিয়ে কৃষ্ণের শ্রীচরণ দুটি চেপে ধরেন এবং নয়নের জল দিয়ে ধুয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপীর মাথায় পদ্মহস্ত রেখে আশীর্বাদ করেন, তারপর একসময় শ্রীকৃষ্ণ বহুরূপীকে চরণ থেকে তুলে বুকে চেপে ধরেন—সারা রাজসভা হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। চমকে ওঠেন সবাই। বলরাম, উদ্ধব এবং অন্যান্য সকলে প্রেমচক্ষে দেখেন ধনুর্ধারী শ্রীরাম আপন ভক্ত হনুমানকে হৃদয়ে চেপে ধরে আছেন। সেদিন থেকে ভক্ত-ভগবানের মিলনকে কেন্দ্র করে দ্বারকাবাসীর মুখে মুখে ঘোষিত হয় দুই লাইনের একটি গান—
ভক্তকে ভালোবেসে পুরস্কার তুমি যা দিলে প্রভু—
জগৎ মাঝারে তাহা, পায় নাই কেহ কভু।।
সেই বহুরূপীরে সবাই ধিক্কার জানায়।
যে কখনও আসেনি কৃষ্ণের দরজায়।।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন