তসলিমা নাসরিন
কিছু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্মের প্রভাবে, বাঙালি সমাজের প্রভাবে বাঙালি সমাজের নিয়মনীতি গড়ে উঠেছে। তৃতীয় বিশ্বে বাস বলে অধিকাংশ বাঙালি নিম্নবিত্ত, মানবেতর জীবনে অভ্যস্ত। গুটিকয় বিত্তশালী, বাকিরা মধ্যবিত্ত জীবনে মাঝারি মাপের শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে ধর্মকে মূলমন্ত্র বলে মানে।
বাঙালি পরিবারে মেয়ে-জন্ম কখনও কাঙ্ক্ষিত নয়। কাঙ্ক্ষিত নয় এই কারণে যে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা কোনও মেয়েকেই মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। ছেলে জন্মালে বাঙালি মুসলমান জন্মের আনন্দ প্রকাশ করতে আঁতুরঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আজান দেয়, মুসলমানের জন্য ‘আজান’ পবিত্র একটি আহ্বান। মেয়ে জন্মালে আজান দেবার নিয়ম নেই। ছেলে জন্মালে ‘আকিকা’ নামক অনুষ্ঠানে একটি গোরু বা দুটো খাসি ‘কোরবানি’ করতে হয়, আর মেয়ের বেলায় একটি খাসি হলেই চলে।
জন্মের বৈষম্যের পরপর শুরু হয় শৈশব-কৈশোরের বৈষম্য। বাঙালি মেয়ে-শিশুর জন্য শিক্ষা অর্জন এক সময় নিষিদ্ধ ছিল। হিন্দুধর্মে ছেলেদের উপনয়ন হয়, মেয়েদের হয় না, যাদের উপনয়ন হয় না, তাদের জন্য বেদশিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। মুসলমান ছেলেরা বইখাতা হাতে স্কুলে লেখাপড়া করতে যায়, মেয়েরা ঘরে বসে রান্নাবান্না, ঘর সংসারের কাজ করে। মূলত মেয়েদের শরীর ও মনকে ঘর সংসারের কাজে অভ্যস্ত করবার জন্যই এই ব্যবস্থা।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে মেয়েদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয়। মেয়েদের প্রথম নিয়মিত স্কুল খোলা হয় ১৮১৯ সালে। মিশনারিরা খুলেছিলেন। বাঙালির উদ্যোগে প্রথম মেয়ে-স্কুল বারাসাতের বিদ্যালয় খোলা হয় ১৮৪৭ সালে। ১৮৫০ সালে খোলা হয় বেথুন স্কুল। বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচারের ফলে তেইশজন ছাত্রীর মধ্যে ষোলোজনই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে তখন এ-ধরনের রুচিহীন আলোচনা পত্রপত্রিকায় লেখা হত—‘বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংঘটনের শঙ্কা আছে, কেন-না বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎ পুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িবে না, কারণ খাদ্য-খাদক সম্পর্ক।…ধনবানদিগের কন্যারা পথিমধ্যে ভৃত্য দ্বারা রক্ষিত হইয়া গমন করিলে তথাপি কৌমার হরণের ভয় আছে, কেননা রক্ষকেরাই স্বয়ং ভক্ষক হইবে।’
ধর্ম বলে, নারীকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে। পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে যদি কিছুর উৎপত্তি হয় তবে মানুষ হিসেবে সে সম্পূর্ণ নয়— এ-কথায় কারও দ্বিধা নেই নিশ্চয়ই। নারীকে পরদার ভেতর থাকতে হবে, আপন বাবা, ভাই, চাচা, মামা ইত্যাদি হাতেগোনা ক’জন আত্মীয় ছাড়া আর কোনও পুরুষের সামনে আসা তার নিষেধ। মুসলমান নারীকে অবরোধে রাখবার জন্য ধর্মের শৃঙ্খল সবচেয়ে বড় শৃঙ্খল; এই শৃঙ্খলের কারণে অধিকাংশ মেয়ে আজ নিরক্ষর, উত্তরাধিকার-বঞ্চিত, বাল্যবিবাহ, তালাক ও বৈধব্যের নির্যাতনের শিকার।
বাঙালি হিন্দু মেয়েরা পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। (এটি অবশ্য বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য। ভারতে হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট ১৯৫৬ অনুসারে পিতার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের অধিকার সমান।) বাঙালি মুসলমান মেয়েরা যা পায় তা ছেলের অর্ধেক, অবশ্য তা কেবলই কাগজপত্রে। বাস্তবে মেয়েদের ভাগ্যে প্রায় জোটে না কিছুই। মেয়েদের জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে এই যৎসামান্য পাওয়া এবং কিছুই না পাওয়া—তাদের মর্যাদা খর্ব করেছে সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা পিতার সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি যেমন পায় না, তেমন মানুষ হিসেবে সম্মানও পায় না।
বয়ঃপ্রাপ্তির পরপর বাঙালি মেয়েদের আগলে রাখতে হয় সবচেয়ে বড় এক সম্পদ, ধর্ম এবং সমাজ শিখিয়েছে এই সম্পদের নাম সতীত্ব। সতীত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেই মেয়েদের মূল্য সমাজে বেশি। মূল্য এই অর্থে যে, লোকে তাকে অপাঙ্ক্তেয় বা অস্পৃশ্য ঘোষণা করবে না। পৃথিবীতে প্রচলিত প্রতিটি ধর্মেই মেয়েদের সতীত্বের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ধর্মেই পুরুষের জন্য কোনও ‘সতীত্বে’র ব্যবস্থা নেই। বাংলা অভিধানে সতীর পুংলিঙ্গ কোনও প্রতিশব্দ নেই। এর অর্থ এই, পুরুষের জন্য একগামিতার প্রয়োজন নেই, তার জন্য গণিকালয়ে যাবার সুযোগ ধর্ম এবং সমাজ দুই-ই করে রেখেছে, তার জন্য চারটি বিয়ে ‘হালাল’ করা হয়েছে ইসলাম ধর্মে, তার ‘ভোগের’ জন্য ঘরের দাসীকেও বৈধ করা হয়েছে।
পতিসেবা নারীর পরম ধর্ম। ‘পতি ধর্ম, পতি কর্ম, পতি সারাৎসার। পতি ভিন্ন রমণীর গতি নাই আর।/ পতি আজ্ঞা, সতী পক্ষে, বেদের সমান/ পতি তুষ্ট হলে, তুষ্ট প্রভু ভগবান।’ ‘রমণীর পতি বিনা গতি নাই/পতির বিষয়ে বিশেষ জানাই। পতি যা বলেন তাহাই করিবে/ পরম যতনে পতিকে সেবিবে। পতি খেলে খাবে, না খেলে খাবে না। পতি শুলে শোবে, না শুলে শোবে না।’ সতী হবার জন্য এইসব সারকথা নারীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো হত। এখনও হয়, যদিও রাধাকান্ত দেব, গৌরমোহন বিদ্যালংকার, রাজা বৈদ্যনাথ রায়, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যাণে মেয়েদের জন্য শিক্ষা জুটছে, তবু এখনও বাঙালি মুসলমান মেয়েরা জানে স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেশত। জানে স্বামীকে তুষ্ট রাখতে পারলে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা খুশি হন। তাই বেহেশতের লোভ দেখিয়ে স্বামীর পদসেবায় স্ত্রীদের নিয়োজিত রাখা এক ধরনের কৌশল, ধর্মের এবং সমাজের।
বাঙালি মেয়েরা স্বামী ও পুত্রের এঁটোকাঁটা খেয়ে ধর্মীয় পুণ্য অর্জন করে। এতে স্বামীসেবাও হয়, ধর্মরক্ষাও হয়, কিন্তু যা হয় না—তা হচ্ছে স্বাভাবিক পুষ্টিরক্ষা। পুষ্টির অভাবে বাঙালি মেয়েরা অধিকাংশই স্বাস্থ্যহীন, শ্রীহীন এবং কিছুটা মেধাহীনও বটে। নারী কেবল পুরুষের যৌনসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলাম ধর্মে নারীর যৌনঅঙ্গ হিফাজত করবার কথা বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে, ‘নারী হচ্ছে তোমাদের শস্যক্ষেত্র, এই শস্যক্ষেত্রে তোমাদের যেভাবে ইচ্ছা গমন করো।’ নারীকে অবাধ ভোগের কথা সকল ধর্মই বলেছে, নারীকে মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে উপঢৌকন দেবার কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত অঞ্চলের নারীকে ভোগের বস্তু করা সকল ধর্মেই স্বীকৃত।
বাঙালি নারী কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে চুড়ি বা শাঁখা পরে এয়োতির চিহ্ন বহন করে; যদিও পুরুষের শরীর বিবাহের কোনও চিহ্ন বহন করে না। বৈধব্যের চিহ্নও নারী একা লালন করে। বিধবা নারীকে নানা রকম ব্রত পালন করতে হয়, পোশাক ও আহারে আমূল পরিবর্তন আনতে হয়। কিন্তু বিপত্নীক কোনও পুরুষকে সঙ্গীহীনতার কোনও গ্লানি ভোগ করতে হয় না। নিরামিষ আহারের মূল কারণ বিধবা মেয়ের স্বাস্থ্যহীনতা, শ্রীহীনতার পাশাপাশি যৌনাকাঙ্ক্ষা নিবারণ করা। যদিও বিপত্নীকের জন্য এই সব অনাচার জরুরি নয়।
বাঙালি নারীর কাছে স্বামী হচ্ছে প্রভু, মালিক, মনিব, অধিকর্তা ইত্যাদি। স্বামী-পুরুষকেই নারীর উদ্ধারকর্তা ভাবা হয়। হিন্দু মেয়েরা বিয়ের আগে নানা রকম ব্রত করে, সব ব্রতের মূলকথা স্বামী পাওয়া, পুত্রসন্তানের জননী হওয়া এবং নির্বিঘ্নে সংসার যাপন করা। সংসার যাপনের অর্থ সমাজ এমনই বুঝিয়েছে যে স্বামীসেবা, শ্বশুরকুলের সেবা এবং সকলকে মুগ্ধ করবার জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া।
যে মেয়ে পুরুষ-তৈরি ‘ধর্ম ও আইন’-এর খাঁচায় নিজেকে বন্দি রাখে অথবা বিসর্জন দেয়, তাকে সকলেই খুব ভাল বলে। সকলেই তার সুখ্যাতি করে। এও পুরুষতন্ত্রেরই এক কৌশল, যে নারী খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসে, তাকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা, তাকে সামাজিক নিগ্রহের শিকার করা—যেন যে-কোনও নারীর কাছেই ‘সংসার-খাঁচা’টিই হয় পরম আরাধ্য।
মাতৃত্বের মাহাত্ম্য বর্ণনা হয় সব জায়গায়। কিন্তু সমাজ পিতার পরিচয়কেই অগ্রগণ্য মানে। পিতার নাম ছাড়া কোনও সন্তান কোথাও পরিচিত হতে পারে না। সর্বত্র মাতৃত্বের এই পরাজয় নারীর অবমূল্যায়নের বড় একটি দিক। আইনের দিক থেকেও সন্তানের ওপর পিতার অধিকারই বেশি।
‘বিয়ে’ নামক ঘটনাটি নারীর বিক্রি হওয়ার পদ্ধতি। যৌতুকের বিনিময়ে, দেহমোহরের বিনিময়ে অর্থাৎ মানুষে-মানুষে সম্পর্কের চেয়ে অর্থকড়ির সঙ্গে নারীর একটি ক্রয়বিক্রয়ের সম্পর্ক তৈরি করা হয়। ‘পণ্য’ হিসেবে নারী তখন পাকাপোক্তভাবে সমাজে অধিষ্ঠিত হয়। নারী পণ্য বলেই তাকে পরদায় আবৃত হতে হয়, নারী পণ্য বলেই তার চলাচল নির্দিষ্ট হয় ঘর এবং ঘরের বাইরে মাপা একটি পথ পর্যন্ত, নারী পণ্য বলে নারীর সাজসজ্জার জন্য নানারকম প্রসাধনীর ব্যবস্থা করা হয়।
এই নারী-পণ্যকেই যৌনসামগ্রী এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে ঘরে-ঘরে স্থাপন করা হয় বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। স্বামীর পরিচয়ে নারী পরিচিত হয়। যুগ বদলেছে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, কাজকর্ম করছে, অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও হচ্ছে অনেকের—কিন্তু পিতা বা স্বামীর সংসারে অর্থবৃদ্ধির সহায়তা ছাড়া নারীর জন্য সত্যিকার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটছে না। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও উন্নতি হয়নি, নারীর উপর নির্যাতনের প্রক্রিয়ার কোনও পরিবর্তন হয়নি। নির্যাতন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার, নির্যাতন এই ব্যবস্থার কাঁধের ওপর বসে থেকে আরাম করা নানারকম মানুষের।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন