তসলিমা নাসরিন
প্রাচীন গ্রিসের দুটো মহাকাব্য ইলিয়ড এবং ওডিসির কথা আমরা জানি, জানি ভারতের রামায়ণ ও মহাভারতের কথাও। মহাভারতের অমর কবি মহামনীষী ব্যাস অবিবাহিতা মৎস্যগন্ধার সন্তান ছিলেন। আমরা নিশ্চয়ই মৎস্যগন্ধার কাছে কৃতজ্ঞ।
মোট এগারোটি উপনিষদকে যৌক্তিক বলে মনে করা হয়, ছান্দোগ্য উপনিষদ এদের অন্যতম। ছান্দোগ্য উপনিষদের কাহিনিটি এ-রকম—বহুচারিণী জবালার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুনি সত্যকাম। সত্যকাম ঋষি গৌতমের শিষ্য হওয়ার জন্য গৃহত্যাগ করবার উদ্যোগ নেন। গৃহত্যাগের সময় সত্যকাম মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোন গোত্রে বা বংশে আমি জন্মেছি?’ মা জবালা জবাব দেন—তুমি যে কোন বংশ বা পরিবারের তা তো জানি না। যৌবনে বহু লোকের পরিচর্যা করে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছি। কাজেই তুমি কোন বংশ বা পরিবারের তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার নাম জবালা আর তুমি সত্যকাম। সুতরাং বলতে পারো তুমি সত্যকাম জ্বালা’ অর্থাৎ জবালার পুত্র সত্যকাম। যেমন মরিয়মের পুত্র জিশু।’
শুধু জবালাপুত্র সত্যকাম নয়—গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, কুন্তীপুত্র কর্ণ ও ঘৃতাচীপুত্র দ্রোণ সম্পর্কেও একই কথা। মুনি, কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন প্রমুখ বিশ্বপূজ্য পুরুষেরা জারজ পুত্র। অগণিত বীরপ্রসূ বারাঙ্গনা পৃথিবীকে ধন্য করেছেন।
অজারজ (Born in wedlock) ও জারজ (not born in wedlock) সন্তানে তবে পার্থক্য কী? ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষেরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, স্বয়ং ঈশ্বরই অজারজ ও জারজে কোনও পার্থক্য করেননি। পার্থক্য করেছে আসলে পৃথিবীর মানুষেরা। পৃথিবীর মানুষেরা বৈষম্য নির্মাণ করেছে শ্রেণির, উচ্চবিত্তে-নিম্নবিত্তে, বড় জাতে-ছোট জাতে। তবে কি এ-কথাই সত্য যে, ঈশ্বরের চেয়ে মানুষের স্পর্ধা বেশি মানুষকে ঘৃণা করবার? ঈশ্বর মানুষকে অসম্মান করেননি, কিন্তু মানুষ করেছে। তারা কি ঈশ্বরকে ছাড়িয়ে যেতে চায় প্রভুত্বে এবং কর্তৃত্বে? আমি তাদের এই স্পর্ধা দেখে বিস্মিত হই। মানুষের নিয়মের জালে বন্দি হয় মূলত মানুষই। এই পৃথিবীতে যাবতীয় নিয়ম ও নীতির প্রবর্তক মূলত পুরুষ। তাই পুরুষের তৈরি বিভিন্ন ফাদে নারীই পতিত হয়। পুরুষের তৈরি বিধানের জালে নারীকেই জড়াতে হয় জীবন। ‘জারজ’ শব্দটিকে ঘৃণা করা হয়, ঘৃণা করা হয় ‘জারজ’ সন্তানধারক নারীকে, ঘৃণা কিন্তু পুরুষকে করা হয় না, অথচ পুরুষের ব্যভিচার বা ধর্ষণে আক্রান্ত নারীকেই জারজের দায় বহন করতে হয়। পুরুষকে কোনও দায় ভোগ করতে হয় না, লজ্জা পোহাতে হয় না, সমাজের ছুড়ে দেওয়া থুতু নারীর গায়েই লাগে, পুরুষেরা বেঁচে যায় অসতীত্ব ও জারজ-জন্মের পাপ থেকে। তবে কি এ-কথা সত্য নয় যে, পুরুষের নিয়ম ও নীতির জালে কেবল নারীর আটকা পড়বার ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।
এ-কথা সত্য, আমি জানি, অনেকেই আমার মতো জানে। জানে, কিন্তু সকলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, জিহ্বা আড়ষ্ট করে সকলে নির্বিকার চেয়ে থাকে পেছনের দিকে। যেন পেছনই এখন আরাধ্য, অতীত এবং আদিই যেন এখন প্রার্থনীয়। আমরা যদি না এগোতে পারি সামনে, আমরা যদি না ছিঁড়তে পারি গায়ে জড়িয়ে থাকা শৃঙ্খল, আমরা যদি তাবৎ নিয়ম ও রীতির শরীর থেকে খুলে নিতে না পারি অন্ধত্ব, তবে কী লাভ এই পৃথিবীতে এই প্রজন্মের মানুষ হয়ে বেঁচে থেকে? কিছু লোভী ও কামুক পুরুষের তৈরি সমাজ ও সংস্কার আমাদের ক্রমাগত পেছনে ঠেলছে। আর আমরাও সময়ের ভীত ও সন্ত্রস্ত প্রজন্ম, সবই মাথা পেতে বরণ করে নিচ্ছি।
বোধোদয় কবে হবে আমাদের? আমরা কবে মুক্তি পাব চেতনার এই সর্বনাশ থেকে? বুদ্ধির স্খলন থেকে? কেউ কি নেই, যে দাঁড়ায়—দাঁড়িয়ে বলে মানি না! এত দেখি নারী-পত্রিকা, নারী-সংগঠন গজিয়ে উঠেছে শহরে, গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায়! কেউ তো উদ্ধত, দুর্বিনীত একবারও বলছে না—‘মানি না’। সকলে কিছু খোরপোশ চায়, সকলে কিছু খুদকুঁড়ো চায়—সামান্য সুযোগ কিংবা সুবিধা হলেই সকলের স্বস্তি। কেউ উপড়ে ফেলতে চায় না শেকড়, কেউ একটি অসুস্থ বৃক্ষের গোড়া ধরে টান দিতে চায় না সজোরে। কেবল বিনীত নিবেদন, কেবল দু’ফোঁটা আনন্দের জন্য আকুলতা। কী লাভ এই সামান্য করুণালাভে?
নারীকে অবদমনের যাবতীয় ডালপালা, যাবতীয় শেকড়বাকড় উপড়ে ফেলে সমাজের গোড়ার ঘা সারাতে চাই। এতে আমার ক্ষতি হবে জানি। আমার সমাজ-সংসার উচ্ছন্নে যাবে, ব্যক্তি-আমাকে অপদস্থ হতে হবে নিরন্তর। কিন্তু তবুও এই যে আমি দাঁড়িয়েছি, একা এবং দুর্বিনীত, আমি এমন অনড় দাঁড়াবই। আমার দুটো জিনিসই হাতে সম্বল—সাহস এবং সততা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন