নগর-যাপন

তসলিমা নাসরিন

আমরা যারা লিখি, আমাদের এমনই নিয়ম যে, সারা বছর লিখে একটি মাস কেবল লিখব না, সারা বছর নিরানন্দে ভেসে একটি মাস কেবল উৎসব করব আনন্দের। আমাদের এমনই নিয়ম, আমরা যারা লিখি তারা পাশাপাশি হেঁটে বা দাঁড়িয়ে, বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে বা বসে বলব আমাদের না-দেখা সারা বছরের গল্প, আমরা কথা বলব আমাদের লেখা যারা পড়েন তাঁদের সঙ্গেও।

এই উৎসবের মাসটি ফেব্রুয়ারি মাস। এই উৎসবের মাসটি নিশ্চয়ই ফেব্রুয়ারি মাস। এই ফেব্রুয়ারি আমাদের মাস। আমরা যারা বছরের এগারো মাস দুঃখ করি, তারা কি একটি মাস মন খুলে আনন্দ করব না? নিশ্চয় করব তাই আনন্দ করি। তাই ফেব্রুয়ারির বিকেলে কুশল শুধোতে যাই যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের, যাঁরা গল্প-উপন্যাস লেখেন তাঁদের, যাঁরা প্রবন্ধ লেখেন, যাঁরা আমাদের মতো একই রকম ভাবনা ভাবেন, তাঁদের। এ-বছরের বইমেলায় একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, এ-কথা সবাই জানে। যারা বইমেলায় যায় তারাও জানে, যারা যায় না তারাও। অপ্রীতিকর ঘটনাটি এ-রকম, দশ-বারোটি ছেলে আমার লেখা পছন্দ করে না, পছন্দ করে না বলে তারা আমার বই স্টল থেকে টেনে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে, বই যেন বিক্রি না হয় সে-হুমকি দিয়েছে, আরও বলেছে, আমি বাংলা অ্যাকাডেমির মেলায় এলে আমাকে অপমান করা হবে, শারীরিক আঘাতের কথাই তারা বুঝিয়েছে।

পরে জেনেছি, আমার ‘দৌড়, দৌড়’ ও ‘বালিকার গোল্লাছুট’ কবিতার জন্য তাদের এই আক্রোশ। ‘দৌড়, দৌড়’ কবিতাটি এ-রকম—‘তোমার পেছনে একপাল কুকুর লেগেছে/ জেনে রেখো, কুকুরের শরীরে র‍্যাবিস।/তোমার পেছনে একপাল পুরুষ লেগেছে,/ জেনে রেখো, সিফিলিস।’

‘বালিকার গোল্লাছুট’ কবিতাটি এ-রকম—‘আমরা বালিকারা যে খেলাটি খেলবো বলে পৃথিবীতে বিকেল নামতো/ সে খেলার নাম গোল্লাছুট।/সারা মাঠ জুড়ে বিষম হৈ চৈ/ সেই নিশ্ছিদ্র আনন্দ থেকে/ গড়িয়ে গড়িয়ে কবেই এসেছি শতচ্ছিন্ন দুঃখের ছায়ায়,/ মনে নেই, মনে নেই কোন দল কোন দিকে ছোটে,/ কাকে ছুঁলে হয় নিখাদ বিজয়!/ বালিকারা এখনো কি খেলে হাওয়ায় উড়িয়ে চুল গোল্লাছুট খেলা?/ আমার আবার ইচ্ছে করে খেলি/ এখনো মাঝে মধ্যে আকুপাকু করে পায়ের আঙুল/ ধুলোয় ডুবতে চায় গোপন গোড়ালি।/ ইচ্ছে করে যাই/ পৃথিবীর সকল বয়স্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট।’

অভিযোগ এই, ‘পৃথিবীর সকল বয়স্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট’–এর অর্থ ঘর-সংসারের সকল মা-বোনকে ঘর থেকে বের করতে চাচ্ছি আমি! অভিযোগ আরও, পুরুষের শরীরে ‘সিফিলিস’ বলে আমি পুরো পুরুষ জাতিকে দোষ দিচ্ছি।

অভিযোগ দুটো সরাসরি আমার সামনে উত্থাপন করা হয়েছে। আমাকে আমার লেখার কৈফিয়ত দিতে হয়েছে নিতান্তই অর্বাচীন, সনাতন সংস্কারে নিমজ্জিত সশস্ত্র যুবকদের কাছে। কৈফিয়ত দিতে হয় কবিতার, কৈফিয়ত দিতে হয় প্রতি বাক্যের, শব্দের। যেন অপরাধ করেছি লিখে, যেন অপরাধ করেছি শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসবার আহ্বান জানিয়ে, যেন অপরাধ করেছি নারীকে মানুষ হবার প্রেরণা দিয়ে। এই নোংরা সমাজের দলিত, পিষ্ট, শোষিত নারীর পক্ষে উচ্চারিত যে-কোনও শব্দকে ‘অশ্লীলতা’ বলে গণ্য করা হয়। কোন শব্দ আমি কোন কবিতায় লিখেছি এবং কেন–তা আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। আমি অধিকাংশ সময় পার করেছি নির্বাক এবং নিরুত্তর। বয়স্ক বালিকারা গোল্লা থেকে ছুটে যাবে, গোল্লা অর্থ এই ছকবাঁধা জীবনের গণ্ডি, গোল্লা অর্থ শৃঙ্খল, গোল্লা অর্থ অন্ধকার ঘর, যে ঘরকে নারীর একমাত্র জগৎ বলে ভাবা হয়। নারীকে এই অবদমন, এই পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবার কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে, তারা এ-রকমই অভিযোগ করল।

একবিংশ শতাব্দী শুরু হবে, আর আমাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, আমি কেন সমাজের নিয়মনীতির বাইরে অন্য কথা বলি, প্রচলিত জীবনের বাইরে অন্য জীবনের ডাক দিই! আমার এই অপরাধের ক্ষমা নেই। অন্তত তাদের কাছে, যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার হাত থেকে কলম কেড়ে নেবার

আমার লজ্জা হয়, আমার সত্যিই লজ্জা হয় ভেবে যে, আমি কোন দেশে বাস করি, কারা আমার সহযাত্রী, কারা আমার পাঠক! আমার লজ্জা হয়, আমার ক্রোধও কি কিছু কম হয়?

আমি এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ভেবে বসলাম, যেমন লেখা লিখি, তেমন আর লিখব না। আমি এখন হুমায়ুন আহমেদের মতো উপন্যাস লিখব, সুরাইয়া খানমের মতো কবিতা লিখব—ব্যাস কেউ আর ফাঁসির দাবি নিয়ে মিছিল করবে না, কেউ আর মেলা থেকে কেড়ে নেবে না আমার সব বই, কেউ আর আমাকে বিবস্ত্র করবার হুমকি দেবে না। আমি তো অন্তত নিরুপদ্রব বেঁচে থাকব।

আমি শেষ অবধি এ-রকম একটি ভাবনাকে স্থায়ী করতে পারিনি বেশিক্ষণ। আমি যাবতীয় দুর্ভাবনাকে দূর করেছি এই ভেবে যে, আমাকে যদি মৌলবাদীরা ধর্মহীনতার দোষে ফাঁসি দেয়, দেবে; যদি মৌলবাদী এই নতুন প্রজন্ম আমার লেখার হাতকে ছিঁড়ে ফেলতে চায়, কেড়ে নিতে চায় কলম এবং বিবস্ত্র করতে চায় শরীর; তবে করুক। এই আমি দাঁড়ালাম সকল অপশক্তির বিপক্ষে। এই আমি নারীর ওপর ধর্মের সমাজের, রাষ্ট্রের নির্যাতনের বিপক্ষে দাঁড়ালাম। কেউ আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইলে করুক। আমি আপস করতে চাই না কোনও ক্ষমতাবান সন্ত্রাসীর সঙ্গে। তারা আমাকে আরও অভিযুক্ত করেছিল, বলেছিল—“আপনি ‘জয় বাংলা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এই জয় বাংলাকে জীবনের রক্তে মাংসে/ যারা লালন করতে না জানে তাদের, সেই দুর্ভাগাদের মৃত্যু হোক।’ এর অর্থ কি. এই নয় যে, আপনি আমাদের মৃত্যু চাইছেন?

এও আমার দোষ, আমি ‘জয় বাংলা’কে অন্তরে ধারণ করি। আমার এত দোষ মোচন করবার শক্তি আমার নেই। আমি এই অহংকার করতে চাই, এই একটি অহংকার যেন আমাকে আরও সমৃদ্ধ করে যে, আমার দিকে ধাবিত রাষ্ট্রের এবং সমাজের বুলডোজারকে গায়ের জোরে নয়, সত্যের জোরে থামাতে চাই। কেউ যদি একে দোষ বলে, আমি দোষী হতে চাই আরও।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন