‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’

তসলিমা নাসরিন

‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’

আমার ইচ্ছে করে, সকাল-দুপুর-রাত একা হেঁটে বেড়াই, নদীর ধারে, গ্রামের মাঠে আলপথে, শহরের ফুটপাথে, পার্কে স্রেফ একা হাঁটি। আমার বড় ইচ্ছে করে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে যেতে, ইচ্ছে করে হঠাৎ একদিন শালবন বিহার গিয়ে পুরো বিকেল কাটাই। ইচ্ছে করে সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রে নেমে গাঙচিলের খেলা দেখি, ইচ্ছে করে খুব মন খারাপ করা দুপুরে ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। ইচ্ছে করে সংসদ-ভবনের সিঁড়িতে একা বসে থাকি, বিকেলে রমনায় গাছে হেলান দিয়ে অলস দাঁড়াই, ক্রিসেন্ট লেকের জলে সারা সন্ধে পা ডুবিয়ে বসে থাকি, হঠাৎ আবার শীতলক্ষায় নৌকো নিয়ে ঘুরি।

আমি জানি, খুব ভাল করেই জানি, আমার ইচ্ছেগুলো ঘটাতে গেলে আমাকে লোকের ঢিল, থুতু, গা-ধাক্কা খেতে হবে। আমাকে অপদস্থ হতে হবে, ধর্ষিতা হতে হবে। আমাকে কেউ ‘পাগল’ বলবে, কেউ ‘নষ্ট’ বলবে, কিন্তু সকলে নিশ্চয় এ-কথা স্বীকার করবেন, কোনও পুরুষের বেলায় এ-ধরনের ইচ্ছেকে পূর্ণতা দিতে গেলে অশ্লীল বাক্যবাণে তাকে আহত হতে হয় না, কোনও পুরুষের বেলায় অপহরণ, অপঘাত, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি ঘটনাগুলো ঘটে না। কেবল নারীর বেলায় ঘটে। কারণ নারী কেন সঙ্গে একজন পুরুষ ছাড়া হেঁটে বেড়াবে? পুরুষের না হয় বিচিত্র স্বভাব থাকে, পুরুষকে তা মানায় বটে! নারী কেন ফুটপাতে হাঁটবে, গাছের ছায়ায় দাঁড়াবে, সিঁড়িতে একা বসবে, ঘাসের ওপর শোবে? নারীর এত ইচ্ছে থাকতে নেই। নারীকে ঘরে বসে থাকতে হয়, নারীর জন্য ঘরের দেওয়ালে ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা আছে, ওই ভেন্টিলেটর ফুঁড়ে যে আলো-হাওয়া তার গায়ে এসে লাগে, সেটিই কি যথেষ্ট নয় বেঁচে থাকবার জন্য?

হ্যাঁ, যথেষ্টই বটে। বেঁচে থাকবার জন্য এটুকু আলো-হাওয়াই যথেষ্ট। নারীর বেঁচে থাকাটুকু সকল পুরুষই চায়। কারণ নারীকে তাদের প্রয়োজন। ভোগের জন্য, বংশরক্ষার জন্য। নারী না হলে পুরুষের ভোগ হবে না, বংশরক্ষা হবে না, নারী না হলে কর্তৃত্ব করবার, শক্তি খাটাবার, গলার জোর, গায়ের জোর দেখাবার জায়গা কোথায় পুরুষের! ওপরতলার মানুষের নিয়মই নীচের তলার মানুষকে শোষণ করা, সবল চিরকাল দুর্বলের ওপর চড়াও হয়। উচ্চবিত্ত সুযোগ খোঁজে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে। নারীর ওপর পুরুষের তাই সর্বময় অধিকার, তাকে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় করবার, তাকে আহত করবার। নারী নীচের তলার মানুষ, নারী দুর্বল, নারী সহায়-সম্বলহীন উদ্‌বাস্তু। তাই নারীকে বাঁচিয়ে রেখে নারীর ওপর চড়াও হবার ইচ্ছা সকল ভদ্রলোকের।

খাঁচার ভেতর পাখির জন্যও আলো ঢোকবার ব্যবস্থা থাকে, পাখিকে সময়মতো আহার দেওয়া হয়, পাখিকে কিছু বাঁধা কথা মুখস্থ করানো হয়। একই রকম নারীকেও, নারীর জন্য ভেন্টিলেটর; নারীর জন্য সকাল-দুপুর খাবার দেওয়া হয়, নারীকে কিছু সমাজসম্মত কথা শেখানো হয়, নারীকে তার সীমিত বাক্য, সীমিত পথ, সীমিত আহার, সীমিত আকাঙ্ক্ষা, সীমিত স্বপ্ন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করা হয়। নারী খাঁচায় বন্দি পাখির মতো খোলা আকাশ, খোলা মাঠ, বন-বনান্তর, অনন্ত সবুজের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।

নারীকে দুর্বল ভাবে কারা? যারা বলে, নারী শরীরে দুর্বল, ভুল বলে। যারা বলে, নারী মনে দুর্বল, তারা ভুল বলে। তারা মিথ্যে বলে। এখনও দুটো ছেলে ও মেয়ে- শিশুকে ভরা পুকুরে ছেড়ে দিলে যে শিশুটির আগে মৃত্যু হবে, সে ছেলে-শিশু। যদি মেয়ে-শিশুর ফুসফুস বা হৃদপিণ্ড ছেলে-শিশুর চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়, যদি প্রতিরোধ-ক্ষমতা বা বেঁচে থাকবার প্রচণ্ড ক্ষমতা মেয়ে-শিশুরই বেশি হয়, তবে কী করে একবাক্যে রায় দেওয়া হয় যে, মেয়েমাত্রই দুর্বল!

আসলে এ-সবই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিশেষণ। নারী বিবেকবুদ্ধি দ্বারা অধিক চালিত বলে বা মমতা ও ভালবাসা ধারণ করবার ক্ষমতা সে বেশি রাখে বলে সে হিংস্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, এর অর্থ এই নয়, সে দুর্বল। আদিম যুগে নারী-পুরুষ কাড়াকাড়ি করেই জীবজন্তুর মাংস খেত। তখন একটুও প্রমাণ হয়নি, নারী দুর্বল বলে সে কেড়ে খেতে পারছে না। নারীকে গর্ভবতী হতে হয় বলে গর্ভরক্ষার কারণে তাকে কম পরিশ্রমে অভ্যস্ত হতে হয়, তাকে শিকারে কম যেতে হয়, তাকে কাড়াকাড়ি কম করতে হয়, সে পেশির চেয়ে বুদ্ধি দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে; সন্তানের প্রতি তার মায়া জন্মে, সে ভালবাসার কাছে নত হয়, নিমগ্ন হয়। এর অর্থ এই নয়, নারী দুর্বল, ভীতু, লজ্জাবতী। নারীকে ভয় এবং লজ্জা শিখিয়েছে সমাজের পুরুষেরা। ভয় এবং লজ্জা থাকলে পুরুষের আধিপত্য বিস্তারে বেশ সুবিধে হয়, ভয় এবং লজ্জাকে তাই নারীর ‘ভূষণ’ বলে ভাবা হয়, নির্ভীক এবং লজ্জাহীন নারীকে সমাজে খুব কম লোকই আছে যে মন্দ বলে না। যেহেতু ভয় এবং লজ্জাকেই নারীত্বের প্রধান গুণ ভাবা হয়, যেহেতু সীমিত পথই নারীর চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট হয়, তাই সে যদি রমনায়, রাস্তায়, রকে, রেস্তোরাঁয় একা হাঁটে বা বসে, লোকে তার দিকে অবাক তাকাবে, শিস দেবে, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরখ করবে, মেয়ে ‘বেশ্যা’ কি না। কারণ বেশ্যা ছাড়া কোনও মেয়েই দুর্বিনীত হাঁটে না, বেশ্যা ছাড়া কেউ শহর জুড়ে একা, উদ্ধত, সীমানা ছাড়া পথ পেরোয় না।

যারা ঘরে বসে থাকে, যারা অভিভাবক নিয়ে বা পুরুষ নিয়ে নিরাপদে ঘরের বার হয়, অথবা একাই শোভন সীমানার মধ্যে বিচরণ করে প্রয়োজন-শেষে ঘরে ফেরে, সমাজ তাদের ‘ভদ্র মেয়ে’ বলে। ভদ্রতার বাইরে গেলেই মেয়েদের ‘বেশ্যা’ বলে গাল দেওয়া হয়। পুরুষেরা ‘বেশ্যা’কে গাল দেয় ঠিকই কিন্তু বেশ্যা ছাড়া তাদের চলেও না, তারাই নিজেদের স্বার্থে নিজেদের নাগালের মধ্যে বেশ্যালয় খুলেছে।

পুরুষেরা বেশ্যা বলবে বলে নারী একা হেঁটে বেড়ায় না দূরের কোনও খোলা, মাঠে, নারী ইচ্ছে করলেও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যায় না, ইচ্ছে করলেও নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো হিজল গাছের ছায়ায় বসে দুএক কলি গান গায় না, ইচ্ছে করলেও নির্জন ফুটপাত ধরে একা হাঁটে না। নারী বেশ্যা নামটিকে বড় ভয় পায়, এই নাম থেকে সে বড় গা বাঁচিয়ে চলে।

পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করবার জন্য নারী সাজে। চোখে, গালে, ঠোঁটে রং লাগায়। পুরো পৃথিবীতে প্রসাধনী দ্রব্যের উৎপাদন কী হারে বাড়ছে তা আমার সাধ্য নেই, হিসেব করি। বেশ্যারা সাজে অসামাজিক খদ্দেরের আশায়, আর ভদ্র নারীরা সাজে সামাজিক খদ্দেরের আশায়—দু’সাজের উদ্দেশ্যই খদ্দের পাওয়া। যার যত ভাল খদ্দের জোটে, তার ইহলৌকিক সুযোগ-সুবিধে তত বেশি। নারীকে তারা সুযোগ-সুবিধে দিচ্ছে বলে, খেতে-পরতে দিচ্ছে বলে নারীর পায়ে তারা শেকল পরায়, ছাগলকে মাঠে ছেড়ে গলায় দড়ি-বেঁধে যেমন খুঁটি গেড়ে দেওয়া হয়, অনেকটা তেমন। নারীকে গোরু-ছাগল-ভেড়ার মতোই একটি মাপা গণ্ডির ভেতর চলতে ফিরতে দেওয়া হয়। পুরুষেরা দড়ি-বাঁধা নারীর স্বাদ পেতে চায়, আবার দড়ি-ছেঁড়া নারীর স্বাদও। মূলত পুরুষের রসনা তৃপ্ত করবার জন্যই নারীকে একবার ঘরবন্দি হতে হয়, আরেকবার ঘরছাড়া। নারী কিন্তু নারীই, সে বেশ্যা হোক, সে কুলবধূই হোক। দুর্ভোগ পোহাবার জন্যই তার জন্ম।

সমাজের নারীরা পুরুষ ছোবল দেবে ভয়ে, আবার পুরুষ তাদের মন্দ বলবে ভয়ে ইচ্ছে করলেও মহাস্থানগড় থেকে একবার বেড়িয়ে আসে না, শ্রীমঙ্গলের চা-বাগানে উদাস হেঁটে বেড়ায় না, ব্রহ্মপুত্রের জলে আনন্দে সাঁতার কাটে না, সুন্দরবনের পূর্ণিমায় শরীর ভেজায় না। একটাই মাত্র জীবন মানুষের। এই জীবনকে নারী যেমন ইচ্ছে যাপন করতে পারে না। এই জীবনকে মানুষের কাছে, আকাশ ও নক্ষত্রের কাছে, জল ও হাওয়ার কাছে, সবুজ অরণ্যের কাছে, একলা নদীর কাছে এনে জীবন চেনায় না। তার সকল ইচ্ছে, তার সকল সাধ ও স্বপ্নের ঘরে আগুন জ্বেলে সে পুরুষের ঘর আলোকিত করে।

নারীর ব্যর্থ এই জীবনের জন্য শোকে ও সন্তাপে আমি মাথা নত করছি। পাঠক, যদি মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকে আপনার, আপনিও মাথা নত করুন।

অধ্যায় ১ / ৬১

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন