তসলিমা নাসরিন
রাজা রামমোহন রায়ের কথা জানি, বিদ্যাসাগরের কথা জানি। কিন্তু ক’জন আমরা লীলা নাগের কথা জানি? এই ঢাকা শহরে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হাতেগোনা যে ক’জন মানুষ, লীলা নাগ তাঁদের অন্যতম। তিনি নারী শিক্ষা মন্দির’ নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় গড়েছিলেন, আজ সেটি নেই। সেটি নেই মানে সেই দালানকোঠা আছে, বিদ্যালয়ও আছে কিন্তু ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ নামটি নেই, সেটি এখন শেরে বাংলা বালিকা বিদ্যালয় বা এইজাতীয় কিছু একটা নামে দাঁড়িয়েছে। লীলা নাগের নাম সম্ভবত উচ্চারণ করা বারণ, তাই ‘নারী শিক্ষা মন্দির’-এর উচ্চারণেও নিষেধ আছে। এও ঠিক বি এল কলেজ, এম সি কলেজ বা পি সি কলেজের মতো। সংক্ষেপের জট খুললে এই মুসলমানের দেশে আবার হিন্দুত্ব না প্রকট হয়ে ওঠে! তাই বোধহয় লীলা নাগের ‘মন্দির’ নামক বিদ্যালয়টি যেমন কাগজেকলমে বিলুপ্ত হয়েছে, মানুষের স্মৃতি থেকেও তাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবার ব্যবস্থা চলছে। এই ব্যবস্থার প্রথম শর্ত, ইতিহাসকে স্মরণ না করা।
কিন্তু নিজে মেয়ে হয়ে আমি এত অকৃতজ্ঞ হব কেন যে, আমি স্মরণ করব না নমস্য লীলা নাগকে, যিনি এই বাংলার ঘরবন্দি নারীদের ডেকেছিলেন বাইরে বেরোতে, সূর্যের আলো আর শিক্ষার আলো, দুটোই গায়ে মাখতে।
১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বারোজন সদস্য নিয়ে লীলা নাগ ‘দীপালি সংঘ’ গড়ে তোলেন। এই ‘দীপালি সংঘ’ পুরোটাই মেয়েদের সংঘ, এর উদ্যোগে ঢাকায় বারোটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তা ছাড়া ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ ‘ ও ‘শিক্ষাভবন’ নামে দুটো ইংরেজি স্কুল তো আছেই। লীলা নাগ ‘দীপালি স্কুল’ নামেও একটি ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২৪ সালে ‘দীপালি শিল্প প্রদর্শনী’ নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এই প্রদর্শনীতে প্রধান থাকত মেয়েদের হাতে তৈরি নানা ক্ষুদ্রশিল্প। আজ থেকে ৬৭ বছর আগে মেয়েদের শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। লীলা নাগের ‘দীপালি ছাত্রী সংঘ’ বাংলা ও আসামের নানা স্থানে শাখাপ্রশাখা মেলে বিস্তৃত হয়। এই ‘দীপালি সংঘ’ ১৯৩০ সালে মেয়েদের সীমিত চলাফেরার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, ‘ছাত্রীভবন’ নামে কলকাতায় একটি ছাত্রীনিবাস গড়ে তোলে। ১৯২৭-২৮ সালে ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ নামে লীলা নাগ একটি ফান্ডও খোলেন। ঢাকা, কলকাতা ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানে মেয়েদের লাঠিখেলা, ছোরাখেলা এবং জুজুৎসু শেখানো ছিল এই ফান্ডের কাজ শিক্ষাবিস্তারের এই ভূমিকা ছাড়াও লীলা নাগ রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোত। ১৯২১ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সে প্রথম হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ-তে ভরতি হন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তাঁকে প্রথমে ভরতির অনুমতি দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত লীলা নাগকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা চালু হয়। ১৯২৩ সালে এম এ পর্ব সেরে তিনি বেরিয়ে আসেন। ১৯২১ সালে ‘নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটি’র সদস্য লীলা নাগ বাঙালি মেয়েদের ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেন। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় লীলা নাগ ‘ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠন করেন। এই সমিতির সদস্যরা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে লবণ তৈরি আইন ভাঙেন। মহাত্মা গান্ধীর ডাঙি অভিযান ও তার পটভূমি সংক্রান্ত তথ্য প্রচার করবার জন্যে লীলা নাগ ও সহকর্মীরা বেশ পরিশ্রম করেন।
১৯৩১ সালে লীলা নাগকে রাজবন্দি করে আটকে রাখা হয় জেলে। সঙ্গে সহকর্মী সুশীলা দাশগুপ্ত, প্রমীলা গুপ্ত, হেলেনা দত্ত, বীণা রায়, সীতা সেন, অনুপমা বসু, রেণুকণা দত্তকেও জেলে ভরা হয়। ১৯৩৭ সালে লীলা নাগ জেল থেকে বের হন। জেল থেকে বের হয়েই তিনি ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ গঠন করেন। লীলা নাগ এই সংঘের কথা সুভাষ বসুকে জানান। সুভাষ বসু তখন কংগ্রেসের সভাপতি, তিনি লীলা নাগকে এ-ব্যাপারে উৎসাহ দেন। ১৯৩৮ সালে সুভাষ বসু জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করে লীলা নাগকে মহিলা সাব-কমিটির দায়িত্ব দেন। ‘৩৯-এ ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করবার পর লীলা নাগকে তিনি সহযোগী হিসেবে নির্বাচন করেন। এই সুভাষ বসুর নির্দেশেই তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এ ছাড়াও ‘জয়শ্রী’ নামে লীলা নাগ মেয়েদের একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। জয়শ্রী প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৩০ সালে, সেই ‘জয়শ্রী’ এখনও বার হচ্ছে, অবশ্য অন্যের সম্পাদনায়।
১৯৪২ সালেও লীলা নাগকে জেলে নেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়ে বাংলার সাধারণ আসন থেকে ভারতের কনস্টিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্য হন, ভারতীয় সংবিধান রচনায়ও লীলা নাগের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৬-এ নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, এগিয়ে আসেন লীলা নাগ।
‘৪৭-এর দেশভাগের পর প্রিয় দেশ, প্রিয় শহর ছেড়ে লীলা নাগ চলে গেলেন। সিলেটের গিরীশচন্দ্র নাগ ও কুঞ্জলতা নাগের ঘরের মেয়ে লীলা নাগকে তাঁর প্রিয় কর্মক্ষেত্র ছেড়ে চলে যেতে হল অন্য দেশে—এ কার পরাজয়? তখনকার কংগ্রেসের? নাকি নিরীহ মানুষের? না এক বুদ্ধিদীপ্ত প্রখর নারী লীলা নাগেরই?
তাঁর প্রিয় শহর এই ঢাকা! ঢাকা কি মনে রেখেছে লীলা নাগকে? ঢাকা কি মনে রেখেছে এই ঢাকায় নারীশিক্ষার জন্য কী অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন তিনি—এই কথা? সেমিনার, সিম্পোজিয়াম কি কম হয় এখানে? কই, লীলা নাগের কথা তো শুনি না, কেউ তো অভিযোগ করে না ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ কেন নামপরিচয় পালটালো?
১১ জুন লীলা নাগের মৃত্যুদিন, ২ অক্টোবর জন্মদিন। কত ২ অক্টোবর যায়, চোখের সামনে কত পার হয় ১১ জুন। কেউ স্মরণ করে না তাঁকে। এই অকৃতজ্ঞ জাতি, কোথাও কোনও আলোচনা-আড্ডায় তাঁর নাম উচ্চারণ করে না, এই শহরে তাঁর কোনও স্মৃতিফলক নেই।
অকৃতজ্ঞ জাতির, আমি যতদূর জানি, কোনও উন্নতি হয় না। পাঠক, এই দুর্ভাগা জাতির জন্যে চলুন আজ আমরা অশ্রুপাত করি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন