তসলিমা নাসরিন
রতন সেন খুন হয়েছেন। ভোরবেলায় মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি, দৌড়ে এসে খবরটি আমাকে দিল আমার ছোটভাই। বলল, ‘রতন সেনকে ওরা খুন করেছে, তোমাকেও না আবার কবে মেরে ফেলে। বুবু, তুমি আর একা বাইরে যেয়ো না। ‘
একা বাইরে যাব না—এ হয় নাকি? আমি খবরের কাগজ হাতে বারান্দায় বসলাম। সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া আমাকে সম্ভাষণ জানাল। কাগজে লেখা ‘সকাল সাড়ে ন’টায় স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক জামায়াত শিবির চক্র প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সিপিবি সম্পাদকমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি কমরেড রতন সেনকে রিকশা থেকে নামিয়ে দু’হাতের রগ কেটে বুকে ও পিঠে ১৪টি ছুরিকাঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে রতন সেনের মৃত্যু হয়।’
আমি হিম হয়ে বসে রইলাম বারান্দায়। ওরা, ওই জামায়াত শিবির ফ্রিডম পার্টি চক্রের সন্ত্রাসীরা তাঁকে ছুরির আঘাতে খুন করেও তুষ্ট হয়নি, তাঁর হাতের রগ দুটো কেটে দিয়েছে। ছোটভাই আমার কাঁধ ছুঁয়ে আশঙ্কায়, বেদনায় কম্পিত স্বরে আবার বলল, তুমি আর একা-একা বাইরে যেয়ো না, বুবু!
জামায়াত শিবির ফ্রিডমের রোষানলে আমিও পড়েছি। রতন সেনের মতো যে-কোনও দিন, প্রকাশ্য দিবালোকে, সকাল-দুপুর-বিকেল যে-কোনও সময় ওরা আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে অতর্কিতে উপর্যুপরি ছুরি চালাবে, আমার দু’হাতের রগ ওরা কেটে দেবে। কে ওদের বাধা দেবে, দেশে কোন শক্তি আছে যে ওদের বাধা দেয়?
একবার জামায়াতির এক লম্বা মিছিলে পড়েছিলাম আমি এবং কবি শামসুর রাহমান। মিছিলের স্লোগান ছিল—ভারতীয় দালাল খতম করো, নির্মূল কমিটির সদস্যদের খতম করো, নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর।’ যেন আল্লাহ্র নাম নিয়ে এঁদের সবার গলায় ছুরি বসাতে চাইছে। এমন বীভৎস মিছিলের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় কবিকে নিয়ে আমি একটি অসহায় স্কুটারে বসে ছিলাম, না পারছিলাম সামনে যেতে, না পারছিলাম পেছনে। আমার চোখের সামনে এর আগে আরও মিছিল যেতে আমি দেখেছি। একবার এক মিছিলে ছিল ‘তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি চাই’ লেখা ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড। আমি ভয় পাইনি, মিছিল চলে গেলে রাস্তা অতিক্রম করেছি, মিছিলের কেউ আমাকে চিনতে পারেনি।
কিন্তু সেদিন স্কুটারে বসে ভয়ে আমার নীল হয়ে উঠছিল মুখ, নিজের জন্য নয়, দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবির জন্য। আমাকে না চিনলেও কবি শামসুর রাহমানকে নিশ্চয় ওরা চিনতে পারবে। আর’সেই বীভৎস, উন্মত্ত মিছিল,যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার প্রিয় কবির ওপর? স্কুটারওয়ালাকে, ভীষণ উদবিগ্ন অস্থির আমি, মিছিলের মধ্য থেকে ডানে-বামে যে-কোনও একদিকে যেতে বলছিলাম, ওদের নাগাল থেকে একটি নিরাপদ দূরত্বে যাবার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠছিলাম, আমার জন্য নয়, কবি শামসুর রাহমানের জন্য, যাঁকে ওরা ভারতীয় দালাল তালিকার এক নম্বরে রেখেছে।
যাঁরা প্রগতির কথা বলেন, সুস্থ, সহনশীল ও যুক্তিবাদী মন যাঁদের, ওরা তাঁদেরই ‘ভারতীয় দালাল’ বলে রায় দেয়। ওরা দালালদের তালিকা করেছে, একটি-একটি করে খুন করে হাতের রগ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখবার জন্য। ‘ভারতীয় দালাল’ হিসেবে খুলনায় বিভিন্ন দলের বত্রিশজন নেতাকে চিহ্নিত করে তাঁদের নির্মূল করবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, রতন সেন ছিলেন ওই তালিকায় শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি।
আমি এখন আশঙ্কা করি কবি শামসুর রাহমানের জীবনের জন্য; জাহানারা ইমাম, কাজি নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, নির্মলেন্দু গুণ, কে এম সোবহান, রামেন্দু মজুমদার, সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেমন, আহমদ শরিফ, যতীন সরকার, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, শওকত ওসমান সকলের জন্য আমার আশঙ্কা হয়। কবে না জানি হঠাৎ সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চমকে উঠব, আমাকে পড়তে হবে ‘গতকাল সকালে জামায়াত শিবির ফ্রিডম চক্র শেখ হাসিনা, বদরুদ্দিন ওমর, কবির চৌধুরি, বেলাল চৌধুরি, নির্মল সেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার বুকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেছে,’ পড়তে হবে ‘ড. কামাল হোসেন, আমিরুল ইসলাম, গাজিউল হক, পান্না কায়সার, শিশির ভট্টাচার্যের হাতের রগ কেটে দিয়েছে ওরা’ এবং আমার আত্মীয়রা সকালে ঘুম চোখে এও হয়তো পড়বেন—‘গতকাল সকালে, প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশ অফিসের সামনে জামায়াত শিবির ফ্রিডমের সন্ত্রাসী যুবকমান্ড গ্রুপ তসলিমা নাসরিনকে রিকশা থেকে নামিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে, হাতের রগ কেটে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়।’আমার ছোটভাই, তার কণ্ঠে আমি আশঙ্কা টের পাই। কিন্তু আমার তো যেতেই হবে বাইরে, একা, রিকশায়।
রতন সেনের জন্য দুঃখ করব, নাকি দুঃখ করব রতন সেনের মতো মেধা ও সুস্থ মনন নিয়ে যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন—তাঁদের জন্য? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সন্ত্রাস, রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা, গোলাম আজমের নিরাপদ বেঁচে থাকা, রতন সেনের হঠাৎ খুন হয়ে যাওয়া, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অফিসে সন্ত্রাস, ওদের বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল—এ-সব কি বুঝিয়ে দেয় না আমাদের এখন আশঙ্কা করবার সময়! আমাদের সামনে এখন ভয়াবহ দুঃসময়!
সন্ত্রাসীদের বিচার হয় না। রতন সেনের খুনিরাও জানি বেঁচে যাবে। গোলাম আজম যেমন বেঁচে যায়। জামায়েত ইসলামি তাদের নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া রাজনীতি নিয়ে এখন দেশজুড়ে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। এখন দেশজুড়ে সকল মেধার রগ কেটে দিচ্ছে ওরা। ঠিক একাত্তরে যেমন দেশের শত্রুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার।
দেশে কি আবার এক একাত্তর এসেছে? দু’দিন আগে আমার পাশের বাড়ির পাঁচ বছরের মেয়ে আমার ঘরে এসে খুশিতে বেশ লাফাচ্ছিল, বলছিল, ‘কী মজা, কী মজা।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীসের মজা, তৃণা?’ বলল, ‘আমাদের দেশটা এখন পাকিস্তান হয়ে যাবে কিনা, তাই খুব খুশি লাগছে।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কে বলল তোমাকে এই কথা?’ পাঁচ বছরের অবুঝ মেয়েটি বলল, ‘আমার আব্বু-আম্মু বলল।’ আমি স্তম্ভিত। বাচ্চা মেয়েটির বাবা-মা নিশ্চয় পাকিস্তান হবার গোপন স্বপ্ন দেখছেন ঘরে বসে। শুধু গোপনই বা বলি কেন? এই স্বপ্ন তো এখন প্রকাশ্যে দেখছে জামায়াত শিবির ফ্রিডমের সংগঠিত ধূর্ত সদস্যরা। আর আমরা হতবাক নিরীহ জনতা ওদের স্বপ্নের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। কার কাছে অভিযোগ করব? সরকারের কাছে? মায়ের দোষ মাসিকে জানাব?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন