তসলিমা নাসরিন
পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাসী বা আস্তিক যেমন আছেন, তেমন নাস্তিক, ধর্মহীন বা অধার্মিক মানুষও আছেন। ১৯৯০ সালের হিসেবে পৃথিবীর অধার্মিক মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ যাঁরা প্রচলিত কোনও ধর্মপরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করান না, যাঁরা মুক্তচিন্তার ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, তাঁদের সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৬.৪ ভাগ। ১৬.৪ ভাগ মানে ৮৬ কোটি। এ তো গেল অধার্মিকদের সংখ্যা। এছাড়া শতকরা ৪.৪ জন নাস্তিক। নাস্তিকদের মধ্যে সন্দেহবাদী, ধর্মবিরোধী মানুষও আছেন। ৪.৪ জনের হিসেব দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৩০ লক্ষ। নাস্তিক্যবাদ এবং অধার্মিকতা প্রায় সমার্থক হলেও বিভিন্ন দেশের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এদের পরিচিতিও দু’রকম করা হয়েছে। অধার্মিক আছেন পৃথিবীর ২২০টি দেশে এবং নাস্তিক আছেন ১৩০টি দেশে।
পৃথিবীতে খুব কম করে ধরলেও ১১০ কোটি মানুষ নাস্তিক। নাস্তিকেরা কেউ অসৎ মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত নন। তাঁরা কেউ সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক নন। আস্তিকেরা ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভয়ে ভাল কাজ করেন। কিন্তু নাস্তিকেরা নিজের বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকেই সৎ ও মহৎ হন।
মানবসভ্যতার অতি অগ্রসর চেতনায় নাস্তিকতার উদ্ভব। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষেরা আত্মা, ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি কল্পনার বীজ বুনেছিল, সেই বীজ হাজার হাজার বছর ধরে বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তারপর মানুষের জ্ঞান, বোধ ও যুক্তি বিকশিত হতে মাত্র আড়াই হাজার বছর আগে নাস্তিকতাবোধের আলোকে মানুষ প্রথম আলোকিত করে নিজেকে। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, মিথ্যা বিশ্বাস, যুক্তিহীনতা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ আজ নাস্তিক্যবাদী। কিন্তু দুঃখ এই, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যেহেতু দরিদ্র, দেশের মূল পুঁজি ধর্ম, তাই কোনও-না-কোনও ধর্মের আবরণে মানুষকে আবৃত করবার নিয়ম তৈরি হয়েছে।
এ-দেশের রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে ইসলাম। ধর্ম এক ধরনের বিশ্বাস। অলৌকিক বিশ্বাস। মানুষের অধিকার আছে এটিকে বিশ্বাস করবার এবং না করবার। মানুষের এই স্বাভাবিক অধিকারকে চরম অপমান করে এই দেশের জন্য একটি ধর্ম নির্ধারণ করা হয়েছে। কাগজেকলমে সকলকেই যে-কোনও একটি ধর্মের নামে পরিচিত হতে হয়। কিন্তু এই দেশে বা সরকারিভাবে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, এমন আরও অনেক দেশে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার অপহৃত। আমি নিজে কোনও ধর্মে বিশ্বাস করি না কিন্তু একটি বিশেষ ধর্মের ছাপ মাথার ওপর সরকারিভাবে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে, সমাজে সকল জায়গায় আমি ‘মুসলমান’ বলে চিহ্নিত হচ্ছি। ধর্মে বিশ্বাস না করবার গণতান্ত্রিক অধিকার আমাদের মতো অনুন্নত দেশে অস্বীকৃত। সম্ভবত এ-সবই অনুন্নত দেশের অনুন্নত অবস্থার লক্ষণ।
১১০ কোটি নাস্তিক রয়েছে পৃথিবীতে, কিন্তু এই সংখ্যাও সঠিক নয়, কারণ বহু দেশের নাস্তিক বা অধার্মিককে এখনও যোগ করা হয়নি এই সংখ্যায়। ধর্মে সরকারি বাতাবরণ থেকে মানুষের বেরিয়ে আসবার আন্দোলন অনেক দেশেই সফল হচ্ছে না বলেই পরিসংখ্যান এখনও দুর্বল।
ধার্মিক মানুষের অসদাচরণ, নৃশংসতা পৃথিবীতে এত বেশি মাত্রায় বিরাজমান যে, তা দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘মানুষেরে ঘৃণা করি ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরিমরি।/ ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,/ যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতা সেই মানুষেরে মেরে/ পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’
সূত্র–Enccylopaedia Britanica, 1991 Book of the year.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন