‘নপুংসক’ বিষয়ক

তসলিমা নাসরিন

‘নপুংসক’ বিষয়ক

মঞ্চে কবিতা পড়তে উঠলে আমি লক্ষ করেছি, দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ-কেউ চিৎকার করে বলে ওঠেন—নপুংসক কবিতাটি পড়ুন।’ কেউ-কেউ স্লিপও এগিয়ে দেন হাতে, ‘নপুংসক’-এর অনুরোধ। এই ‘নপুংসক’ কবিতাটির অর্থ আমি যা উদ্ধার করেছি, তা হল ‘নিয়তি’ নামে আমার একটি কবিতা আছে, কবিতাটির সারমর্ম এ-রকম—এক মেয়েকে প্রতি রাতে এক নপুংসক পুরুষ চুম্বনে, আলিঙ্গনে সিক্ত এবং উত্তেজিত করে তোলেন, পুরুষের স্পর্শে মেয়ে যখন কাতর হন, তখন পুরুষটি তাঁর চরম অক্ষমতা নিয়ে গুটিয়ে থাকেন।

এই কবিতাটি পড়ে আমার এক চিকিৎসক বন্ধুকে আমি কাঁদতে দেখেছি। কারণ তার জীবনেও প্রতি রাতে এমন ঘটনাই ঘটে, প্রতি রাতে তার নপুংসক স্বামী এসে তাকে জাগায়, তাকে কাঁদায়। মেয়েটি না পারে সমাজের বন্ধন ছিঁড়তে, না পারে স্বামীকে ভালবেসে গৃহবাসী হতে। এক অস্থির, অসুখী জীবন তার। শুধু তারই বা বলি কেন—এই সমস্যা সমাজের অনেকেরই। এই কবিতা পড়ে, চেনা-অচেনা অনেকেই আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, বলেছেন, আপনি বড় সত্যকথা লিখেছেন। এই সত্যকথার কবিতা নিয়ে আমাদের ছেলেছোকরারা বড় মজা করে, তারা মঞ্চের দিকে ছুড়ে দেয় ‘নপুংসক’ কবিতাটি পড়বার জন্য অনুরোধের তির। আমি যদি এই কবিতাটি পড়িই, এই অসম্ভব কষ্টের কবিতাটি, তবে দর্শকের সারিতে বসে ওরা শিস দেবে নিশ্চয়, ওরা অদ্ভুত আনন্দ পাবে। আনন্দ পাবে কারণ এই কবিতায় কিছু কিছু শব্দ আছে যা তাদের উত্তেজিত করবে যেমন স্তন, ঠোঁট, চুমু ইত্যাদি, এই কবিতা থেকে ওদের আনন্দ অর্জন করার আরও একটি কারণ, এই কবিতায় বর্ণনা করা হয়েছে ব্যর্থ এক যৌনজীবন।

যৌনসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক এবং একইসঙ্গে অনালোচিত একটি প্রসঙ্গ। তাই এটি নিয়ে এই নিরক্ষরের দেশে সমস্যাও কম নয়। সমস্যা যত হচ্ছে, সমাধান সে-হারে হচ্ছে না। অধিকাংশ নারী নানা রকম যৌন জটিলতায় ভোগেন। তাঁরা অনেকে জানেনই না, যৌনজীবনে ‘শীর্ষ সুখ’ জিনিসটি ঠিক কীরকম।

যৌনজীবনের প্রতি অদ্ভুত এক ঘৃণা এবং ক্ষোভ সঞ্চার হয়েছে সাধারণ মানুষের দর্শক-শ্রোতারা একেবারেই অশিক্ষিত তা আমি বলব না, তাঁরা লেখাপড়া করেছেন, তাঁরা মানুষের জীবনের দুঃখ-সুখ সম্পর্কে সামান্যও জ্ঞান রাখেন না তাও নয়। তাঁরা আসলে যৌনগন্ধময় শব্দাবলি পুরুষের মুখেই শুনতে অভ্যস্ত। একজন নারী ছাপার অক্ষরে যৌনজীবনের কাহিনি বর্ণনা করলে তা সফল বা ব্যর্থ যে যৌনজীবনেরই হোক না কেন, তাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই ক্ষুব্ধ হবেন। এই ক্ষুব্ধ হওয়া থেকেই উৎপন্ন হয় স্থুল রসিকতা। শিস দেওয়া, চিৎকার করা, অশ্লীল উক্তি ছোড়া।

আমার প্রশ্ন, একজন কবি, তিনি যদি পুরুষ হন, তিনি কিন্তু নারীর স্তন, ঊরু, যোনি ইত্যাদি শব্দ নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারেন, সম্ভোগের নিখুঁত বর্ণনায় কোনও দর্শক-শ্রোতা তখন উত্তেজিত হন না। উত্তেজিত হন আসলে নারীর বেলায়। কারণ তাঁদের এমনই ধারণা, এই শব্দগুলো উচ্চারণ করবার অধিকার একমাত্র পুরুষেরই আছে। নারীর কলমে এই সব শব্দ লেখা হলে তাঁরা নারীটিকে মনে করেন, ‘প্রমোদের বস্তু’, নারীর মুখে এই সব শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে শুনলে পুরুষ দর্শক-শ্রোতারা লাফিয়ে ওঠেন বিকৃত উল্লাসে। তাঁরা মনে করেন, নারীর উচ্চারণ করা উচিত নয় এমন সব শব্দ বা বাক্য যা কেবল পুরুষের উচ্চারণের অধিকারভুক্ত! পুরুষেরা সাহসী মানুষ, তারা যুদ্ধ করে, জয় করে, ভোগ করে। যেহেতু ভোগ পুরুষেরাই একা করে, তাই পুরুষের দ্বারাই যাবতীয় দুর্ভোগ সম্ভব, যাবতীয় অনাচার, অত্যাচার, অসৌজন্য, অশ্লীলতা পুরুষকেই মানায়। অবাধ অশ্লীলতা করে আনন্দ অর্জন করবার অধিকার কেবল পুরুষেরই আছে। তাই নারী যখন ‘অশ্লীলতা’ করে, সমাজ থেকে তাকে বার করে দেওয়া হয়, নারী যখন অশ্লীল শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে, তাকে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হয় না। সমাজ ছাড়া মেয়েদের মুখেই ‘অশ্লীল শব্দাবলি’ অর্থাৎ যৌনগন্ধময় শব্দ মানায়, সমাজের মেয়েরা যদি সমাজের ভেতরেই আয়োজিত কোনও মঞ্চে উঠে ‘অশ্লীল শব্দ’ উচ্চারণ করে তবে আর রক্ষে নেই অথবা হয়তো অন্য এক মজাও আছে এতে। ‘ভদ্রমহিলার’ মুখ থেকে ‘অভদ্র’ উচ্চারণের স্বাদই অনেকের কাছে আলাদা। কবি শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ কেউই ‘নিয়তি’ কবিতাটি লিখলে বা পাঠ করলে পাঠক এবং দর্শক-শ্রোতাদের কোনও আপত্তি থাকত না, আপত্তি আসলে তসলিমা নাসরিন বলেই, আপত্তি ফাহমিদা সুলতানা হলেও হত, শাফিনাজ পারভিন হলেও হত। দোষ আসলে কবিতার নয়, দোষ কোনও যৌনগন্ধময় শব্দের নয়, দোষ রচয়িতার লিঙ্গের। রচয়িতা যদি নারী হয়, তবে সুড়সুড়ি লাগে বেশি। রচয়িতা পুরুষ হলে কোনও সুড়সুড়ি তো লাগেই না বরং সবকিছু বড় শ্লীল এবং সংযতই মনে হয়।

এই সমাজের চোখে ‘নিয়তি’ কবিতাটি ভীষণ দোষে দূষিত। ১৯৮৮ সালে এই কবিতাটি ‘রোববার’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করে একজন সহকারী সচিব আমাকে পরে জানিয়েছিল, এই কবিতাটিকে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে ‘রোববার’ পত্রিকাটির ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করে দেবার জন্য কাজ চলছে। শেষ অবধি অবশ্য পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু ‘নিয়তি’ কবিতাটি যদি পাঠকের চোখে অশ্লীল বলে মনে হয় তবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের পুরুষ-কবিদের অধিকাংশ কবিতাই অশ্লীল হতে বাধ্য।

‘নপুংসক’ শব্দটি নারীর ‘কোমল জিহ্বায়’ উচ্চারিত হচ্ছে—এ ঘটনা ‘শিশ্বসর্বস্ব পুরুষদের’ রাগের কারণ বই কী। আর অনেকের চোখে এ এক ধরনের বেয়াদবিও, কারণ পুরুষের দোষ, দুর্বলতা কেউ ফাস করে দিলে কি প্রাণে সয়? পুরুষ তো আর যে-সে জীব নয়। নারীর ‘প্রভুই বলতে গেলে। তা ছাড়া কথাই তো আছে Boss is always right. সে ‘পুংসক’ হলেও right, ‘নপুংসক’ হলেও right.

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন