তসলিমা নাসরিন
এই ঢাকা শহরে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ক’জন আছেন আমি জানি না। বেশ ক’জন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে আজকাল জানাচ্ছেন, এ-শহরে আপনার শত্রু খুব বেশি। কেউ এও বলেছেন, ‘বাইরে একা বেরোবেন না।’ কেউ আবার এও জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আচ্ছা, শত্রু বেশি হবার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
শত্রু কেন বেশি—এ আমি আসলেই জানি না। আমি জন্মেছি আদর্শবাদী চিকিৎসক পিতা ও অল্পশিক্ষিত ধর্মভীরু মায়ের সংসারে, আমাদের কখনও অঢেল বিত্ত ছিল না, তবে সচ্ছলতা ছিল। আমি এবং আমার ভাই-বোনেরা লেখাপড়া করেছি, নম্রতা শিখেছি এবং শিখেছি শিষ্টতা, শিখেছি মানুষের অনিষ্ট না করা। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের যা আছে তা কেড়ে নিচ্ছে দূরের আত্মীয়রা, আমাদের ফুলের বাগান পাশের বাড়ির গোরু-ছাগল এসে তছনছ করে দিচ্ছে, শখ করে পড়শিরা লেলিয়ে দিচ্ছে সাপ, আমাদের জলভরা পুকুর দখল করে নিয়ে গেছে পেশিবাজ মানুষরা, মাস গেলেই বাড়িতে ডাকাত পড়ে, লুঠ করে নিয়ে যায় সহায়সম্বল; আমরা নিরীহ, নির্যাতিত প্রাণী একের পর এক শক্তিমান শোষক দ্বারা নিঃস্ব হয়েছি।
আমি ব্যক্তিগত জীবনেও একাধিক মানুষ দ্বারা অসম্মানিত হয়েছি। আমার বাবা বলতেন, ‘লেখাপড়া করলে সব দুঃখ ধুয়ে যাবে।’ লেখাপড়া করেছি, বড় হয়েছি, আর বুকের মধ্যে সেইসঙ্গে দুঃখও তার শরীর-স্বাস্থ্যসহ পাহাড়সমান বড় হয়েছে। এই পাহাড় ধোবার জল আমার সমুদ্রে নেই। আজ পর্যন্ত, এটি স্থির সত্য, আমি কারও অনিষ্ট করিনি, কোনও মানুষের কোনও ক্ষতি আমি জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, করিনি। আমি কেবল সকল সর্বনাশ নিয়ে নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে থেকেছি।
লিখেছি, যদি কিছু অন্যায় করে থাকি, এটিই করেছি। ভেতরের অভিমানী, অন্তর্মুখী নিঃস্ব, নির্জন মানুষটি ক্ষোভের কথা, কষ্টের কথা অকপটে লিখেছে। এতে কি শত্রু বেড়েছে—কেন লিখি, কেন হাতের আঙুলে উঠেছে অবাধ্য, অস্থির কলম?
শত্রু বেড়েছে, আমার চেয়ে এ-কথা বেশি টের পান শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাঁরা নানা আড্ডায়, আলোচনায় শত্রুদের বাক্যবাণে আহত হন। আমার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমি কোনও আড্ডায় বা আলোচনায় সাহিত্যের হোক, অসাহিত্যের হোক, অংশগ্রহণ করি না। নিজেকে অযোগ্য ঠেকে হয়তো। এত জ্ঞানীগুণীজনের ভিড়ে আমি এত অকিঞ্চিৎকর যে, আড়ালে থাকি, অদৃশ্যে থাকি।
কিছু লিখি, একেবারে সামান্য, এ-নিয়ে আমার অহংকারের কিছু নেই, যে-কোনও দিন লেখা ছেড়ে বনবাসে যেতে পারি। যে-কোনও দিন লেখা ছেড়ে হাওয়ায় হারাতে পারি। লিখি বলে কেউ-কেউ পেষণ কমিটি করে, লিখি বলে মৌলবাদীরা ফাঁসির দাবি তোলে, লিখি বলে কারও মতের সঙ্গে আমার মতের গরমিল হলেই বেনামে চিঠি যায় পত্রিকায়। একটি অভব্য পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আমার সাক্ষাৎকারের জন্য তিনদিন এসেছিল আমার বাড়িতে, আমি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি না হওয়ায় মেয়েটি তার পত্রিকায় আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করেছে। গালগাল করছেই, কার সাধ্য আছে বন্ধ করে? আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি আমি অসম্মানিত হলেও আমার শত্রু বাড়ে, আবার সম্মানিত হলেও বাড়ে। আমি যখন কারও দ্বারা চরম অসম্মানিত হই, শহরে শত্রুসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়, কাগজে কাগজে খবর বের হয়—উদ্ভট সব খবর। আবার সম্মানিত হলেও একই অবস্থা, এত বড় সম্মান আমার জুটেছে, আর কারও কেন জোটেনি সে নিয়ে আমাকে হেনস্থা করবার জন্য দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ বেড়ে যায় শত্রুসংখ্যা। আমি সর্বংসহা মৃত্তিকার মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকি, আমি জীবন পেতে দিই, ওরা আমার জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে হল্লা করে, উদ্বাহু নৃত্য করে।
আমার দ্বারা, আমি জানি, আমার সুস্থ স্নায়ুতন্ত্র জানে, আমার নিরীহ আত্মীয়রা জানে—কারও কোনও ক্ষতি হয়নি। কারও পাকা ধানে মই দিতে জানি না, কারও বাড়া ভাতে আমি ছাই দিতে জানি না। তবু এই নির্বোধ আমি, নিরুচ্চার নিরুত্তাপ আমি, আমাকেই দেখতে হয় চারদিকের দা-কুড়ুল হাতে নিয়ে আসা, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠা বীভৎস মুখ। আমাকে ভেসে যেতে হয় বিরুদ্ধ স্রোতে, বাঁচবার জন্য আমাকে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে হয়, আমাকে ডুবতে হয়। আমাকে মরতে হয়।
হ্যাঁ, মরতেও হয় বই কী। মাঝেমধ্যে বেঁচে আছি কি মরে গেছি—ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। বেঁচে থাকা ঠিক কার নাম, বেঁচে থাকতে হলে কী করে শ্বাস নিতে হয়, কী করে পা ফেলতে হয় মাটিতে, কী করে দৌড়োতে হয়, কী করে হাসতে হয়, কাঁদতে হয় আমি জানি না। আমি বোধহয় বেঁচে থাকবার যোগ্য মানুষ নই।
আসলে বাবা আমাদের শেখায়নি কেবল সারল্য দিয়ে জীবনে সাফল্য আসে না, একটু-আধটু চতুরতা দরকার, একটু-আধটু কৃত্রিমতা। বাবা আমাদের শেখায়নি আমার গালে কেউ চড় দিলে তার গালেও চড় দিতে, বাবা শিখিয়েছেন কেউ চড় দিলে তাকে নিজেরই আরেক গাল বাড়িয়ে দিতে। বাবা উদারতার কথা বলতেন, সহিষ্ণুতার কথা বলতেন।
শত্রু বাড়ছে, আমার হাতে কোনও লাগাম নেই শত্রু সংযত করবার। আমি নিঃস্ব, নির্জন হাতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার অর্থ নেই, যশ নেই কেবল জীর্ণ এক হৃদয় আছে, আঘাতে ও আগুনে এই হৃদয় এখন ক্লান্ত। অসংখ্য গুণী লেখকের কাছে, বিজ্ঞ পাঠকের কাছে এবং সম্মানিত শত্রু বা নিন্দুকের কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করি। আমাকে ক্ষমা করুন, আমি বুঝে গিয়েছি আমি ডানে ফিরলেও মন্দ, বাঁয়ে ফিরলেও মন্দ। ডানে ফিরলে লোকে বলবে, কেন বাঁয়ে তাকাইনি, নিশ্চয় কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল! আর বাঁয়ে ফিরলেও মন্দ, নিশ্চয় বাঁ থেকে কোনও পরশপাথর পাবার অপরাধ করেছি! কেউ আমার গালে চড় দিলেও আমার দোষ, না দিলেও আমার দোষ। এখন বেঁচে থেকেও দেখি দোষ। জানি মরলেও দোষ হবে। দোষের হাত থেকে আমার উদ্ধার নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন