‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’

তসলিমা নাসরিন

সম্প্রতি কানাডায় নতুন এক বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়ে গেল। ওখানকার আইন বলে, পুরুষেরাই শুধু অধিকার রাখেন শরীরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত রেখে চলাফেরা করবার। নারীর এ অধিকার নেই, নারীর উত্তমাঙ্গ অনাবৃত রেখে ঘরের বাইরে বেরোনো চলবে না। এই আইনের প্রতিবাদকারীরা কানাডার রাস্তায় মিছিল করেছেন। এই মিছিলে কিছু নারী ছিলেন, তাঁদের উত্তমাঙ্গ অনাবৃত ছিল। নারীর অনাবৃত শরীর দেখে সভ্য এবং অসভ্য দু’ ধরনের মানুষই ছি ছি করেছেন। তাঁদের কাছে এই প্রতিবাদের উপলক্ষ এবং প্রতিবাদের ধরন দুই-ই উদ্ভট ঠেকেছে। নারীদেহ অনাবৃত হতে পারে বিভিন্ন অবস্থায়। একজন চিকিৎসক যখন কোনও নারীদেহ অনাবৃত করে রোগপরীক্ষা করেন অথবা অস্ত্রোপচারে উদ্যত হন, তখন সেই নারীদেহকে অশ্লীল মনে হয় না, যদিও এই একই দেহ চিকিৎসকের নাগালের বাইরে গিয়ে অনাবৃত হলে অশ্লীল ঠেকে। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশে নারীদেহ প্রদর্শিত হলে সেই দেহও নিঃসন্দেহে অশ্লীল মনে হবে। আর সুস্থতার প্রয়োজনে, শিল্পের প্রয়োজনে এবং প্রতিবাদের প্রয়োজনে যে নারীদেহ অনাবৃত হয়, তাকে আমার আদৌ অশ্লীল মনে হয় না। দেশি উদাহরণ দিতে গেলে, সওদাগর ছবির উদোম অঞ্জু ঘোষ এবং সূর্য দিঘল বাড়ির উদোম ডলি আনোয়ারের মধ্যে নিশ্চয় পার্থক্য লক্ষ করি। অঞ্জু ঘোষকে উদোম করবার উদ্দেশ্যটি অশ্লীল ছিল, ডলি আনোয়ারকে উদোম করবার উদ্দেশ্য, আমরা সকলেই স্বীকার করি, অশ্লীল ছিল না।

প্রতিবাদের প্রয়োজনে কানাডার নারীরা উত্তমাঙ্গ অনাবৃত রেখে মিছিল করেছেন। এখানে আমি বলব, আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করতে পারেন, তাঁরা উত্তমাঙ্গ অনাবৃত রেখে চলাফেরা করতে আগ্রহী। আসলে তা নয়, আসলে তাঁরা প্রতিবাদ করছেন সেই আইনের বিরুদ্ধে, যে আইন নারীকে নির্দেশ দিচ্ছে উত্তমাঙ্গ অনাবৃত না করবার। যে বাধা বা যে প্রতিবন্ধকতা রচিত হয়েছে কেবল নারীর ক্ষেত্রে—নারীরা তার প্রতিবাদ করেছেন মাত্র। এই প্রতিবাদকে আমি ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ বলতে চাই। কারণ কানাডার সচেতন নারীরা নারী-পুরুষের আইনের মধ্যে কোনও বৈষম্য মানতে রাজি নন। প্রতিবাদের প্রক্রিয়া যেমনই হোক, উদ্দেশ্য কিন্তু একটিই, তাঁরা সকল বৈষম্যের অবসান চান।

ষাটের দশকে আরও এক ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। পাশ্চাত্যে তখন নারীমুক্তি আন্দোলন তুঙ্গে, পুরুষশাসিত সমাজ নারীর শরীরকে নানা রকম বল্কলে ঢাকে, অন্তর্বাসকে এমন এক বল্কল আখ্যা দিয়ে পাশ্চাত্যের স্বাধিকার-সচেতন নারীরা তাঁদের অন্তর্বাস পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই অন্তর্বাস পোড়ানোর নেতিবাচক ব্যাখ্যা দিতে পুরুষতন্ত্রের সকল শাখাপ্রশাখা তখন অত্যন্ত তৎপর ছিল। পুরুষতন্ত্রের কৌশলই এই, নারীপক্ষের যে-কোনও আন্দোলনকে যে-কোনও উপায়ে ধূলিসাৎ করা, অন্তর্বাস পোড়ানোর মূল উদ্দেশ্যের দিকে না গিয়ে পুরুষতন্ত্রের আদরে-আহ্লাদে লালিত মানুষেরা দৃষ্টি ফেরাল বস্তু অন্তর্বাসের দিকে। এই বিচারবিভ্রাট ষাটের দশকে ঘটেছিল, আশঙ্কা করি, কানাডার এই সাম্প্রতিক প্রতিবাদেরও এমন বিচারবিভ্ৰাট ঘটবে। এই প্রতিবাদ নিন্দিত হবে সকল মহলে। প্রতিবাদ প্রতিবাদই। উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, সুস্থ হয়, তবে প্রতিবাদের পদ্ধতি যেমনই হোক—তা দৃষ্টিকটু হতে পারে না। আমরা এখন পদ্ধতির দিকে নয়, সমান অধিকারের দাবির দিকে, বৈষম্য নির্মূলের দিকে নজর দেব। আমরা এখন অন্তর্বাস এবং উত্তমাঙ্গ নিয়ে নয়, নারীর শরীরকে আবৃত করবার যে অসৎ উদ্দেশ্যটি সকল পুরুষশাসিত সমাজই যত্নসহ লালন করছে, সেটিকে প্রকাশ করতে চাই। পুরুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে নারীর শরীরকে সুগঠিত করবার নানা রকম কৌশল আবিষ্কার করেছে। তারা নারীর শরীরকে রঙে ডুবিয়েছে যেন রঙিন সৌন্দর্যে তারা মোহিত হয়। নারীদেহকে স্বাদে-গন্ধে উপাদেয় করবার জন্য যা-যা প্রয়োজন, যতটুকু রংঢং, যতটুকু বন্দিত্ব এবং যতটুকু মুক্তি, সবই নারীর ওপর আরোপ করেছে পুরুষেরা। নারী অন্তর্বাস ব্যবহার করবে কি করবে না তা সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যাপার। সে ইচ্ছে করলে তার অন্তর্বাস পোড়াতে পারে, ছুড়ে ফেলতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে ব্যবহারও করতে পারে। নারী উত্তমাঙ্গ অনাবৃত করবে কি না করবে, তাও সম্পূর্ণ নারীর ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আইন কেন নারীর উপর আরোপ করা হবে? আইন কেন নারীকে সতর্ক করে বলবে যে, তার জন্য এ-কাজটি নিষিদ্ধ! হয়তো নারী নিজেই উত্তমাঙ্গ অনাবৃত করবে না, কিন্তু না করবার জন্য এই যে নির্দেশ, এটি তার সম্মান নষ্ট করছে নিশ্চয়ই। তাই আইনের এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে কানাডার নারীরা পথে নেমেছেন।

আমি, তৃতীয় বিশ্বের এক দগ্ধ নারী, কানাডার প্রতিবাদী নারীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমার এই দেশে পথেঘাটের প্রায়-উলঙ্গ নারীরা এক টুকরো বস্ত্র চেয়ে বেড়ায় লজ্জা ঢাকবার জন্য। তাদের উত্তমাঙ্গ অনাবৃত থাকে, এই দেশ তাদের বস্ত্র দিতে পারে না পরিধানের জন্য, তাদের কাছে কানাডার প্রতিবাদ হাস্যকর ঠেকবে নিশ্চয়। আমরা চিৎকার করছি নারীর অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের জন্য, আন্দোলন করছি নারী যেন স্বাবলম্বী হয়ে নিজের সকল প্রয়োজন মেটাতে পারে। এও নারীর মঙ্গলের আন্দোলন। কানাডার বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আন্দোলনও নারীর মঙ্গলের আন্দোলন। দু’ধরনের দেশে দু’রকমের আন্দোলন। নারীর মঙ্গলের জন্য যে-কোনও বিক্ষোভের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছি আমি এবং আমার মতো আরও অনেকে।

আমরা কি পারি না নারীকে অবনমনের সকল আইনের বিরুদ্ধে একযোগে পথে নেমে বিক্ষোভ করতে?

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন