‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’

তসলিমা নাসরিন

আমার জন্ম শহরে। শহরেই বড় হয়ে উঠেছি। বাবার মুখে গ্রামের গল্প শুনতাম ছোটবেলায়। বইপত্রে গ্রাম সম্পর্কে পড়তাম ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গোরু, পুকুর ভরা মাছ।’ একাত্তরে যুদ্ধের সময় চোখের সামনে গ্রাম দেখলাম, তাও ঠিক গ্রাম নয়, শহরতলিই বলা যায়। সেও বেশিদিন নয়। আলপথে হেঁটে, পুকুরে সাঁতার শিখে দেখতে দেখতে পাঁচ-ছ’মাস কেটে গেল। আমাদের ফিরতে হল আবার শহরে।

আসলে গ্রাম আমার দেখা হয় ট্রেনের জানালা দিয়ে। ট্রেনের টিকিট কাটতে গেলে আমার শর্ত থাকে সিট যেন জানালার পাশে হয়। শীত হোক, বর্ষা হোক আমি জানালা খুলে গ্রাম দেখি। কোথাও শনে ছাওয়া ঘর, কোথাও মাটির উঠোনে খড়ের গাদা, গাছের ছায়ায় বসে গোরু জাবর কাটছে। গ্রামে আমার সবচেয়ে ভাল লাগে শানবাঁধানো স্বচ্ছ জলের পুকুর আর বট-অশ্বত্থের ছায়া। বৃক্ষের ছায়ায় বসে দিগন্ত অবধি সবুজ ধানখেত দেখলে মন ভরে যায়।

সেদিন গ্রামে সারাদিনের জন্য ঘুরে বেড়াবার সুযোগ হল। আমি বেশ আহ্লাদিত। সেই একাত্তরে যেমন দেখেছিলাম, লাল-সবুজ ফুলপাতা আঁকা সবচেয়ে ভাল কাচের গ্লাসে পানি দেবে। গাছের আম-পেয়ারা-জাম যা থাকে পেড়ে এনে সামনে দেবে। গায়ে হাত বুলিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করবে। টিনের ট্রাংক খুলে ফুল-আঁকা চিনেমাটির থালা বার করে গরম ভাত খেতে দেবে, সঙ্গে খেতের সবজি, পুকুরের মাছ। এ-রকমই ছিল আমার চোখে গ্রামের ছবি। তো এবার, এই যে গ্রামে গেলাম, আমার চারপাশে বাচ্চাদের ভিড় জমে জমে গেল। ওরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আমার দিকে অবাক তাকিয়ে রইল। এতগুলো মানুষ তাকিয়ে থাকলে কেমন অস্বস্তি লাগে। আমি অস্বস্তি কাটাতে উঠোনে হেঁটে বেড়ালাম। বাড়ির বড় মেয়েরা অচেনা চোখে আমাকে দেখল, গৃহিণীরা নিজেদের কাজে মেতে রইল। আমার জন্য কেউ গাছের ডাব পাড়ল না, কেউ তরতর করে পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা পাড়ল না। যেন আমি অদ্ভুত এক শহুরে জীব এসেছি, আমার খিদে-ফিদে লাগে না, আর আমি ফলমূল খেতেও জামি না।

যে বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, দুপুর গড়িয়ে যায়, কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতে আসেনি আমার খিদে পেয়েছে কি না, কিছু খাব কি না। বিকেলে সাড়ে তিনটের দিকে টিনের থালায় করে এক মহিলা আমার জন্য ভাত নিয়ে এলেন, সঙ্গে সজনের ডাল। জিজ্ঞেস করলাম—‘আপনারা খেয়েছেন?’ মহিলা মাথা নাড়লেন—‘না।’

খেতে গিয়ে দেখি গলায় আটকে যাচ্ছে ভাত। খেতে পারি না। মহিলা দাঁড়িয়েই রইলেন, জিজ্ঞেস করলাম—‘আপনার ছেলে-মেয়ে যেন ক’জন?’ বললেন— ‘এগারোজন।’

‘এগারো জন?’ আমি চমকে উঠলাম। কারও বাচ্চা এগারোটা পর্যন্ত হয় নাকি? জিজ্ঞেস করলাম—‘সবই আপনার পেটের?

মহিলা আঁচলে মুখ ডেকে বললেন—‘হ্যাঁ।’

ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করলাম—‘এখানে পরিবার পরিকল্পনার লোক আসে না?’

‘আসে।’

‘তারা বলে না কিছু?’

‘তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয় না।’

‘কে দেয় না?’

‘সিরাজের বাপ।’

সিরাজের বাবা মানে মহিলার স্বামী। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলে ক’জন আপনার?’

‘সাতজন।’

একবার ভেবেছিলাম, যা হয়—একটি ছেলের আশায় অনেক বাচ্চার জন্ম দেয়।

যেমন কেবলই মেয়ে জন্মাচ্ছে, দশটি মেয়ে হওয়ার পর এগারো নম্বরটি ছেলে হল, তারপর তারা উৎপাদন থামাল। এ-ক্ষেত্রে এগারোর মধ্যে সাতটিই ছেলে।

জিজ্ঞেস করি, ‘কেউ কি পড়াশুনা করে?’ মহিলা আঁচল টেনে বললেন, ‘না।’

আমার ভাত খাওয়া থেমে গেল। হাত ধুয়ে নিলাম। এঁরা আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। প্রথমে বেড়াতে এসেছি গ্রামে, গ্রামের সবুজ প্রাণ দেখব বলে আসা।

‘এতগুলো ছেলেপুলে খাওয়াতে পারেন?

এর মধ্যে সিরাজের বাবা এলেন, তাঁকেও এই একই প্রশ্ন করলাম। বললেন- ‘আল্লাহ্‌র বান্দা, আল্লাহ্ই খাওয়ায়।’

‘আল্লায় খাওয়ায় মানে? আপনাকেই তো খেতে ছুটতে হয়, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যা জোটে তাই তো খান এবং ওদের খাওয়ান। আপনি না খাওয়ালে দেখুন তো আল্লাহ্ খাওয়ায় কি না। আর আল্লাহ্ আপনাদের ডিম, দুধ, মাছমাংসই বা কেন খাওয়ায় না?’ সিরাজের বাবা নিঃশব্দে হাসলেন। বললাম—‘পরিবার পরিকল্পনার লোককে নাকি বাড়িতে ঢুকতে দেন না?’ সিরাজের বাবা দাওয়ায় বসে সাদা চোখে তাকিয়েছিলেন উঠোনের দিকে, বললেন, ‘ওগুলো মানলে গুনাহ হবে।’

‘পরিবার পরিকল্পনা করলে গুনাহ হবে? ‘

‘হ্যাঁ, আল্লাহ্ আত্মা দিয়েছেন। এই আত্মা যে আমি মারব, আল্লাহ্ বলেছেন তুমি যদি আত্মা বানাতে পারো তবে তুমি আত্মা মারো। আল্লাহ্‌র দেওয়া আত্মা মারলে নির্ঘাত দোজখবাস। ‘

এই সিরাজের বাবা রহিসউদ্দিন দোজখের ভয়ে জন্মশাসন করেন না। তিনি বেহেশতে যেতে চান। সবারই খুব বেহেশতের শখ। রইসউদ্দিন দাড়ি রেখেছেন। মাথায় টুপিও পরেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আরবিতে যে সুরা পড়ছেন, সুরার অর্থ জানেন?

রইসউদ্দিন হেসে বললেন—না। আল্লাহ্ নামাজ পড়তে বলেছেন, তাই পড়ি। আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, অর্থ কী করে জানব?

গ্রাম তো কেবল সবুজ ধান-পাট নয়, কেবল স্বচ্ছ জলের পুকুর নয়। বৃক্ষের ছায়া নয়। গ্রাম মানে গ্রামের মানুষও তো। তারা এগারো সন্তান নিয়ে সংসারে অসচ্ছলতা ডেকে আনে। দারিদ্র্যের চাবুক পড়ে পিঠে। তারা বেহেশতের লোভে জীবন ছেড়ে দেয় অদৃষ্টের হাতে। আর অদৃষ্ট খেলা করে মানুষ নামক এইসব বোকা ও নিরীহ প্রাণী নিয়ে। আমরা লেখাপড়া-জানা শহুরে মানুষেরা নানা রকম তত্ত্বকথা জানি, মার্কসবাদ জানি, অর্থনীতি, রাজনীতির যোগ-বিয়োগ জানি, আমরা কেবল তাদের উদ্ধার করতে জানি না। অলৌকিকতার পঙ্গপাল থেকে আমাদের সুন্দর, সবুজ গ্রামকে আমরা রক্ষা করতে জানি না।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন