তসলিমা নাসরিন
জোসেফের সঙ্গে মেরির শারীরিক সম্পর্ক হয়তো হয়নি কিন্তু অন্য পুরুষের সঙ্গে হয়েছিল, এ-কথা চার্চের অনেকেই আজকাল বিশ্বাস করেন। ক্যাথলিক র্যাংক হিনিমেন বলেছেন—জিশু হচ্ছে a monstrous product of neurotic sexual fanta- sy, এ কথা শুনে ভ্যাটিকান থেকে মত দেওয়া হয়েছে——The church doesn’t have problems with sex . The world does.
পুরুষের স্পার্মাটোজোয়া নামক পদার্থটি ছাড়া নারীর জরায়ু নানা রকম সন্ত্রাস হয়তো জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সন্তান নয়। এই কথাটি যে-কোনও সুস্থ মানুষই স্বীকার করতে বাধ্য। কুমারী নারীর গর্ভে সন্তানধারণ বৈধ নয়—পুরুষ-তৈরি এই নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দি প্রতিটি নারীর জরায়ু। নারীর যেমন কোথাও স্বাধীনতা নেই, নারীর জরায়ুরও নেই। জিশু রক্ষা পেয়েছেন জারজ শব্দটির হাত থেকে। ‘ঈশ্বর’ তাঁকে রক্ষা করেছেন। ঈশ্বর শুধু জিশুকেই রক্ষা করেছেন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে করেননি। এমন আরও অনেককে করেননি। ষোলো বছরের কুমারী মেয়ের সন্তান লিওনার্দো দা ভিঞ্চির পক্ষে সম্ভব হয়েছে ‘লাস্ট সাপার’, ‘ভার্জিন অব দ্য রকস’, ‘দ্য এডোরেশন অব দ্য মেগি’র মতো অবিস্মরণীয় শিল্পসৃষ্টি। এই জারজ সন্তানের শিল্প বিভিন্ন গির্জায় এখন সম্মানিত হয়।
ফিলিপপিনো লিপপির ‘জন্মের ঠিক নেই’ কিন্তু তাঁর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি বহু ধর্মযাজকের ঈর্ষার কারণ। লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে রাখা তাঁর ‘দি ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইদ সেন্ট ডোমেনিক’ ছবির পটভূমিতে আছে, ‘শুভ্র বসন্ত-পুষ্পের পবিত্রতা’ ও স্নিগ্ধতা, ‘তরুশ্রেণির ও দিগন্তের নম্র নীল আকাশে অপার অগাধ শান্তির অনন্ত আশ্বাস’।
বুদ্ধিভিত্তিক রেনেসাঁসের স্রষ্টা ও রাজা ছিলেন মহাত্মা মার্টিন লুথারের বন্ধু, রোটডামের ওলন্দাজ মনীষী ইরাস মাস। ইরাস মাস এক ধর্মযাজকের ‘অবৈধ সন্তান’। তাঁকে বাদ দিয়ে রেনেসাঁসের কল্পনা করা যায় না। “He is considered by many scholars the greatest Humanist of the entire Renaissance” Doris van de Bogart (Introduction to the greatest Humanities. New York) fa আলেকজান্ডার পোপ তাঁর Essay on criticism-এ ইরাস মাসকে যাজককুলের গৌরব বলেছেন।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হার্মেঞ্জ ভ্যান রাইন রেমব্রান্ট আমস্টারডামের ওলন্দাজ। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম সাপার অ্যাট ইউমাস এবং দ্য নাইট ওয়াচের আলো-ছায়ার খেলার চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়নি এমন কেউ নেই। এই অন্তর্মুখী শিল্পী হেনড্রিকিযে স্টফেলস নামের এক তরুণীকে সারা জীবনের সঙ্গী করেন। আনুষ্ঠানিক বিয়ে প্রয়োজন মনে না হওয়ায় তাঁরা বিয়ে করেননি। হেনড্রিকিযে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ক্যালভিনিস্ট চার্চের পাণ্ডারা মায়ের পাপে অজাত সন্তানের নরকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় দেখান।
ফ্রান্সের সৃষ্টিশীল দার্শনিক, জ্ঞানদীপ্ত চিন্তাবিদ্, শ্রেষ্ঠ অঙ্কবিদ জ্যা রঁ দালেম বেয়ার ছিলেন মাদাম দ্য তস্যার ‘অবৈধ সন্তান’। তাঁর পিতা শেভালিয়ে দেসতুশে ছিলেন গোলন্দাজ বাহিনীর কমিসার জেনারেল, তিনি পুত্রকে এমন প্রখর শিক্ষায় শিক্ষিত করেন যে, এই পুত্রই হয়ে ওঠেন কালের শ্রেষ্ঠতম গণিতবিদ। প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক গি দ্য মোপাসাঁর পিতা ছিলেন গুস্তভ ফ্লবের, মোপাসাঁর মা লবের সঙ্গে ছিল তাঁর ‘অবৈধ সম্পর্ক’। এতে মোপাসাঁর প্রতিভার কোনও হেরফের হয়নি।
আমরা কনফুসিয়াসের কথা জানি। তাঁর নাম আসলে কংফু-সে। চিনের বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস তাঁর জ্ঞান, মনীষা ও পাণ্ডিত্যের কারণে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৭ অব্দে চিনের বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী হন। কনফুসিয়াস ছিলেন সুনীতি ও সদাচরণের প্রবক্তা—তিনি চিনের জনগণকে ভদ্র, সদাচারী, মহৎ ও সংস্কৃতিমনস্ক করে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি ধর্মগ্রন্থের সমান সম্মান পেয়েছিল, যে সম্মান হিন্দুরা বেদ ও গীতাকে, খ্রিস্টানরা বাইবেলকে এবং মুসলমানরা কোরানকে করে। আড়াই হাজার বছর ধরে চিনের মানুষ তাঁকে The most Sage Ancient Teacher হিসেবে শ্রদ্ধা করছে। তাঁর পিতা শানতুং প্রদেশের এক জেলার গভর্নর। কিন্তু লোকে বলে কনফুসিয়াস তাঁর পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেননি। এ তো সামান্য ক’টি উদাহরণ। পুরো পৃথিবীতে এমন প্রচুর কৃতী সন্তান।
পৃথিবীতে অনেক অসভ্য শব্দের জন্ম হয়েছে—এর মধ্যে ‘জারজ’ শব্দটি অন্যতম একটি। মানুষের সকল জন্মই বৈধ। কোনও সন্তানই অবৈধ নয়, সব সন্তানই মানবসন্তান। জারজ ও অজারজ সন্তানে কোনও পার্থক্য নেই। সব সন্তানই বৈধ, সব সন্তান সুন্দর, পবিত্র।
যে নারীকে অসতী বলা হয়, যে শারীরিক সম্পর্কের কারণে বলা হয়, সে-কারণে, কোনও পুরুষকে এ-জাতীয় কোনও নামে অসম্মানিত করা হয় না। তাই ‘অসতী’– এই অশ্লীল ও অসভ্য শব্দটি সমাজ থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হওয়া যেমন উচিত, ‘জারজ’ শব্দটিরও তেমন,বিলুপ্তি দরকার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন