সংসার-চিতা

তসলিমা নাসরিন

রামমোহন রায় সম্ভবত জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে। তখন ভারতবর্ষে ছিল ‘সহমরণ’ নামক একপ্রকার প্রথা। এই প্রথাটির অর্থ পতি নামক পুরুষের মৃত্যু হলে স্ত্রী নামক বস্তুটিকে পতি-পোড়ার আগুনে পুড়তে হবে। ভারতবর্ষে তখন সেই আগুনই দাউদাউ জ্বলছিল। ‘রাজা রামমোহন রায়’ নামটির সঙ্গে সহমরণের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। ১৮১৮-১৯ সালে রামমোহন রায় লিখেছিলেন, “স্বামী মরিলে পর যে স্ত্রী ওই পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতি যে বশিষ্ঠের পত্নী তাঁহার সমান হইয়া স্বর্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভর্তার সহিত পরলোকগমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বর্গে বাস করে।… যে স্ত্রী ভর্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মাতৃকুল, পিতৃকুল এবং স্বামীকুল এই তিন কুলকে পবিত্র করে।” এ অবশ্য রামমোহন রায়ের কথা নয়। এ হচ্ছে ‘সহমরণ’ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ রচনাটির প্রবর্তকের ভাষ্য। নিবর্তকের ভাষায় রামমোহন বলেছেন, ‘তোমরা অগ্রে ওই বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ় বন্ধন করো, পরে তাহার উপর এত কাষ্ঠ দেহ যাহাতে ওই বিধবা উঠিতে না পারে, তাহার পর অগ্নি দেওনকালে দুই বৃহৎ বাঁশ দিয়া ছুপিয়া রাখো। এ সকল বন্ধনাদি কর্ম কোন হারিতাদির বচনে আছে যে, তদনুসারে করিয়া থাকহ অতএব এ কেবল জ্ঞানপূর্বক স্ত্রী হত্যা হয়।’

আমাদের পূর্বপুরুষেরা জ্ঞানপূর্বক স্ত্রীহত্যা করেছেন। তাঁরা বলতেন, ‘এরূপ সহমরণে ও অনুসরণে পাপই হউক কিংবা যাহা হউক আমরা এ ব্যবহারকে নিবর্ত করিতে দিব না। ইহার নিবৃত্তি হইলে হঠাৎ লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে, স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সহমরণ করিলে আশঙ্কা থাকে না। জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও জীবৎকালে জানিতে পারে তবে তাহারও মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনও চিন্তা হয় না ইতি।’

জ্ঞানপূর্ব স্ত্রীহত্যার এই তো উৎকৃষ্ট নমুনা। বিধবা অবস্থায় ব্যভিচার করবার সম্ভাবনা অথবা আশঙ্কা আছে বলে স্ত্রীকে হত্যা করাই সংগত বলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মনে করতেন। তাই তারা নিঃশঙ্ক হতে চাইতেন স্ত্রীকে স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে, স্বামীও নিঃশঙ্ক হতেন— স্ত্রী পুড়েছে, স্ত্রীর্ঘটিতে কলঙ্কের বোঝা আর তাকে বইতে হবে না বলে।

প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পার্বতী, চন্দ্রমুখী, রাজলক্ষ্মী, হরিলক্ষ্মী, ভবানী, সবিতা, সারদাদের নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, তাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, স্বামীর ঘরে পাঠিয়েছেন, বিধবা বানিয়েছেন, প্রেমে পড়িয়েছেন। তিনিও জানতেন নারীত্বের মূল্য কী। তিনি লিখেছেন, ‘নারীত্বের মূল্য কী? অর্থাৎ কী পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখকষ্টে মৌনা। অর্থাৎ তাহাকে লইয়া কী পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কী পরিমাণে তিনি রূপসি অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন। দাম কষিবার এ ছাড়া আর কোনও পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিয়া দিতে পারি।’

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরও বলেছেন, ‘যাঁহারা ইতিহাস পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন বিধবাবিবাহ জগতের কোনও দেশে কোনওদিন সমাদর পায় নাই। কমবেশি ইহাকে সকলেই অশ্রদ্ধার চোখে দেখিয়া আসিয়াছে। এ অবস্থায় যে দেশে এ প্রথা একেবারেই নিষিদ্ধ, সে দেশে পুড়াইয়া মারা যে বিশেষ হিতকর অনুষ্ঠান বলিয়াই বিবেচিত হইবে, তাহা আশ্চর্য নয়। পুরুষ বুঝাইয়াছে, সহমৃতা হওয়া সতীর পরমধর্ম। মনুও বলিয়াছেন, এক পতি সেবা ব্যতীত স্ত্রীলোকের আর কোনও কাজ নাই। সে ইহকালে পুরুষের সেবা করিয়াছে, পরকালে গিয়াও করিবে।’

তিনি সহমরণ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘স্বামীর মৃত্যুর পরই তাহার বিধবাকে একবাটি সিদ্ধি ও ধুতুরা পান করাইয়া মাতাল করিয়া দেওয়া হইত। শ্মশানের পথে কখনও-বা সে হাসিত, কখনও বা কাঁদিত, কখনও-বা পথের মধ্যে ঢুলিয়া ঘুমাইয়া পড়িতে চাহিত। এই তার হাসি, এই তার সহমৃতা হইতে যাওয়া। তারপর চিতায় বসাইয়া কাঁচা বাঁশের মাচা বুনিয়া চাপিয়া ধরা হইত, পাছে সতী দাহ-যন্ত্রণা আর সহ্য করিতে না পারে। এত ধুনা ও ঘি ছড়াইয়া অন্ধকার ধুঁয়া করা হইত যে, কেহ তাহার যন্ত্রণা দেখিয়া যেন ভয় না পায়; এবং এত রাজ্যের ঢাকঢোল, বাঁশি ও শাঁখ সজোরে বাজানো হইত যে, কেহ যেন তাহার চিৎকার, কান্না বা অনুনয়-বিনয় না শোনে! এই তো সহমরণ!’

আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে এখনও বিধবার শাড়ি, চুল, হাত বা ঠ্যাং ধরে টেনেহিঁচড়ে চিতায় তুলবার দাগ, আমাদের পূর্বপুরুষের হাতে বাঁশ দিয়ে বিধবা মেয়েকে চেপে ধরবার দাগ, এখনও পূর্বপুরুষের হাতে আমি আগুনের, ভস্মের গন্ধ পাই। এখনও পূর্বপুরুষের রক্ত থেকে নারীকে অপদস্থ করবার, আগুনে পোড়াবার প্রবণতা দূর হয়নি। এখনও ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় সহমরণ প্রথা চলছে সমাজে। হয়তো স্বামী মরলে স্ত্রীকে ধরেবেঁধে এখন আর চিতার আগুনে পোড়ানো হয় না, তবে পোড়ানো হয় কিন্তু অন্য আগুনে।

শুধু সহমরণই বা বলি কেন? এখন হচ্ছে একক মরণের কাল। আর এই মরণটি একা নারীর মরণ। নারীকে জন্মের পরই মরতে হয়, হয় তাকে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলে, আর যদি বা বেঁচেই থাকে, মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে করতে বাঁচতে হয়। বিবাহ হচ্ছে নারীর জীবনে সবচেয়ে যন্ত্রণাময় মৃত্যু। বিবাহিত জীবন এবং নরক জীবন অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রে প্রায় একই। নরকে সাপ-বিচ্ছু নাকি নিরন্তর কামড়ায়, সংসারে স্বামী এবং স্বামীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা নারীকে সাপ-বিচ্ছুর চেয়ে কিছু কম কামড়ায় না। সাপ-বিচ্ছুর কামড় তবু দাঁতে দাঁত চেপে সওয়া যায়, কিন্তু মানুষের কামড় সওয়া যায় না, আর তারা তো শুধু দাঁতে কামড়ায় না, তাদের আছে বিচিত্র রকম নখর। তারা কিছু ‘নিয়মনীতি’ তৈরি করেছে মেয়েদের কামড় দেবার জন্য, সেই ‘নিয়মনীতি’র কামড়ে মেয়েরা বিবাহপূর্ব, বিবাহিত এবং বিবাহোত্তর, সব জীবনেই আক্রান্ত হয়।

রামমোহন রায় চিতার আগুনে বিধবা পোড়ানো বন্ধ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ ঘটিয়ে আরও এক পুণ্যের কাজ করেছিলেন বটে। ব্যভিচার ও ভ্রূণহত্যার ভয় দেখিয়ে তিনি বিধবাদের ‘গতি’ করেছিলেন। আপাতত চিতার আগুন এবং বৈধব্যের নির্যাতন থেকে নারী বাঁচল বটে— কিন্তু সত্যিকার বাঁচল কি? সংসার সমাজে নারীকে পোড়াবার আগুন কিছু কি কম লেলিহান?

এই আগুন কি নারীকে চিতার আগুনের চেয়ে কিছু কম দগ্ধ করছে? হয়তো শরীরের মৃত্যু ঘটছে না, কিন্তু মৃত্যু ঘটছে মানবতার, স্বাধীনতার। মৃত্যু ঘটছে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার ন্যূনতম অধিকারের।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন