তসলিমা নাসরিন
১
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পাশ দিয়ে আমি যখনই যাই, উদ্যানের দিকে আমার তাকাতে হয়, তাকাতে হয় মানে কিন্তু এই নয় যে, কেউ আমার ঘাড় জোর করে ফিরিয়ে দেয় ওদিকে, আমাকে তাকাতে হয় কারণ বোধের ভেতর অদ্ভুত এক শক্তি আমাকে কখনও স্থির হতে দেয় না, চোখ চলে যায় খুঁজতে কুতুব মিনারের মতো বিশাল কোনও স্মৃতিস্তম্ভ। না, নেই, কোনও স্মৃতিস্তম্ভ ওখানে দর্পভরে দাঁড়িয়ে নেই, ছোট একটি ইটের গাঁথুনি কেবল আছে, একা, দরিদ্র, গাছগাছালির আড়ালে ঢাকা, ওটিকে রীতিমতো বাতি জ্বেলে খুঁজতে হয়।
একজন সেদিন বললেন, ‘একাত্তরে দেশ স্বাধীন হবার পর সাতই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণের জায়গায় একটি-একটি করে ইট ফেললেও তো এতদিনের কুতুব মিনার ছাড়িয়ে যেত।’ হ্যাঁ, তা যেত। আমার প্রশ্ন, ইট কেন ফেলেনি কেউ সেখানে? কেন ঐতিহাসিক সেই স্থানটিকে খুঁজে বের করতে সময় খরচ হয়? চোখে পড়ে ‘তিন নেতার মাজার’, ‘জিয়ার মাজার’—চোখে কেন পড়ে না পবিত্র সাতই মার্চ? চোখে কেন পড়ে না ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির মিনার’? এই জাতি নিয়ে আমরা গর্ব করি, এই জাতি নিয়ে কি লজ্জা কম হয়? কেন এই দেশের শহরে, নগরে, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অজস্র স্মৃতি নেই?
পাঠক বিশ্বাস করুন, সেদিন এক বাড়িতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘ এক আড্ডা হচ্ছিল, ওখানে কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারি বাড়ির ভদ্রলোকটি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমি যখন এই সুসংবাদ শুনে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী আমার আনন্দধ্বনি শুনে বিস্মিত হলেন এবং আমাকে নিবৃত্ত করলেন এই বলে যে, এ-কথা যেন কেউ না জানে। মুহূর্তে চুপসে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? এ তো জানাবার কথা সবাইকে। এ তো খুব গৌরবের কাজ।
ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনই অত্যন্ত লজ্জিত হলেন যেন। যেন এ বড় লজ্জার কথা যে, তিনি যুদ্ধ করেছেন। তাই লুকোতে চাইছেন, যেন বড় অন্যায় একটি কাজ তিনি করে ফেলেছেন। আমি যতই যুদ্ধকালীন ঘটনাগুলো জানতে চাই, ততই তিনি নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখেন। এর নাম বিনয় নয়, এর নাম অপরাধ লুকোনোর প্রবণতা।
আমি নিশ্চিত, ভদ্রলোক তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে ভুল বলে ভাবছেন। একাত্তরের মার্চে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই আজ বিশ্বাস করেন। একাত্তরের খুনি রাজাকারদের চেয়ে বিভ্রান্ত এঁরা, আমার তাই মনে হয়। এই দুর্ভাগা জাতির জন্য দুঃখ করা ছাড়া আমার আর করবার কিছু নেই।
২
বাহাত্তর, তিয়াত্তর, চুয়াত্তর, পঁচাত্তর পর্যন্ত আমরা যে গান শুনেছি, সেই গানগুলো কি শেষ পর্যন্ত আমরা বিস্মৃত হব? রক্তে জেগে ওঠা সেই ক্রোধ, সেই ক্ষোভ, সেই আনন্দ এখন কোথায়? কেন সেই গানের অধিকার নেই আমাদের আন্দোলিত করবার?
অনেকে ভাবেন গানগুলো আওয়ামি লিগের নিজস্ব গান। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’, ‘চাষাদের মুটেদের মজুরের’, ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা”, “বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’–এ-রকম আরও অসংখ্য গান। আমি এই গানগুলো গ্রীষ্মের, শরতের, ফাগুনের তপ্ত দুপুরে খুব জোরে যখন ‘ক্যাসেট-রেকর্ডারে বাজাই, পড়শিরা বলেন, ‘করছেন কী ভাই?’
বলি, ‘গান শুনছি।’
পড়শিরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব নিচুস্বরে বলেন, ‘একটু আস্তে বাজানো যায় না এই সব গান? বোঝেনই তো, যে দিনকাল! ‘
তা হলে এই বুঝতে হবে যে, এখন যে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো এখন শোনা আমাদের নিষেধ! যেমন এ-সব নিষিদ্ধ ছিল একাত্তরে দেশজুড়ে পাকিস্তানি বর্বরদের নৃশংস ধ্বংসলীলার সময়। তবে কি তেমনি কোনও বর্বরের তাণ্ডব চলছে এখনও? তাই কান পেতে গোপনে শুনতে হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় প্রিয় গান। গোপনে শুনতে হয় যেন কেউ টের না পায়, পড়শি যেন না শোনে, পথচারী যেন না বোঝে এমন গোপনে।
আমরা জোরে বাজাব ‘এক-দো-তিন’… ‘দেখা হ্যায় পহেলি বার, সাজন কি আঁখো মে পেয়ার…’, ‘বহত পেয়ার করতে হ্যায়’—তা হলেই তো জাতে ওঠা যাবে। এ-দেশের জাত আবার অন্য রকম। এখানে জাতে উঠতে গেলে কিছুটা বিজাতীয় হতে হয়, কিছুটা রাজাকার হতে হয়, কিছুটা অসৎ হতে হয়, আবার কিছুটা হতে হয় স্মৃতিভ্রষ্ট।
আমাদের ‘জাতে ওঠা’ নাগরিকেরা সুখেই আছেন। আর আমরা যারা বিবেকের তোয়াক্কা বেশি করি, তাদেরই সমাজ-সংসারে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। দুর্ভাগ্য তাদেরই তাড়ায় বেশি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন