তসলিমা নাসরিন
মেয়েরা হাঁটতে গেলে, দৌড়োতে গেলে, বসতে গেলে, শুতে গেলে, হাসতে গেলে সর্বত্র এক ধরনের বাধা অনুভব করেন। তাঁকে কতটুকু হাঁটা মানায়, কতটুকু দৌড়, কতটুকু বসা, শোওয়া, হাসা—সবকিছুর একটি হিসেব আছে। যদি জিজ্ঞেস করা হয়—এই হিসেব কারা তৈরি করল, এর একটিই উত্তর—কেন! আল্লাহ্তায়ালা!
আসলে আল্লাহ্তায়ালার ওপর আর কোনও কথা চলে না। আল্লাহ্তায়ালা আল্লাহ্তায়ালাই। আল্লাহ্তায়ালা, তাঁর প্রেরিত পুরুষ এবং সেই প্রেরিত পুরুষের শিষ্যরা অর্থাৎ ‘সাহাবা’রা মেয়েদের চলাচল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মেয়েরা কতদূর যেতে পারবে, কার সঙ্গে শুতে পারবে, কত জোরে হাসতে পারবে, তার চুলচেরা হিসেব অহরহই প্রচার করছেন আমাদের ইসলামি চিন্তাবিদগণ, প্রচার করা হচ্ছে গ্রামে-শহরে ইসলামি জলসা বসিয়ে। প্রচার হচ্ছে রাজনীতির লোক দ্বারা (ইসলাম যাদের লোক ঠকানোর হাতিয়ার), সমাজের ভদ্রলোক দ্বারা। নারী ঘরের বার হবে, পড়ালেখা করবে, কাজকর্ম করবে, উপার্জন করবে, স্বনির্ভর হবে—এ-কথা ইসলাম কখনও মানেনি। কোরানে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করো এবং পূর্বের জাহেলি যুগের মতো সেজেগুজে রূপ-সৌন্দর্য প্রকাশ করে বেড়াবে না।’ (সুরা আহজাব ৩৩)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আল্লামা আবু বকর জাসসাস লিখেছেন, ‘নারীকে তার গৃহের মধ্যে অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।’ (আহাকামুল কোরান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৩)
নারীর প্রকৃত কর্মক্ষেত্র গৃহ। ইসলাম জামায়াতবদ্ধভাবে নামাজ পড়াকে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু কেবল পুরুষের বেলায়, নারীর বেলায় নয়। পুরুষের জন্য জামায়াতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা ফরজ কিন্তু নারীর জন্য নামাজ ফরজ হলেও জামায়াতের সঙ্গে আদায় করা জরুরি নয়।
হজরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘গৃহের নিভৃত প্রকোষ্ঠ হল নারীর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট মসজিদ।’ (মসনাদে আহামদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৭ ও মুসতাদরিকে হাকেম ১৪ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৯)
একবার নবির এক সাহাবা আবু হুমায়েদ সায়েদির স্ত্রী নবির খেদমত করতে গিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রসুল, আমি আপনার সঙ্গে মসজিদে নামাজ পড়তে চাই। এতে আপনার কী মত?’ নবি বললেন—‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সত্যিই তুমি তা চাও। কিন্তু জেনে রেখো, তোমার বাড়ির কোনও ছোট কামরায় নামাজ পড়া তোমার জন্য প্রশস্ত কামরায় নামাজ পড়বার চেয়ে উত্তম, কামরার মধ্যে পড়া বাড়ির মধ্যে পড়া থেকে উত্তম এবং মহল্লার মসজিদে পড়া নামাজের চেয়ে বাড়ির মধ্যে অবস্থান করে পড়া উত্তম।’ আবু হুমায়েদ সায়েদির স্ত্রী অতঃপর ঘরের নিভৃত অংশে সারা জীবন নামাজ পড়েছেন। (মুসনাদে আহমদ ৬ষ্ঠ, পৃষ্ঠা ৩৭১, আল-ইসতিয়ার, ইবনু আবদিলবার, তাজকিয়ায় উম্মে হুমায়েদ আল মায়িরাহ)
বলা হয়ে থাকে ক্রীতদাস, নারী, শিশু ও রোগী ছাড়া প্রত্যেক মুসলমানের উপর জুমআর নামাজ ফরজ। শুধু জমায়েত থেকে নয়, জানাজা থেকে নারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা নবির সঙ্গে একটি জানাজা নিয়ে যাচ্ছিলাম। এ-সময় তিনি কোনও কোনও স্ত্রীলোককে পেছনে পেছনে অনুগামী হতে দেখে রাগতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এটি বহন করছ? তারা বলল, না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তার দাফনের কাজে কি তোমরা অংশগ্রহণ করবে? তারা বলল, না। এবার নবি (সাঃ) বললেন, তোমাদের যখন এখানে কোনও কাজ নেই তখন সঙ্গে আসার কী প্রয়োজন আছে? এজন্য কোনও পুরস্কার বা সওয়াব তোমরা পাবে না। মাথা ও চুলের সৌন্দর্য নিয়ে ফিরে যাও।’ (ফাতহুল বারি, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)
হজরত আয়শা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন ‘নবি (সাঃ) বলেছেন, তোমরা গৃহকর্মে লেগে থেকো। এটা তোমাদের জিহাদ।’ (মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮)
একবার এক মহিলা সাহাবা নবি (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা পুরুষের উপর জিহাদ ফরজ করেছেন। তারা বিজয়ী হলে গণীমাত লাভ করে এবং শহিদ হলে নিজের রবের কাছে জীবিত অবস্থায় রিজক প্রাপ্ত হয়। আমাদের কোন কাজটি এ-কাজের সমকক্ষ হবে? নবি (সাঃ) বললেন—স্বামী-আনুগত্য ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, ৩য় খণ্ড, ৩৩৬ পৃষ্ঠা।) অবশ্য কোনও মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নারীকে যদি ঘরের বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে অথবা দলবদ্ধভাবে ইবাদত করবার ব্যবস্থাকে তার জন্য উপকারী ও প্রয়োজনীয় মনে করা হয়ে থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে এমন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে যা প্রতি মুহূর্তে তার এ অনুভূতিকে জাগ্রত করে যে, যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছে, সেটিই তার প্রকৃত ক্ষেত্র। ঘর থেকে বের হওয়ার অর্থ এ নয় যে, সে নারীত্বের সীমারেখাও অতিক্রম করেছে। নারীদের মসজিদে গিয়ে জামায়েত নামাজ পড়বার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই শর্তে দেওয়া হয়েছে যে, তারা পুরুষের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করবে না এবং ‘পুরুষপনা’ জাহির করবে না। বরং তাদের কাতার হবে পুরুষদের কাতার থেকে ভিন্ন। এই দূরত্ব যত বেশি হবে, শরিয়তের দৃষ্টিতে তা তত বেশি প্রিয় এবং প্রীতিকর। হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘নবি (সাঃ) বলেছেন, পুরুষদের সর্বোত্তম কাতার হচ্ছে প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্টতম কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মেয়েদের সর্বোত্তম কাতার হচ্ছে সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্টতম কাতার হল প্রথম কাতার।’ (মুসলিম, কিতাবুস সালাত ও আসহাবুস সুনানিল আরবায়া)। পুরুষের প্রথম কাতার ও নারীর শেষ কাতারের প্রশংসা করা হয়েছে কারণ এতে নারী-পুরুষের দূরত্ব বজায় থাকে এবং পুরুষ যে সামনে এবং নারী যে পেছনে, তারও একটি মীমাংসা হয়। মসজিদে নামাজ পড়বার বিপক্ষেই হজরত মুহম্মদ (সাঃ) রায় দিয়েছেন কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেন, তাও শর্তসাপেক্ষ—পেছনে দাঁড়াতে হবে, পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা চলবে না ইত্যাদি। ঘর থেকে নারীর বার হওয়াই কারও কাম্য নয়। ঘরের কাজ করা এবং স্বামীর আনুগত্য প্রকাশকেই নারীর জন্য জিহাদের সমতুল্য কাজ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
নারীর প্রতিভাকে নিবৃত্ত করবার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, নারীকে অন্তর্মুখী করবার জন্য, ঠিক অন্তর্মুখী নয়, স্বামী এবং সংসারমুখী করবার জন্য এবং নারীর আর সব প্রতিভাকে ধামাচাপা দেবার জন্য ইসলাম পালন করছে মহান ভূমিকা। মুসলমান মেয়েরা কেউ এই ধামার মধ্যে চাপা পড়ছে, কেউ পড়ছে না। নানা ছুতোয় ঘরের বার হচ্ছে। হবেই বা না কেন? কারণ তারা জেনে গেছে, গৃহ এখন মেয়েদের একমাত্র কর্মক্ষেত্র নয়। গৃহ গৃহই। কর্মক্ষেত্র গৃহের বাইরে। তারা এখন গৃহের বাইরে কর্মক্ষেত্রে যাবার প্রয়োজন অনুভব করছে। এই প্রয়োজন অর্থনৈতিক। মানুষ সভ্য হলে অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়। মানুষ সভ্য হলে মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জরুরি হয়। ধর্মবাদী মানুষেরা যতই সমাজকে ঐশী রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে চাক, রশি ছিঁড়ে সভ্যতা এগোবেই। মেয়েরা ঘরের বার হচ্ছে। লেখাপড়া শিখছে, কাজ করতে যাচ্ছে। এতে সেই পুরনো মূল্যবোধ ধসে যাচ্ছে। গ্রামের গরিব মেয়েরা যাদের কাছে ধর্মই একমাত্র নীতিনির্ধারক—তারা শ্রমিকের কাজ করতে ঘরের বার হচ্ছে। অথচ ঘরে বসে স্বামীর সেবা ও আনুগত্য প্রকাশকেই মেয়েদের একমাত্র কাজ বলে ধর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেয়েরা প্রয়োজনে ধর্মের এই নির্দেশ ভাঙছে— জীবনের প্রয়োজন, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার প্রয়োজন। মেয়েদের এই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত দেখে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, ধর্মের চেয়ে জীবন অনেক বড়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন