তসলিমা নাসরিন
আমি এ-জীবনে দুর্যোগ কিছু কম দেখিনি। আমার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছে মৌলবাদীরা, আমি সেই মিছিল ডিঙিয়ে বাড়ি ফিরেছি। আমি এ-জীবনে দুর্ভোগ কিছু কম পোহাইনি। বিরুদ্ধ একটি সমাজের ভদ্রলোকেরা আমাকে নিরন্তর চাবকাচ্ছে। আমি অনেক দিন দুঃখ করতে ভুলে গেছি। আমি বিস্মিত হতে হতে এখন স্থবির পড়ে আছি, কোনও বেদনা বা বিস্ময়ের বোধ আমাকে আর গ্রাস করে না। তবু সেদিন হঠাৎ একেবারে হঠাৎই নানা দুর্ভোগ পোহানো মানুষ আমি বিস্ময়ে বাদ্ধ হলাম। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির সতেরো তারিখ। বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলায় সাত-আটজন অথবা দশ-বারোজন ছেলে একটি ব্যানার নিয়ে ঘুরছে, ব্যানারে অশ্লীল কিছু বাক্য, বাক্যের নীচে লেখা—তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি’—এই দৃশ্য আমি দেখিনি, এই দৃশ্যের কথা আমাকে কেউ-কেউ জানিয়ে যায়। আমার উদবিগ্ন শুভাকাঙ্ক্ষীরা ‘মেলা পরিচালন কমিটি’কে দৃশ্যটির কথা জানান। তাঁরা আমাকে অ্যাকাডেমির মহাপরিচালকের রুমে এনে আপাত একটি নিরাপত্তা দেন।
খবর পাই, ব্যানারটি কেড়ে নিয়ে গেছে কয়েকজন যুবক। মহাপরিচালকও মঞ্চের মাইকে ব্যানারবাহকদের উদ্দেশ্যে কড়া বক্তব্য রেখে ফিরে আসেন; এসেই আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনাকে নিয়ে কেন এই মিছিল হচ্ছে? প্রশ্নটি আমাকে নিরুত্তর করে রাখে। কেন এই মিছিল, কী এদের উদ্দেশ্য আমি জানি না। মহাপরিচালক আমার উত্তরের জন্য ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলেন, যেন এই জটিল উত্তরটি তাঁকে জানাতেই হবে, যেটি কেবল আমিই জানি বলে তিনি ধারণা করছেন। নিরুত্তর সময়গুলো তাঁকে কিছু সন্দিগ্ধ করছে মনে করে আমি বললাম, ‘সম্ভবত লেখালেখির কারণেই এই সব।’
আমার সরল উত্তরে তাঁর ভ্রূ কুঞ্চিত হল, তাঁর চোখের তারায় অবিশ্বাস নাচল, তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হল অদ্ভুত একটি বাক্য—‘লেখালেখি তো আরও অনেকেই করে, কই তাদের বিরুদ্ধে তো মিছিল বেরোয় না?’
এই প্রশ্ন আমাকে আবারও স্তব্ধ করে। উপস্থিত চার-পাঁচজন লেখক মহাপরিচালকের প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন, কেউ নিচু কণ্ঠে, কেউ উঁচু কণ্ঠে। কেন আমার বিরুদ্ধে এই মিছিল, লেখক তো এ-দেশে অনেকেই আছেন, সকলকে বাদ দিয়ে কেন ‘পেষণ’-এর জন্য ওরা, এ-দেশের সুযোগ্য সন্তানেরা, আমাকেই নির্বাচন করল— মহাপরিচালকের প্রশ্নের পেছনে ধ্বনিত হয় একটি সূক্ষ্ম বিদ্রূপ। আমার বিশ্বাস হয় না আমি উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, কথা বলছি বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে। আমার বিশ্বাস হয় না, যে মানুষটির সঙ্গে আমি কথা বলছি, তিনি সত্যের বিরুদ্ধে খেপে ওঠা উন্মত্ত অসত্যের ঢল সম্পর্কে কিছুই জানেন না। প্রচলিত সমাজের বিপক্ষে কথা বলতে গেলে কম নির্যাতন, নিপীড়ন বা পেষণের শিকার হতে হয়? আর যদি কণ্ঠস্বরটি খুব আপসহীন;এবং বলিষ্ঠ হয়—তবে কার না শখ হয় কণ্ঠরোধ করতে, কার হাত এবং হাতের আঙুলে ইচ্ছে জাগে না তাকে পেষণ করবার? অর্ধশত বছর অতিক্রম করেও মহাপরিচালক ইতিহাস বিস্মৃত হন; তিনি গ্যালিলিও গ্যালিলি, জিয়োর্দানো ব্রুনো, সক্রেটিস, জোন অব আর্ক, মেরি ওলস্টোনক্রাফট, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সালমান রুশদির কথা ভুলে যান।
আর যদি কণ্ঠস্বরটি কোনও নারীর হয়? নারীকে এই সমাজে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় ক’জন? নারীই জানে নারীকে কত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছোতে হয়। নারীই জানে তার অমসৃণ পথ ও পথের প্রতিকূলতা। সম্ভবত মহাপরিচালক হারুন-অর- রশিদ একজন নারীর ওপরে ঘরে-বাইরের দুর্বৃত্ত পুরুষের অত্যাচার সম্পর্কে জ্ঞাত নন। মহাপরিচালক লোকটি হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক একটি কথা বলেন। বলেন—আমি অবশ্য আপনার কোনও লেখা পড়িনি। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ তো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন আপনি নাকি এখনও লিখতেই শেখেননি।’ আমি অবাক হয়ে এবার তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। লিখতে গেলে হুমায়ুন আজাদের সার্টিফিকেটের দরকার হয়, এ আমি কখনও ভাবিনি। হুমায়ুন আজাদ নানা রকম সাক্ষাৎকারে বলে বেড়াচ্ছেন প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে তাঁর মতো মননশীল আর কেউ নেই। তিনিই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ, কবি নির্মলেন্দু ‘বড়-অকবি’, হুমায়ুন আহমেদ ‘অপন্যাস’ লেখেন, সৈয়দ শামসুল হক ‘কপট কবি’, তসলিমা নাসরিন ‘এখনও কবি হয়ে ওঠেনি’। হুমায়ুন আজাদ নিজের প্রশংসা করতে গিয়ে সকল লেখক সম্পর্কে উদ্ভট সব মন্তব্য করেন। এইসব মন্তব্য, নিজের সম্পর্কে এইসব অশোভন উন্নাসিকতা, নিজে ছাড়া বাকি সবাইকে গাধা ও গোরু, বাকি সবাইকে তুচ্ছ ভাবা সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ নয়। এই আচরণ যে নেহাতই দৃষ্টি আকর্ষণের হীন উদ্দেশ্য তা অনেকের কাছে স্পষ্ট। লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ আমাকে সার্টিফিকেট দেননি বলে মহাপরিচালকও আমার ওপর তুষ্ট নন। আমি জানি না মহাপরিচালককে মানুষ হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যদি স্বীকৃতি না দেন, তবে নিজেকে তিনি অমানুষ ভাববেন কি না।
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না, আমাকে হতবাক করে মহাপরিচালক বলেন— ‘এমন লেখা লিখবেন যেন এইসব ‘গণ্ডগোল’ না হয়, মেয়ে হয়ে ‘পুরুষালি’ লেখা লেখবার দরকার কী, কেন ধর্মকে আক্রমণ করে লেখেন, মেলায় গণ্ডগোল হলে আমরা মেলা থেকে বই উইথড্র করতে বাধ্য হব।’
মহাপরিচালক আমাকে শেখাতে চান কী করে লিখতে হয়, কী করে লিখলে কোনও গণ্ডগোল হয় না। কী করে লিখলে হুমায়ুন আজাদ লেখক বলে স্বীকার করেন। আমার সৌভাগ্য এই, আমি এইসব বর্বর শিক্ষিত দ্বারা সংক্রামিত হই না। ওই ব্যানারবাহক দুর্বৃত্তদের চেয়েও এইসব প্রগতিশীল মূর্খ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন