তসলিমা নাসরিন
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলটির এখন সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব, সেই দলটির নাম ‘জামায়াতে ইসলামি’। জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি ধর্মভিত্তিক। তাদের চিন্তা-চেতনা, সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র সবকিছুই ধর্মের ছত্রচ্ছায়ায় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন, দু’দলের বন্ধুত্ব কী করে জমছে? এ যে একেবারেই সাপে-নেউলে আদর্শ। যে ধর্ম দ্বারা জামায়াতে ইসলামি লালিত, সেই ধর্ম বলে ‘পুরুষেরা যখনই নারীর আনুগত্য করেছে তখনই ধ্বংস হয়েছে।’ (বুখারি)
‘যে জাতি নারীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, সে জাতি কখনও সফলকাম হতে পারে না।’ (বুখারি)
‘কোনও জাতির জন্য নারীকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করাও জায়েজ নয়। কারণ অসাফল্য ও ক্ষতি নিশ্চিত করে এমন কাজ বর্জন করা আবশ্যক।’ (নায়ালুল আওতার
‘কিবলার অনুসারীদের ছোট ছোট দল-উপদল আছে তার কোনওটিই নারীর নেতৃত্বকে বৈধ মনে করে না।’ (আল ফাসল্ ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ৪র্থ খণ্ড)
কারণ নারীদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা ও দীন (দৈহিক শক্তি) অসম্পূর্ণ। আর তাদের ফয়সালার স্থানসমূহে (বিচারালয়ে) এবং যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার অনুমতি নেই।’ (শারহু মাকাসিদ )
আর যখন তোমাদের দুষ্টু লোকেরা আমির শাসক আর মালদার ব্যক্তিরা কৃপণ হবে এবং তোমাদের যাবতীয় কার্যাবলি নারীদের হাতে সোপর্দ হবে, তখন এ পৃথিবীর পেট তার পিঠের তুলনায় (অর্থাৎ দুনিয়াতে না থাকাই) তোমাদের জন্য উত্তম হবে।’ (তিরমিজি শরিফ)
ইসলামের এই মৌলিক বিধানগুলোর আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান ও নামাজের ইমাম হওয়া নারীর জন্য হারাম। শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ পরিচালনা ও দেশ পরিচালনা, উভয়কেই ইমামতি বলা হয়। এই ইমামতি কোনও নারীর জন্য বৈধ নয়। নামাজের ইমামতিতে যেমন কোনও নারী দাঁড়িয়ে গেলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া মুসলমানের জন্য ফরজ, ঠিক তেমনি রাষ্ট্র নামক বড় মসজিদের পেশ মশল্লায় কোনও নারী অধিষ্ঠিতা হয়ে গেলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া মুসলমানদের জন্য ফরজ। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অবৈধ বা নাজায়েজ ঘোষণা করা তাই জামায়াতে ইসলামির জন্য ফরজ একটি কাজ। যেহেতু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন নারী এবং সেই নারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাই যুক্তিমতে বি এন পি-ই জামায়াতে ইসলামির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবার কথা। এ-ক্ষেত্রে দু’দলে কোনওরকম সখ্যের প্রশ্ন উঠে না।
সুরা নিসায় (আয়াত ৩০) লেখা আছে, ‘পুরুষই নারীর তত্ত্বাবধায়ক শাসক, কারণ আল্লাহ্ তাদের এককে অপরের ওপর প্রাধান্য দান করেছেন।’
যেহেতু ধর্ম বলে—‘নারীর কোনও ক্ষমতা নেই পুরুষের ওপর কর্তৃত্ব করবার, প্রাধান্য বিস্তার করবার’, যেহেতু ধর্ম বলে ‘নারী-নেতৃত্ব বৈধ নয়, জায়েজ নয়।’ তাই ধর্ম যাদের একমাত্র হাতিয়ার; তারা যে-কোনও নারীপ্রধান দলের বিরুদ্ধে জেহাদে নামবে— এই তো ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটল উলটো ঘটনা। জামায়াতে ইসলামি গোপনে হাত রেখেছে বি এন পি-র নারী-নেত্রীর হাতে। এ কি স্ববিরোধিতা নয়? শুধু স্ববিরোধিতাই বা বলি কেন—এ হচ্ছে ধর্মবিরোধিতা। ধর্ম যাদের প্রধান অস্ত্র, তারাই যদি হয় ধর্মবিরোধী, তবে দেশের নিরীহ জনগণ যাবে কোথায়? নাকি নাকের সামনে বেহেশতের মুলো ধরে নাচলেই মূর্খ জনগণের জিভে জল আসবে? আর তাই চাচ্ছে একাত্তরের পর গর্তের ভেতর ঢুকে যাওয়া বিষাক্ত সাপেরা, যারা আজ গর্ত থেকে মাথা তুলেছে, বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে! যারা আজ জাতির শেকড়ে, জাতির রক্তমাংস-মজ্জায় দিচ্ছে ভয়ংকর ছোবল।
জামায়াতকে দুধকলা খাইয়ে মানুষ করছে দেশের ক্ষমতাসীন দল বি এন পি। আর জামায়াতও শরিয়তবিরোধী নারী-নেতৃত্বের দুধকলা বেশ আয়েশ করে পান করছে। আর বলিহারি বি এন পি! যে দলের নেত্রী তাঁর বক্তৃতায় আমি খালেদা, খালেদা, খালেদা’ বলে জনগণকে জানান দিচ্ছেন যে, তিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, তিনি নারী এবং তিনি নেত্রী তবে তিনিই বা কেন মেনে নিচ্ছেন নারী-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে হাদিস-ফতোয়াধারণকারী দল জামায়াতের রাজনীতি? জামায়াত, ফ্রিডম, যুবকমাণ্ডের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার জন্য মানুষ আজ পথে নেমেছে, এই নিয়ে গণসমাবেশ হয়ে গেল মাত্র সেদিন। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই নারী-নেত্রীর, প্রধানমন্ত্রীর।
সন্দেহ নেই যে, জামায়াত তার স্বার্থসিদ্ধির পর নারী-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে খেপে উঠবে বুনো ষাঁড়ের মতো। তখন খালেদা জিয়া মাথার ঘোমটা আরও লম্বা করলেও তাকে শিঙের গুঁতো খেতেই হবে, কারণ তারা ফাঁক পেলেই বলবে, “নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য ঘরের মধ্যেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন নবি করিম (সাঃ)।’ (ফাতহুল বারি
নারীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল ঘরবাড়ির তত্ত্বাবধান এবং স্বামী ও সন্তানের দেখাশোনা করা।’ (বুখারি)
নারীকে ঘরবাড়ির বাইরে জাতির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিতে সকলের আগে যে দলটি নারাজ হয়—সে জামায়াতে ইসলামি। তারা পরদাপ্রথার দোহাই দিয়ে একদিন বলবেই, পরপুরুষের সামনে আসা নারীর জন্য গুনাহের কাজ। তখন গুনাহগার প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো ইসলামি আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
ধর্মের নামে এমন জগাখিচুড়ি বাজনীতিতে এখন আক্রান্ত দেশের সরল-সোজা মানুষ। এই সময়ে অসুস্থ ও অনগ্রসর রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করা জরুরি। খালেদা জিয়া এ-দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে আমি সকল নারীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা-সম্ভাষণ জানাচ্ছি এবং তাঁর এবং সকল নারীর মঙ্গলের জন্য জামায়াতে ইসলামি নামের দলটিকে নিষিদ্ধ করবার অনুরোধ করছি- এতে দেশ বাঁচবে, অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বাঁচবে দেশের বারো কোটি মানুষ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন