গিনিপিগ

তসলিমা নাসরিন

পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে আমি তিন বছর চাকরি করেছি। আমাকে প্রায়ই গ্রামে যেতে হত ‘স্টেরিলাইজেশন ক্যাম্প’ উপলক্ষে। গ্রামের ‘পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে’ ক্লায়েন্ট আনা হত। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওদের বন্ধ্যাকরণ ঘটিয়ে তবেই আমার ছুটি মিলত। আমার সঙ্গে যেত দু’জন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর ও একজন আয়া। ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসিস্ট্যান্টরা ক্লায়েন্ট জোগাড় করেন, অপারেশনের যন্ত্রপাতি এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে আমরা কেন্দ্রে গিয়ে সেই ক্লায়েন্টদের ওপর চড়াও’ হই। আমি ভেবে অবাক হই, এই সব ক্যাম্পে পারতপক্ষে কোনও পুরুষ ক্লায়েন্ট আসে না, সবই ষোলো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের মহিলা। তিন বছরে আমি যদি এক হাজার টিউবেকটমি করে থাকি, ভ্যাসেকটমি করতে আসা পুরুষদের ‘ঘাটের মড়া’ বললেই ভাল মানায়। টাকা ও লুঙ্গির লোভ দেখিয়ে কেউ হয়তো কোনও চলনশক্তিহীনকে ফেলে রেখে যায় ক্যাম্পে। এ ছাড়া নিত্যদিনের একটি দৃশ্য আছে—এক ঝাঁক দরিদ্র নারী গায়ে লাল শাড়ি জড়িয়ে ভীত এবং বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে। এদের কারও স্বামী নেই, কারও আছে, কারও ছেলে-মেয়ে পাঁচজন-তিনজন-দু’জন-একজন, কারও হয়তো সন্তান ছিল—মরে গেছে, স্বামী তালাক দিয়েছে, তবু এসেছে, সরকারি শাড়ি পরে সামান্য একশো পঁচাত্তর টাকা পাবার আশায় বসে থাকে না-খাওয়া শরীর নিয়ে (অপারেশনের আগে কিছু সময় না খেয়ে থাকতে হয়)। আমি প্রায়ই আমার সহকারীদের জিজ্ঞেস করতাম—ভ্যাসেকটমির কেস নেই কেন?

ওরা বলত—পুরুষলোক আসে না।

কেন আসে না?

আসে না। পথের ভিখিরিও আসে না। একেবারে অথর্ব বুড়ো হলে দু’একটাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনা যায়। তা ছাড়া সকলে নাক সিটকায়। ভাবে, এ বুঝি মেয়েদের কাজ। ভ্যাসেকটমি করতে কেন পুরুষের আগ্রহ কম—এ প্রশ্ন আমার অনেক দিনের। নারীর স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতির নাম টিউবেকটমি। টিউবেকটমির চেয়ে ভ্যাসেকটমি অনেক সহজ ও নিরাপদ অপারেশন। তবু এই অপারেশনে রাজি নয় আমাদের অগ্রসর পুরুষেরা। সম্ভবত পুরুষদের আকাঙ্ক্ষা থাকে আবার বিবাহের, তখন যদি বীর্যের প্রয়োজন হয় নতুন জরায়ুতে! নয়তো কী? দুটো-তিনটে এমনকী চার-পাঁচটি সন্তানও যদি বড় হতে হতে পিতা-মাতার উচ্চতা ছাড়িয়ে যায় তবু ভ্যাসেকটমি নৈব নৈব চ। স্ত্রী যা খুশি তা-ই ব্যবহার করুক। পিল, ফোম ট্যাবলেট, নরপ্লান্ট, ইঞ্জেকশন, টিউবেকটমি (লাইগেশন) – যা খুশি।

স্ত্রীরাই ব্যবহার করছে জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় স্থায়ী ও অস্থায়ী পদ্ধতি।

কন্ট্রাসেপটিভ পিল এসট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন নামক দুটো হরমোন দ্বারা তৈরি। এই পিলের সুবিধে তো কিছু আছেই, অসুবিধেও কিন্তু কম নয়।

অসুবিধেগুলো হচ্ছে—

১. বমি-বমি ভাব

২. বমি

৩. মাথাব্যথা, মাথাঘোরা

৪. স্তনে ব্যথা

৫. বিষণ্ণতা

৬. চুল পড়ে যাওয়া

৭. কামশক্তি কমে যাওয়া

৮. পেট কামড়ানো এবং রজঃস্রাবের সময় পেটব্যথা হওয়া

৯. পায়ের মাংসপেশিতে যন্ত্রণাদায়ক খিল

১০. অনিয়ন্ত্রিত রজঃস্রাব

১১. সাদা স্রাব

১২. যোনি ও যোনিমুখে ক্যানডিডার আক্রমণ

১৩. ওজন বেড়ে যাওয়া

১৪. চর্বি বেড়ে যাওয়া

১৫. প্যানক্রিয়াটাইটিস

১৬. গলব্লাডার স্টোন

১৭. গ্লাইকোসুরিয়া

১৮. রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া

১৯. রক্তনালিতে রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়া

২০. জরায়ুতে ফাইব্রয়েড নামক টিউমার হওয়া

২১. স্তনের ক্যানসার

কপারটি অথবা IUCD (ইন্ট্রাইউটেরাইন কন্ট্রাসেপটিভ ডিভাইস) ব্যবহারও বেশ চলছে। অথচ এটি ব্যবহারে যা-যা ঘটতে পারে তা হল—

১. IUCD ব্যবহারের সময় রোগী হঠাৎ মূর্ছা যেতে পারে

২. রজঃস্রাব অনিয়মিত হওয়া, রজঃস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া

৩. রজঃস্রাবের সময় তলপেটে ব্যথা

৪. সালফিংগো অফোরাইটিস (জরায়ুর নালি ও ডিম্বথলিতে ইনফেকশন)

৫. এন্ডোমেট্রাইটস

৬. জরায়ুর ক্যানসার

৭. জরায়ু ফুটো হয়ে যাওয়া

৮. জরায়ুর মুখে আঘাত লাগা

৯. ডিভাইস ভেঙে যাওয়া

১০. আপনা-আপনি জরায়ু থেকে ডিভাইস বেরিয়ে আসা

১১. টিউবাল প্রেগনেন্সি (জরায়ুতে নয়, ফেলোপিয়ান টিউব বা ডিম্বকনালিতে প্রেগনেন্সি

এ তো গেল পিল এবং কপারটি-বিষয়ক জটিলতা। লাইগেশন বা টিউবেকটমির জটিলতাও কিন্তু কম নয়। সুস্থ মানুষের শরীরে টিউবেকটমি অপারেশন হবার তাৎক্ষণিক মৃত্যুর হার ০.১৩%। ক্লায়েন্ট অসুস্থ হলে এই হার আরও বেশি হয়। এ ছাড়া ‘একটোপিক প্রেগনেন্সি’ নামক একটি দুর্ঘটনাও ঘটে। ‘একটোপিক প্রেগনেন্সি মানে জরায়ুর বাইরে ভ্রূণোদ্‌গম হওয়া। এই প্রেগনেন্সি সাধারণত বড় বড় দুর্ঘটনাও ঘটায়, মৃত্যুও এর ফলে অসম্ভব কিছু নয়।

লাইগেশনের তুলনায় ভ্যাসেকটমি সহজ এবং নিরাপদ পদ্ধতি। কিন্তু ভ্যাসেকটমি করবার পুরুষ নেই দেশে, যদিও পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনে তাদের গলার জোরটাই বেশি। তাদের জন্য অন্য কোনও অস্থায়ী ব্যবস্থাও তৈরি হচ্ছে না। এর কারণ কী? পদ্ধতি কেবল নারীর ওপরই একতরফা চাপাতে হবে? নারীর ওপর চাপানো সহজ বলে?

জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলো পুরুষকে তেমন গেলানো যায় না, যত যায় নারীকে। এই ব্যবস্থা নারীকেই একা গেলানো হয়, নারীর শরীরে এগুলো নানা রকম উৎপাত করে, তবু নারীকেই গিলতে হয় জগতের সকল গরল। গিলে রক্ষা করতে হয় পুরুষের ‘পরিকল্পিত পরিবার’। রক্ষা করতে হয় পুরুষের সুখ ও সমৃদ্ধি। রক্ষা করতে হয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জগতের ভারসাম্য।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন