আগ্রাসন

তসলিমা নাসরিন

ছোটবেলায় বিয়েবাড়ির গেট সাজানো দেখতাম, দু’পাশে কলাগাছ পুঁতে বিয়ের গেট সাজানো হত অথবা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফ্রেম বানিয়ে ঝাউপাতায় সাজানো হত গেট। গেটের উপর কুলোর ভেতরে নানা রং দিয়ে ‘শুভ বিবাহ’ লেখা হত। মাটির কলসিতে আলপনা এঁকে সাজানো হত, শীতলপাটিতে নানা রকম নকশা এঁকে গায়েহলুদের দিন মাটিতে বিছিয়ে রাখা হত। তা ছাড়া ঘরের মেঝে ভরে আলপনা আঁকা হত। লাল-নীল কাগজ কেটে দেওয়ালে ঝোলানো হত।

আজকাল আর ও-সব দেখি না। আজকাল বিয়েবাড়ির গেট, জন্মদিনের গেট, মিলাদ মাহফিলের গেট, গায়েহলুদের গেট, মুসলমানির গেট, আকিকার গেট সব একই কায়দায় সাজানো হয়। শহরে এখন ডেকোরেটরদের ব্যাবসা জমজমাট। তারা যে-কোনও অনুষ্ঠানে ডাক পড়লেই কাপড়ের গেট বানাতে যায়। কাপড় পেঁচিয়ে এক রকম গম্বুজ আকৃতির জিনিস তৈরি করে, যার নীচ দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে। কাপড় প্যাঁচানো এ-জাতীয় গেটের সঙ্গে ইসলামি স্থাপত্যের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ঢাকা শহরে ভিআইপি রোডের দেওয়ালে এক সময় ইসলামি স্থাপত্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার ঘটেছিল। সরকার বদলেছে, দেওয়ালে ইসলাম সাঁটার কাজ আপাতত বন্ধ হয়েছে।

আপাতত বলছি এ-জন্য যে, যেহেতু প্রতিটি সরকার ‘ইসলাম’কে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সবচেয়ে উপযোগী উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে, তাই দেওয়ালে, রাস্তায়, ফুটপাতে, সড়ক-দ্বীপে ইসলামি নকশা তৈরির কাজ শুরু হতে আর কতক্ষণ!

সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে। অন্তত বদলাবার জন্য জোর চেষ্টা চলছে। আমাদের দীর্ঘ বছরের অভ্যাসের উপর নতুন এক আগ্রাসন আমাদের হাড়মাংসে টের পাইয়ে দিচ্ছে যে প্রলয় আসছে, এই প্রলয়ে ওলটপালট হচ্ছে আমাদের এতকালের বোধ ও বিশ্বাস, আমাদের যাপিত জীবনের ছবি।

আজকাল গায়েহলুদেরও গেট হয়, কানের ফুটো করলেও গেট, আকিকা দিলেও গেট। কেন গেট হয়, এই গেটের উদ্দেশ্য কী, আমি ভেবেছি অনেক। ভেতরে কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে, গেটটি সম্ভবত সে-কথা বোঝাবার একটি ভাষা। এই বোঝাবার ভাষাটি দিন দিন কৃত্রিম হয়ে উঠছে। ক্রমেই এটি বানানো-সাজানো অনান্তরিক হচ্ছে। আগে গেট সাজাত আয়োজকের নিজের লোকেরা। পাড়াপড়শি বা স্বজন মিলে। এর পেছনে কাজ করত তারুণ্যের আবেগ-উচ্ছ্বাস, দল বেঁধে কিছু করবার আনন্দ। এখন আর আলপনা আঁকবার ধুম পড়ে না, সারারাত জেগে কাগজ কেটে, কুলোয় ছবি এঁকে বাড়ি সাজায় না কেউ।

এখন টাকা দিয়ে লোক এনে বাড়ির গেট বানানো হয়, রাতের বাতি সাজিয়ে দেওয়া হয় ডেকোরেটরদের পছন্দ যেমন, তেমন। মানুষ যত সভ্য হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে যত, তত কমে যাবার কথা অর্থ দিয়ে কৃত্রিমতা কেনা, অর্থ দিয়ে অর্থহীনতা কেনা। অথচ এ-দেশে শনৈ শনৈ বেড়ে যাচ্ছে মিথ্যে একটি বোধ, অন্য এক সংস্কৃতি।

রমজান মাস কৃচ্ছ্র করবার মাস বলেই জানতাম। অথচ এ-মাসটিকেই সবচেয়ে বেশি ভোগের এবং বিলাসিতার মাস বলে আমার মনে হয়। এই কৃচ্ছ্রের মাসে এত ভোজনবিলাসের আয়োজন হয় যে, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায়, শাকসবজি, মাছমাংস সব চড়া মূল্যে বিক্রি করে মুসলমান ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যায় বাড়ি বাড়ি ইফতার পার্টির ধুম শুরু হয়। টেবিলজুড়ে সাজানো হয় অসংখ্য বাহারি খাবার। দেখে মনে হয় না এ-মাস কৃচ্ছ্রের মাস, সংযমের মাস, এ-দেশ দরিদ্রের দেশ।

আমাদের এই বিশাল গ্রামের মতো দেশটির ওপর ইটপাথরের যে নগরায়ণ হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপে ভিন্ন এক সংস্কৃতিকে ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে একটি জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি নিয়ে আধা-নগর, আধা-গ্ৰাম এমন এক মিশ্র পরিবেশে বাঙালি মানুষ হচ্ছে ঠিকই (অর্থাৎ হাত-পা-মাথা ইত্যাদি অঙ্গ বর্ধিত হচ্ছে ঠিকই) কিন্তু সত্যিকার বাঙালি হচ্ছে না, অথবা প্রকৃত মানুষ হচ্ছে না।

আমাদের সংস্কৃতির ওপর লেপন করা হচ্ছে শবেবরাতের রুটি-হালুয়া, পটকা পটাশ, এখন আমাদের সংস্কৃতির ভেতর কোনও সুখের সংবাদ শোনামাত্র মিলাদ মার্ফিল, এখন আমাদের সংস্কৃতি বিশালাকার সিন্ধি গোরু জবাই করে তেলে-মশলায় রান্না করে খাওয়া, এখন আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে পোলাও, কোর্মা, বিরানি, তেহারি, গোরু-খাসির রেজালা, কাবাব, কোপ্তা, বোরহানি, জর্দা, খেজুর। এখন আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে আসন গেড়েছে তেলে ডোবা ভোগ্যবস্তু। ক্ষুধার্ত এক জাতির সামনে এখন আলোকসজ্জা, এখন বস্ত্রহীন জাতির সামনে কাপড়ে সাজানো গেট, এখন ঝলমলে সুগন্ধি ছড়ানো জুসমে জুলসে। এখন তেলে ও মশলায় ডোবা গোরু-খাসি, এখন জাফরান রঙের পোলাও।

আমরা, আমরা বাঙালি নামের মানুষ কোন দিকে বাড়াব আমাদের হাত? কোন সভ্যতার দিকে, কোন সংস্কৃতির দিকে? এ-সময়ই কি শ্রেষ্ঠ সময় নয় নিজেকে চিহ্নিত করবার যে, আমরা কোন জাতি এবং আমরা লালন করি কোন সংস্কৃতি? ভিন্ন সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। এখনও যদি সচেতন না হই তবে ধ্বংস ছাড়া বাঙালির আর গন্তব্য থাকবে না কোথাও যাবার।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন