তসলিমা নাসরিন
কিছু কিছু নিকৃষ্ট প্রথাকে মানুষ এখনও সমাজে জিইয়ে রাখছে। ‘বহুবিবাহ’ প্রথাটি নিকৃষ্ট প্রথা হিসেবে নিশ্চয় উল্লেখযোগ্য। একবার এক বিজ্ঞ সমাজতাত্ত্বিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম— পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার আছে, নারীর নেই কেন? তিনি আমাকে উত্তর দিলেন অবিকল এই ভাষায়— ‘প্রকৃতি— সে মানুষের হোক আর জন্তুজানোয়ারের হোক, একাধিক বিয়ের আকাঙ্ক্ষা তার থাকেই। বনের জন্তু তো বটেই, যদি গৃহপালিত জন্তুর কথাই ধরা হয়, তবে এ নিশ্চয়ই সকলে লক্ষ করেছেন যে, বহুসংখ্যক গাভি এবং ছাগীর জন্য একটি করে ষাঁড় এবং পাঁঠা থাকে। গাভি এবং ছাগীরা একটি ষাঁড় এবং পাঁঠার কাছ থেকে গর্ভধারণ করে। একই রকম মুরগির বেলায়, একাধিক মুরগির জন্য একটি মোরগই যথেষ্ট, একটি মোরগ কখনও রাজি নয়, অন্য এক মোরগ এসে তার আওতাধীন কোনও মুরগির প্রতি আকৃষ্ট হোক। সুতরাং জন্তু যেমন বহু স্ত্রী-গ্রহণে অভ্যস্ত, পুরুষও তেমন বহু স্ত্রী-গ্রহণে আগ্রহী হবে— এ তো খুব সাধারণ কথা।
হ্যাঁ, সাধারণ কথাই বটে। সাধারণ কথাটিই অবশ্য বড় অসাধারণ ঠেকেছে আমার কাছে। বহুবিবাহের পক্ষ নিতে গেলে পুরুষ নিজেকে গোরু, ঘোড়া, মোষ, ছাগলের সঙ্গে তুলনা করতে দ্বিধা করে না। যদিও ফাঁক পেলেই সে দাবি করে, সে আশরাফুল মুখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব।
২. ‘কনে দেখা’ বলে এক ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের চল আছে এই দেশে, শুধু দেশেই বা বলি কেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই। পুরুষেরা যখন নারীদের ভোগ করবার জন্য বিবাহ নামক স্বীকৃতির আশ্রয় নেয়, তখন ভোগের বস্তুটিকে নেড়েচেড়ে দেখবার বা পরখ করবার জন্য যে অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়— তাকেই বলে ‘কনেদেখা’। বিবাহ ঘটে বর এবং কনের মধ্যে। কনেকে দেখতে যায় বর, দেখতে যায় মানে বাজিয়ে নিতে চায়, বস্তুটিকে ভোগের জন্য তার মনে ধরছে কি না। ‘বরদেখা’ বলে কোনও অনুষ্ঠানের চল নেই কোথাও। কনে তার নিজের জন্য দলবল নিয়ে বর দেখতে যায় না। বরের নাক, কান, চুল, চোখ, বুক, পেট, পা, বরের হাঁটাচলা, রাঁধাবাড়া, নাচগান, সেলাই, বরের পড়ালেখা, চাকরিবাকরি, স্বভাবচরিত্র ইত্যাদির খোঁজ নিতে কনে যায় না— এর কারণ ওই একটিই, চল নেই।
বরপক্ষ কনের বাড়ি এসে কনের গায়ের রং দেখে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দেখে, দাঁত দেখে বাঁকা না সোজা, নাক দেখে খাড়া না বোঁচা, চোখ দেখে, চোখের দৃষ্টি দেখে, চুলের খোঁপা খুলে চুল মেপে দেখে কতটা দিঘল বা ঘন কালো মসৃণ। বরপক্ষ কনের পায়ের কাপড় তুলে পায়ের গোড়ালি দেখে জলে পা ভিজিয়ে মেঝেয় হাঁটতে বলে, পায়ের ছাপে যদি বক্রতা না থাকে তবে এ. নারী চরিত্রহীন, কনেকে হাঁটিয়ে, পড়িয়ে, লিখিয়ে, বলিয়ে, রাঁধিয়ে তারা আরও পরখ করে যে, বস্তুটি শরীরের খোরাক তো জোগাবেই, মনের খোরাকও যথেষ্ট জোগাতে পারবে কি না।
কনে দেখে পছন্দ হলে বরপক্ষ দরদাম করে কনে কেনে। আফটার অল মানুষ তো, তাই শশা, খিরা, ফুলকপি বা পালংশাক কিনে বাড়ি নিয়ে আসবার মতো নয় ব্যাপারটি। পছন্দ করে ‘বায়না’ করে আসতে হয়, তারপর ‘তুলে নেওয়া” বা ‘উঠিয়ে নেওয়া’। দামি পণ্যের বেলায় যা হয়।
বরপক্ষ একটি আংটি পরিয়ে আসে কনের কড়ে আঙুলে। এর নাম হচ্ছে মুখ, বুক, নিতম্বওয়ালা মাংসপিণ্ডটি এখন আমার জন্য বাঁধা, এটি এখন আর অন্য কোথাও বিক্রি হতে পারবে না। ব্যাস, পরে সময়মতো দেনমোহরের বিনিময়ে কনেটিকে ‘উঠিয়ে নিয়ে আসা’ হয়। দেনমোহরের টাকার ভেতরেও এক ধরনের ফাঁকি আছে, তা কেবলই উচ্চারিত, দেওয়া হবে তখন, যখন বস্তুটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, বস্তুটির প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে আসবে পুরুষের কাছে। এই চুক্তিতে যতদিন কনে বাঁধা থাকবে, কনেটি ক্রেতার ইচ্ছে- অনিচ্ছে, মন-মর্জি, মতিগতি, রুচি-বাসনার কাছেও বাঁধা থাকবে।
কনেদেখার নিয়মটি নতুন নয়। কোরানেও স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বিবাহের আগে কনে পরখ করবার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত আনাস বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত মহম্মদ (সাঃ) একটি মেয়েকে বিয়ে করবার জন্য ভাবছিলেন, তখন মেয়েটিকে দেখবার জন্য অপর এক স্ত্রীলোক পাঠান এবং বলে দেন— কনের মাড়ির দাঁত পরীক্ষা করবে এবং কোমরের উপরিভাগ পিছন দিক থেকে ভাল করে দেখবে।
[মওলানা মুহম্মদ আবদুর রহিম: পরিবার ও পারিবারিক জীবন। পৃষ্ঠা ১৩০]
ইমাম আওজায়ি বলেছেন— কনে দেখতে গেলে কনের মুখ ও হস্তদ্বয় দেখা তো যাবেই, তার প্রতি তাকানো যাবে, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখা যাবে এবং তার মাংসপেশিসমূহও দেখা যাবে।
দাউদ জাহেরি বলেছেন- তার সর্বশরীর দেখা যাবে। ইমাম হাজম বলেছেন- তার যৌনঅঙ্গকেও দেখে নেওয়া যেতে পারে। [প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ১২৮]
.
যৌনঅঙ্গকে দেখতে হবে, কারণ যৌনঅঙ্গেই তো লুকিয়ে আছে ‘আসল মজা’। এখানেই আছে সতীত্ব ও অসতীত্বের চিহ্ন। যেহেতু পুরুষের যৌনঅঙ্গে কোনও চিহ্ন থাকে না, তাই তা দেখেও কোনও লাভ নেই। আর যদি দেখাই যায় যে, পুরুষের যৌনঅঙ্গে বহু উপগমনের দাগ, তবে কোনও কনের সাধ্য আছে পুরুষকে দোষ দেয়? না, এতে পুরুষের দোষ নেই। পুরুষেরা ‘প্রেরিত পুরুষ, পুরুষেরা কালিকলঙ্কহীন সাধুসন্ত, তাদের চুনকাম করা শরীরে কোনও কাদার ছোপ লাগে না।
‘কনেদেখা’ নিয়মটি এই সভ্য দেশে এখনও টিকে আছে। আমাকে আশ্চর্য হতে হয় আরও, দেশের শিক্ষিত নার:রা ‘কনেদেখা’ অনুষ্ঠানে সাজগোজ করে যখন অংশগ্রহণ করে। কোরবানির গোরুও রঙিন মালা পরে অপেক্ষা করে বিক্রি হবার। গোরুও মনে হয় মেয়েমানুষের চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্বশালী। গৌরুও ক্রেতাকে সুযোগ-সুবিধেমতো শিংয়ের গুঁতো দেয়, দু’একটি লাথিও দিতে ছাড়ে না।
কিন্তু মেয়েমানুষ থাকে মুখ বুজে, চোখ নামিয়ে। তাকে যে পাত্রে দেওয়া হয়, সে পাত্রেই পতিত হয়। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্য নেই কোনও। তার সকল ইচ্ছে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষেরা।
৩. ‘পণ’ বা ‘যৌতুক’ নামে এই দেশে আরও একটি প্রথা বেশ জনপ্রিয়। কনেপক্ষ বরপক্ষকে যৌতুক দান করে। এটি আইনত নিষিদ্ধ হলেও এর ব্যবহার রোধ করবার উপায় নেই। কারণ বরের দাবি না মানলে মেয়ে তো আইবুড়ো হয়ে মরবে। আইবুড়ো হলে, মেয়ের কোনও অসুবিধা হয় না, যত অসুবিধে সমাজের। যৌতুক শখ করে দিচ্ছে সব কনেপক্ষ, তা কিন্তু নয়। দরিদ্র কনেপক্ষ যৌতুকের শর্তে মেয়ে পার করছে বটে, কিন্তু শেষ অবধি শর্ত ঠিক পালন না হলে মেয়েকে গোরু জবাই-এর মতো জবাই করছে আমাদের ‘বিবেকবান পুরুষেরা’। একটি ট্রানজিস্টার, একটি সাইকেল বা একটি ঘড়ির লোভে যে পুরুষদের লালা গড়ায়, তারাই দরিদ্র মেয়েকে হয় ফাঁসিতে ঝোলায়, নয় পুড়িয়ে ফেলে, নয় গলা টিপে মেরে ফেলে। এ আর এমন কী আপদ দূর হল! আর যে যাই বলুক, এ-কথা তো স্বীকার করতেই হবে, একটি ট্রানজিস্টার, সাইকেল বা ঘড়ির চেয়ে মূল্যবান নয় মেয়েমানুষের জীবন।
তাই প্রতিদিন যদি যৌতুকের কারণে একশোটি বধূহত্যার খবরও পৌঁছোয় আমাদের কাছে, আমরা নির্লিপ্ত বসে থাকি, আমাদের পিঠে কোনও চেতনার চাবুক পড়ে না।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন