তসলিমা নাসরিন
এখন যে সমাজ দেখছি, সমাজ আসলে এ-রকম ছিল না। সমাজের অনেক বদল হয়েছে। সমাজে একসময় স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন্ত স্ত্রীকে জোর করে আহুতি দেওয়া হত স্বামীর জলন্ত চিতায়। এই বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি লর্ড বেন্টিংককে সম্মত করিয়েছিলেন ১৮২৯ সালের ২৭নং আইন বিধিবদ্ধ করাতে। এই আইন নারীকে সহমরণের থাবা থেকে বাঁচিয়েছিল বটে কিন্তু সারা জীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবার নিয়ম তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাল্যবিধবাদের বাধ্য করা হত পোশাকে, আহারে, শরীরে ও মনে কঠোর সংযম পালন করতে। এই করেই দিন যাচ্ছিল, সমাজ চলছিল আর এই সমাজ বদলাতে তখন এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি বিধবাদের পুনরায় বিয়ে দেবার জন্য ব্যভিচারের আশঙ্কা দেখিয়ে এবং শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে আঘাত করে ১৮৫৬ সালের ১৫নং আইনের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ বৈধ করিয়েছিলেন।
১৮৯১ সালে ‘এজ এফ কনসেন্ট অ্যাক্ট’ দ্বারা বাল্যবিবাহ রোধ হয়। ১৯২৩ সালের ৩০নং আইন অসবর্ণ বিয়েকে বৈধ বলে মানে। ১৯২৯ সালের ১৯নং আইনে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের বয়স ন্যূনপক্ষে ১৮ এবং মেয়ের বয়স ১৫ করা হয়েছে। ১৯৪৬ সালে ১৯নং আইন স্ত্রীদের অধিকার দেয় বিশেষ বিশেষ কারণে স্বামী ত্যাগ করতে। ১৯৪৯ সালের ২১নং আইন বিবাহক্ষেত্রে জাতি, বর্ণ, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের সকল বাধাবৈষম্য দূর করে। ১৯৫৫ সালের ২৫নং আইন আরও এগিয়ে বিবাহক্ষেত্রে নতুন শর্তারোপ করেছে। এই শর্তারোপ করবার ফলে আগের চেয়ে সমাজে নারীরা সুযোগ-সুবিধে বেশি পাচ্ছে।
বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলমানদের আইন আবার ভিন্ন। হিন্দু বিয়ে যেমন এককালে শাস্ত্ৰ মেনে চলত, মুসলমান বিয়েও শাস্ত্র মেনে চলত। তিনবার ‘তালাক’ বললেই তালাক হয়ে যেত। তালাক উচ্চারণ করবার সময় কোনও সাক্ষী বা স্ত্রীর উপস্থিতিরও প্রয়োজন হত না। কোরানে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তুমি যদি মনস্থির কর, তুমি তালাক বলবে, মনে রেখ আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা। সুতরাং তালাক বললেই তালাক। এখন তালাক বললেই তালাক হয় না, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠাতে হয়। সেই চিঠির কপি স্ত্রীকে পাঠাতে হয়, তারও পর নব্বই দিন পার হলে তালাক হয়। কেবল তাই নয়, তালাকের পর ‘ইদ্দত’ কাল পার হলে আরেকটি বিয়ে ঘটিয়ে অতঃপর প্রথম স্বামীর ঘরে যেতে হয়। এই নিয়মটি এতকাল ছিল, এখন উঠে গেছে। উঠে যাওয়ার কারণ একটাই— মানুষের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে।
মুসলমানদের মধ্যে নিয়ম ছিল, পুরুষের যদি ইচ্ছে হয়, সে এক দুই তিন এবং চার পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে। তখন কিন্তু এ-রকম ছিল না যে, বিয়ে করতে হলে স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। এখন অনুমতির নিয়ম শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে আগের নিয়মগুলো বদলে যাচ্ছে। ভারতে ১৯৮৬ সালের আগে মুসলমান তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ‘ইদ্দত’-এর সময় স্বামীর কাছ থেকে খোরপোশ পেত না। ১৯৮৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট শাহবানু মামলায় তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব শাহবানুর প্রাক্তন স্বামীকে দিয়েছিল। এই নিয়ে ভারতের মুসলমান সমাজ হইচই শুরু করে, তারা বলে প্রাক্তন স্বামীর ওপর খোরপোশের দায়িত্ব অর্পণ করে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ৮ মে তারিখে সংসদে ‘তালাকের পর অধিকার সংরক্ষণ বিল’টি পাস হয়, এতে ইদ্দত-এর সময় স্বামীকে স্ত্রীর খোরপোশ দেবার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন স্ত্রীকে বিশেষ বিশেষ কারণে অধিকার দিয়েছে স্বামীর তালাক দেবার, যদিও শরিয়তি আইন স্ত্রীর তালাক দেবার অধিকার স্বীকার করেনি। প্রথম স্বামীকে আবার বিবাহের জন্য তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহের প্রয়োজন হয় না এখন। এখন না শরিয়তি, না সভ্য— এমন এক অবস্থায় আছে মুসলিম বিবাহ আইন। এই আইন কিছুটা শরিয়ত নিয়ে, কিছুটা সভ্যতা, নিয়ে অদ্ভুত একটি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। সভ্যতার দিকে তার গতি খুব ধীর। এত ধীর যে, বাঙালির এক সম্প্রদায়েই নিয়ম তৈরি হয়েছে, বিবাহকালে ‘স্বামীর অন্য স্ত্রী বা স্ত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকবে না।’কিন্তু আরেক সম্প্রদায়েই স্ত্রী জীবিত থাকলেও এক-দুই-তিন-চার করে অনুমতিসাপেক্ষে বিবাহ করা যায়। সতীদাহের নিয়ম থেকে আধুনিক হিন্দু বিধিতে পৌঁছোতে সময় লেগেছে একশো আটাশ বছর। সেই তুলনায় শরিয়তি আইনের ওপর মুসলিম পারিবারিক আইনের মলম লাগাতে আরও দীর্ঘ বছর সময় লেগেছে এবং এ-কথাও সত্য যে, এই আইন হিন্দু আইনের তুলনায় অনেক অনুন্নত, অসভ্য, অনাধুনিক।
গতিকে আরও বেগবান করবার জন্য বাঙালি মুসলমানের উচিত এই আইনটির প্রচলন— ‘বিবাহকালে স্বামীর অন্য স্ত্রী বা স্ত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকবে না।’ যতদিন পর্যন্ত এই আইনটি ‘মুসলিম বিবাহ আইনে’ অন্তর্ভুক্ত না হবে, ততদিন পর্যন্ত সমস্যা দূর হবে না। বিজ্ঞান দ্রুত এগোচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে আমাদের সমাজকে পিছিয়ে রেখে আমরা যতদূর যেতে চাই, আসলে তা যাওয়া নয়, সত্যিকার অগ্রসর নয়। সমাজ তার শরিয়তি থাবা দিয়ে মানুষকে পেছনে আটকে রাখবেই।
যৌতুক নিষিদ্ধ করলেও সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা বিদায় হয়নি। এই প্রথাকে নির্বাসন দেবার জন্য আইনকে আরও কঠোর হতে হবে। শরিয়তি আইনের যে ছিটেফোঁটা এখনও বর্তমান আছে, তার উচ্ছেদ প্রয়োজন এবং প্রয়োজন উত্তরাধিকার আইনে পুত্র কন্যার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। দেনমোহর, খোরপোশ ইত্যাদি প্রথা তুলে দিতে হবে কারণ এ-সবই নারীকে অমর্যাদা করে সবচেয়ে বেশি। নারীকে খোরপোশ বাড়িয়ে দিয়ে বা তালাকের পর আগের স্বামীর ঘরে যেতে হলে যে একটি বিবাহ ঘটাতে হত, সেই ‘ভায়া বিবাহ’ তুলে দিয়ে নারীর মর্যাদা বাড়ানো যাবে না। নারীর মর্যাদা বাড়বে তখনই, নারী যখন ‘বিয়ে করবে’, ‘বিয়ে বসবে’ না। আর তখনই তার বিয়ে করা যুক্তিসংগত হবে, যখন তার আর দেনমোহরের প্রয়োজন হবে না, খোরপোশের প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ কোনও দানদক্ষিণা বা করুণার প্রয়োজন হবে না। নারীকে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হবার বাধ্যতামূলক আইন তৈরি করলে শরিয়তি আইন আপনাতেই বিলুপ্ত হবে। আর তা না হলে বর্তমান এই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা আর গাধাকে মানুষ বলা আমার দৃষ্টিতে একই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন