তসলিমা নাসরিন
বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, একটা সময় ছিল যখন কিছু উৎসর্গ করা হত। এই ‘কিছু’ কিন্তু জ্যান্ত, কচি, টগবগ করে লাফায় এমন প্রাণী, প্রাণীর মধ্যে আবার যে-সে প্রাণী নয়, একেবারে মানুষ। মানুষ তো দু’রকমের, এক বড়জাতের দুই ছোটজাতের। ছোটজাতের মধ্যে পড়ে ‘মেয়েমানুষ’, সেই মেয়ে মানুষই, কুমারী মেয়ে। কুমারী মেয়েকে বলি দেওয়া হত প্রভু এবং কল্যাণের নামে।
গ্রিসের উর্বরতা, বিবাহ এবং প্রজননের দেবী আর্তেমিস একবার আগামেমননের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে চাইলেন আগামেমননের কন্যা ইফজেনিয়াকে। ইফজেনিয়াকে বলি দেবার সময় আর্তেমিস অবশ্য একটি মৃগী বলি দিতে আদেশ করলেন। আর ইফজেনিয়া হয়ে গেল আর্তেমিসের মন্দিরে দেবদাসী। দেবদাসী হওয়া এবং বলি হওয়ার মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য করি না।
ট্রয়ের নৃপতি প্রিয়াসের কন্যা পলিকসেনা ছিল একিলিসের বাগদত্তা। ট্রয় ধ্বংসে একিলিসের মৃত্যুর পর প্রেতাত্মা এসে দাবি করল পলিকসেনার বলি। গ্রিকরা একিলিসের সমাধির উপর অগত্যা পলিকসেনাকে বলি দিল। প্রেতাত্মার উদ্দেশ্যেও বলি হয়, বলি অবশ্য কেবল নারীকেই দেওয়া হয়।
দুর্ভিক্ষ বা মহামারিতে এথেন্সের জনগণ এক দৈববাণীর আদেশ মান্য করে গেরিসটাস সাইক্লপস-এর সমাধির উপর হেসিস্থাসের কন্যাদের বলি দিত।
লোক্রিস থেকে একবার এক কুমারীদলকে এথেনার মন্দিরে পৌরোহিত্য করবার জন্য সেবাদাসী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। পরে সেই কুমারীদের হত্যা করা হয়। আর হত্যার ছাই পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। দেবতা থেকে শুরু করে প্রেতাত্মা পর্যন্ত কুমারী মেয়ের রক্তপান করে সন্তুষ্ট হতেন। যুদ্ধের দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য দেশের রাজা, এমনকী সাধারণ নাগরিকও কুমারী বলির জন্য আগ্রহ দেখাতেন।
শুধু প্রাচীন গ্রিসেই নয়, কেলটিক জনগোষ্ঠীর পুরোহিত দ্রুইদরা দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুমারী বলি দিতেন। প্রাচীন ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ, ওয়েলস আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যেও কুমারী-বলিপ্রথা প্রচলিত ছিল। জিহোবার উদ্দেশ্যে কুমারী-বলির কথা বাইবেল থেকেই জানা যায়।
দক্ষিণভারতে শক্তিসাধন পদ্ধতির অঙ্গ হিসেবে কুমারী-বলির প্রচলন ছিল। কারও আরোগ্যকামনায় কালীদেবীর কাছে কুমারী বলি দেওয়ার ঘটনা বেশ ঘটত। পাঞ্জাবের কাংড়া পার্বত্য অঞ্চলে প্রতি বছর একটি প্রাচীন দেবদারু গাছের কাছে একটি কুমারী মেয়েকে বলি দেওয়া হত। নগ্নদেহ কুমারীকে শস্যখেতে নিয়ে হত্যা করলে খেতের উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়—এই বিশ্বাস পৃথিবীর সকল জাতিকোষগুলোর মধ্যে ছিল। কুমারী কন্যার আত্মাহুতি শুকনো পুকুরকে জলে পূর্ণ করে—এমন বিশ্বাসও প্রচলিত ছিল পাঠানকোটের কাছে চম্পাবতী শহরে।
নীলনদের জল যেন বাড়ে, এই কামনা করে প্রতি বছর একটি কুমারী মেয়েকে নীলনদে ডুবিয়ে দেওয়া হত। নীলনদের জলস্ফীতি আমার দেখা হয়নি, আমি জানি না, বছরের কুমারীভোগ ওকে কতটা টইটম্বুর করত।
মিশরের প্রাচীন সিলমোহরেও প্রতি বছর একটি যুবক ও যুবতীকে বলি দেওয়ার ঘটনা লেখা আছে।
গ্রেট বেনিনের একটি মেয়েকে এক গাছের ডালে বেঁধে চাবকে মেরে ফেলা হয়েছিল। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, মেয়েটি ওই গাছেই ঝুলে থাকবে। শকুনে তাকে খাবে। এই মেয়ে-বলির উদ্দেশ্য বর্ষণ-এর দেবতার অনুগ্রহ লাভ।
মড়ক লাগলে ‘চিপোয়া’রা মনে করত এ তাদের পাপের ফল। এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে এবং প্লেগের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তারা গোষ্ঠীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে জলে ডুবিয়ে মারত।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে দৈত্যদেবী পেলির কাছে কুমারী মেয়েকে উৎসর্গ করা হত। আগ্নেয়গিরি ‘কিলোউয়া’র দেবী পেলি। বলির নিয়ম ছিল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে মেয়েটিকে ভেতরের গনগনে লাভার মধ্যে ফেলে দেওয়া।
মালডাইভ দ্বীপপুঞ্জের লোকেরা দেখত প্রতি মাসে একটি জিন অসংখ্য প্ৰদীপ জ্বালিয়ে একটি জাহাজে করে দ্বীপের দিকে আসছে। দেখে দ্বীপবাসীরা যে-কোনও কুমারীকে নতুন বধূর সাজে সাজিয়ে সমুদ্রপাড়ের মন্দিরে রেখে আসত। পরদিন মেয়েটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যেত। পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা কুমির রাজপুত্রকে তৃপ্ত করবার জন্য একই কাজ করত।
প্রায় সকল আদিম, অসভ্য জাতি মেয়ে-শিশুকে হত্যা করত। রাজপুতরা করত, আরবেরা কন্যা জন্মালে জ্যান্ত পুঁতে ফেলত। কেঁধা প্রদেশের আরবেরা মেয়ে-শিশুর পাঁচ বছর বয়সে শিশুর মাকে বলত—‘এইবার মেয়েকে গন্ধ মাখিয়ে দাও, সাজিয়ে দাও, আজ সে তার মায়ের ঘরে যাবে।’ এর অর্থ, মেয়ে এখন কুয়োর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। কোরাইশ বংশের লোকেরা মক্কার কাছে আবুদেলামা পাহাড়ে নিজেদের কন্যাকে হত্যা করত। অস্ট্রেলিয়ার অসভ্য অধিবাসীরাও কুমারী মেয়েকে জীবন্ত পুঁতে ফেলে ভূদেবীকে প্রসন্ন করত এবং সেই কবরের উপর সমস্ত গ্রামের শস্যবীজ রেখে যেত, তারা বিশ্বাস করত, মেয়ে দেবতা হয়ে ওই বীজের মধ্যে প্রবেশ করবে এবং শস্য ভাল হবে। চিনের প্রাচীন এবং পবিত্র শহর ‘পিকিন’-এর ঘণ্টা নির্মাণের পেছনেও আছে কুমারী কন্যার আত্মাহুতি। ঘণ্টার উত্তপ্ত মিশ্র ধাতুকে যথোপযুক্ত করে গড়ে তুলবার জন্য কারিগরের কন্যাকে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্রথম ঋতুমতী কুমারী মেয়ের ঋতুরজঃ ব্যবহৃত হত জার্মানিতে শানিত তরবারি তৈরির লোহাকে উত্তপ্ত করবার জন্য। জাপানে বছরের এক বিশেষ সময় সাপ ও বানরের কাছে কুমারী মেয়েদের উৎসর্গ করা হত। কোরীয় রাজ্য-সমাধির উপর একইসঙ্গে নরনারী বলি দেওয়ার রীতি ছিল। নিউগিনির আদিম অধিবাসীরাও কুমারী বলি দিত। পিউবারটি রাইটস নামের অনুষ্ঠানে একজন কুমারী মেয়েকে বিচিত্র রং ও পোশাকে সাজিয়ে উৎসবের উদ্যোক্তারা একের পর এক মেয়েটির সঙ্গে মিলিত হয়। মন্ত্রোচ্চারণ হয়, বাদ্যযন্ত্র বাজে, তারপর মেয়েটির সঙ্গে শেষ মিলনের জন্য একটি তরুণকে নির্বাচন করা হয়। মিথুনাবস্থায় ওদের উপর ভারী কিছু ফেলে ওদের পিষে মারা হয়। বাদ্যযন্ত্র ও জনতার উল্লাস ওদের আর্তনাদকে ডুবিয়ে দেয়। পরে মৃতদেহ দুটোকে টুকরো-টুকরো করে কেটে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলা হয়।
বলির শবদেহ পুড়িয়ে খেয়ে ফেলবার রীতি মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যেও ছিল। আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে নতুন রাজার অভিষেকের সময় প্রায় একই ধরনের বলি হত। মিথুনাবস্থায় তরুণ-তরুণীকে আগুনে পুড়িয়ে গর্তে ফেলে দেওয়া হত।
আজটেকদের ভুট্টাদেবীর নাম চিকোমেকোহয়াতল। প্রতি শরতে এর পুজো হত। পুজোর সাতদিন আগে থেকে ভক্তরা উপোস করত। পুজোর দাস পরিবার থেকে এক কুমারী মেয়ে নিয়ে ভুট্টাদেবীরূপে সাজাত। এই দেবী নিয়ে মন্দিরে নানা রকম আচার-অনুষ্ঠান পালন করে পুরোহিতরা স্তূপীকৃত শস্যের উপর মেয়েকে ফেলে গলা কেটে ফেলত। এর পর একজন পুরোহিত দেবীর সাজসহ মেয়ের চামড়া কেটে নিয়ে নিজের গায়ে চড়াত এবং ভক্তবৃন্দসহ শুরু হত সমবেত নৃত্য।
পাওনিদের মধ্যে কুমারী-বলি প্রচলিত ছিল। তারা এক কুমারী মেয়েকে বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এসে ফাঁসিকাঠের ফ্রেমের সঙ্গে বেঁধে ফেলত। এর পর আগুনে ঝলসানো হত তাকে। পরে তির বিঁধিয়ে মেরে ফেলা হত। প্রধান পুরোহিত এগিয়ে এসে মৃত মেয়ের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলত। তারপর হাড় থেকে মাংসগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে শস্যখেতে নিয়ে যাওয়া হত, ওখানে মাংসের টুকরো থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত খেতে বোনা শস্যবীজের উপর ছড়িয়ে দিত।
লাগোস অঞ্চলে ফসলপ্রাপ্তির আশায় কুমারী কন্যাকে ভেড়া, ছাগল, ভুট্টা, কলা, আলুর সঙ্গে পরপর শূলবিদ্ধ করে রাখা হত।
প্রাচীন পৃথিবীর বিশাল অঞ্চল জুড়ে, ভিন্ন ভিন্ন সমাজব্যবস্থায় বিচিত্র পদ্ধতিতে কুমারী বলি হয়েছে। কখনও এদের হত্যা করা হয়েছে সন্তানকামনায়, কখনও ধরিত্রীকে ঋতুমতী করে শস্যের ফলনবৃদ্ধির সংস্কারে, কখনও নদী বা জলদেবতার সন্তুষ্টির জন্য, কখনও মহামারির হাত থেকে গোষ্ঠীকে রক্ষা করবার আশায়, কখনও অপদেবতা প্রেতাত্মার তুষ্টিতে, কখনও যুদ্ধজয়ের জন্য।
এখনকার পৃথিবীকে আমরা আধুনিক বলি এবং মানুষকে বলি সভ্য। এখনও কি পুরুষের তৈরি ধর্ম ও বিকৃত সমাজব্যবস্থা মেয়েদের বলি দিচ্ছে না, হয়তো জ্যান্ত পুঁতে ফেলছে না বা আগুনে পোড়াচ্ছে না কিন্তু এখনকার জীবিত মেয়েরা আর কতটা জীবন্ত? তারা এক-একজন নিজেদেরই লাশ বহন করে চলছে নিজেদের ভিতর। পুরনো দিনের বলি বোধহয় এর চেয়েও কম কষ্টকর, কারণ তখন নিরন্তর একটি কষ্ট বহন করে বেড়াতে হত না। মুহূর্তে মৃত্যু এবং মুহূর্তেই মুক্তি। এখন মুক্তি নেই, এখন মৃত্যুর সঙ্গে সচল বসবাস। এও এক বিচিত্ৰ বলি।
তথ্য: মানবসভ্যতায় কুমারী বলি (দীনেন্দ্রকুমার সরকার)
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন