তসলিমা নাসরিন
১
এই খবরগুলো এত ছোট খবর যে চোখে পড়ে না। কোন মেয়ে কোন গাছে ফাঁসিতে ঝুলল, কোন বধূর গলায় কে ছুরি বসাল, কোন কিশোরীকে ধর্ষণের পর বস্তায় পুরে নদীতে ছুড়ে ফেলা হল, যৌতুক দেয়নি বলে কোন মেয়েকে গলা টিপে মারা হল, রাগ করে কার মুখে অ্যাসিড ছোড়া হল, কাকে রামদায় কোপানো হল— এ-সব এমন কোনও মূল্যবান খবর নয় যে, দেশসুদ্ধ একটা হইচই পড়ে যাবে। এত বড় বড় ঘটনা ঘটছে দেশে। সার্কের ফোয়ারা হচ্ছে, ফোয়ারার জলে সাত রং সাঁতার কাটছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেড়াতে আসছে, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ হচ্ছে— বর্ণাঢ্য র্যালি হচ্ছে, সিনেমা হচ্ছে, সিএনএন হচ্ছে, মন্ত্রীরা নতুন বাণী দিচ্ছেন, সচিবেরা ফাইলপত্র নাড়ছেন। আর এর মধ্যে কোথায় কোন পতিতাকে কারা মরবার পরও কবরস্থানে জায়গা দিল না- এ আর এমন কী মূল্যবান খবর।
কবরস্থানে এক ধরনের সাইনবোর্ড ঝোলে, ওতে লেখা থাকে— মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। অর্থাৎ জ্যান্ত মহিলারা ওতে ঢুকতে পারে না, একমাত্র মরবার পরই তারা কবরস্থানে ঢোকবার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু জামালপুর পৌরসভার ফৌতি কবরস্থানে সত্তর বছর বয়সের মালতীকে মরবার পরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফৌতি কবরস্থানের মাটি মালতীকে গ্রহণ করতে আপত্তি করেনি, আপত্তি করেছে মানুষ। মানুষেরা মৃত মালতীকে মাটি স্পর্শ করতে দেয়নি। পৌরসভার মেম্বার লাশ দাফনে বাধা দেয়। পৌর কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসকও এই বাধার বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেনি।
কেন মালতীর মৃতদেহ মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটির তল পাবে না? এই কেন’র উত্তর ওরা দিয়েছে, বলেছে— ‘মালতী পতিতা ছিল।’ মালতী পতিতা ছিল বলে মালতীর পাপী শরীর কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট করবে, তাই জামালপুরের ‘পবিত্র পুরুষেরা’ পণ করেছেন তাঁরা কোনও পাপকে প্রশ্রয় দেবেন না। সৎকারের অভাবে দু’দিন পড়ে ছিল লাশটি। শেষ পর্যন্ত কবরস্থানের সীমানার বাইরে পতিত একটি জায়গায় লাশটি পুঁতে রাখা হয়।
কিন্তু এই নির্মমতার কারণ কী? মালতী পতিতা বলে তার ওপর এত রাগ কেন সমাজের? মালতীকে পতিতা হবার লাইসেন্স কে দিয়েছে? মালতী কেন পতিতা হয়েছিল সে ইতিহাস আমি জানি না। না জানলেও এ নিশ্চয় অনুমান করা যায় যে, সরলমতি মালতীকে ভুলিয়ে ফুলিয়ে কোনও চতুর পুরুষ পতিতালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল, অথবা স্বামী তাকে সংসার থেকে তাড়িয়ে দিলে পথের পুরুষেরা তাকে টেনেহিঁচড়ে ফেলে এসেছিল পতিতালয়ে। আমি অনুমান করি মালতীর পতিতাবৃত্তিকে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এবং মালতী যেহেতু দরিদ্র ও সামাজিক নির্যাতনে ন্যুব্জ, যেহেতু সরকার তাকে আর কোনও কাজ দিচ্ছে না, বলছে অগত্যা, তুমি পতিতাবৃত্তিতে মনোযোগী হও। তাই মালতীও সমাজের ‘পবিত্র পুরুষদের’ শখের বীর্য নিজের শরীরে গ্রহণ করে নিজে সে ‘পাপী’ হয়েছে। বেঁচে থাকতে সমাজ তাকে স্থান দেয়নি। মরে গেলে কবরস্থানও তাকে স্থান দেয়নি।
সমাজের ভদ্রলোকদের আনন্দফূর্তির জন্য যে শরীরগুলো সরকার বাঁচিয়ে রাখে, সেই শরীরগুলো সৎকার করতে সরকারি লোকেরাই বাধা দেয়। পতিতাবৃত্তিতে বাধা নেই, অথচ পতিতার সৎকারে বাধা— এ কেমন নিয়ম? এ আমরা মানি না। আমরা মানে নারীরা, যে নারীরা সমাজের কিছু সুযোগ-সুবিধে পেয়ে পতিতা হবার দুঃসহ যন্ত্রণা হয়তো ভোগ করছি না, কিন্তু কোনও-না-কোনও যন্ত্রণা ভোগ করছিই। নারী হয়ে জন্মেছে অথচ যন্ত্রণা পোহায়নি— এমন নারী এ-জগতে নেই। সমাজের এবং সমাজের বাইরের সকল নারীরই নির্যাতন সইতে হয়। কারও কিছু কম, কারও বেশি। এই যা পার্থক্য।
একজন প্রধানমন্ত্রীকে আমি যে শ্রদ্ধা করি, একজন পতিতাকে তার চেয়ে কিছু কম করি না। মানুষ হিসেবে জগতের ওপর দু’জনের অধিকারই সমান। কেউ পতিতা হয়ে জন্মায় না। সমাজ কাউকে মহামনীষী করে, কাউকে মস্তান করে, কাউকে পুরোহিত করে, কাউকে পতিতা করে। সমাজের ‘সবলেরা’ সকল সুযোগ-সুবিধে নিজে নিয়ে দুর্বলকে ঠেলে দেয় অন্ধকারে, পাঁকে। পতিতা দুর্বল বলে তারা তাকে ভোগ করবে আর তাদের প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নেবে— এই যদি তাদের সমাজ হয় তবে আমি যে এই সমাজের মানুষ— এ-কথা ভাবতে নিজের প্রতিই আমার লজ্জা হয় খুব। ঘৃণাও কিছু কম হয় না।
এই সমাজের সকল নারীই আজ মালতী। সকল নারীকেই বহন করতে হয় পুরুষের কামড় এবং পুরুষের ধিক্কার। সকল নারীকেই আটকা পড়তে হয় পুরুষতন্ত্রের জালে। তাকে ভুগতে হয়। তাকে মরতে হয়।
যে মাটিতে মালতীর কবর খোঁড়া হয়নি, সেই মাটি কার? সমাজের কোন মহাপুরুষের সৎকারের জন্য সেই মাটি রাখা আছে, যে মাটিতে কবর হবার অধিকার মালতীর নেই, যে মালতী এই দেশের নারী, এই দেশের নাগরিক! মালতী এই মাটির নিঃস্ব, নির্যাতিত, দরিদ্র, দুর্বল মানুষ। এই মাটি যদি মালতীর নয়, এই মাটি তবে কার?
২
ছোটবেলায় একদিন ছাদের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে ভরদুপুরের নির্জনতা দেখছিলাম। এক সময় দেখি একজন মানুষ আসছে দূর থেকে ধীরে হেঁটে। ছাদে বসা ছিল আমার এক আত্মীয়। তাকে বললাম সারা রাস্তায় এখন একজন মানুষ মাত্র! শুনে আমার আত্মীয়টি দেখতে এল, সেও রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তায় তাকাল, এবং বিরক্ত হয়ে বলল— ‘কী যে বলো না, মানুষ কই, ও তো একটা মেয়ে।’
আত্মীয়টির কথা শুনে আমি বড় বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন এবং সেই ঘটনার পর উনিশ বছর প্রায় পার হয়ে গেছে, আজও আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন