তসলিমা নাসরিন
‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’—এ-কথা অনেকেই বলে। আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। কোনও মেয়ে যখন অন্য এক মেয়ের শাশুড়িতে পরিণত হয়, আমরা সাধারণত লক্ষ করি, শাশুড়ি-মেয়ে বউ-মেয়ের ওপর ভীষণ মারমুখো, বাপ তুলে গালাগাল করছে, দিনভর খাটাচ্ছে, সময়ে অসময়ে গায়েও হাত তুলছে, কোথাও কোথাও তো এমনও হচ্ছে যে, ননদ-শাশুড়ি মিলে বউকে একেবারে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল, নয়তো দা’য়ে কুপিয়ে মারল। এক্ষেত্রে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে অর্থাৎ তার ছেলের প্রতিনিধি হিসেবে সেই মেয়ে উপনীত হয় এবং অবিকল পুরুষেরই মতো অত্যাচার করে নারীকে। ঠিক একইভাবে সেই মেয়ে যখন অন্য এক ছেলের শাশুড়ি তখন ছেলে-জামাই-এর ওপর সে বড় নম্র, সুশীলা, সুভদ্র, হাসিমুখো, পাতে তুলে দিচ্ছে মাছের মুড়ো, আস্ত মুরগি, চিতল মাছের কোপ্তা। কারণ সে তখন তার মেয়ের পক্ষ, মেয়ে মানেই সহায়হীন দুর্বল, ন্যুব্জ, বিজিত।
এ ছাড়া আরও একটি কারণে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়, সে হল ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। এটি একটি রোগ। এই রোগে অধিকাংশ মেয়েই ভোগে। মেয়েদের ‘ইনফিরিওর’ করে রাখা সমাজের যেন নৈতিক দায়িত্ব। মেয়েরা ‘ইনফিরিওর’ না হলে, অধিকাংশ মানুষই ভাবে যে, সংসার টেকে না। তাই বিয়ে করতে হলে দৈর্ঘ্যে কম, প্রস্থে কম, বিদ্যায় কম, বুদ্ধিতে কম, এমন মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসে ঘর ব্যালেন্স করা হয়। এতে করে সংসারের মূল উপার্জনের দায়িত্বের মতো, যে-কোনও সিদ্ধান্ত এবং গুরুদায়িত্ব একা ছেলেকেই বহন করতে হয়। এ অবশ্য সুপিরিওর হবারও একটি চমৎকার কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে সব ছেলেই অনায়াসে সুপিরিওর বনে কিন্তু মেয়েরা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স রোগে মুহুর্মুহু আক্রান্ত হয়।
এই কমপ্লেক্স থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। ভয়ংকর ঈর্ষা। ‘গৃহবধূ’ ঈর্ষা করে চাকরিজীবী মেয়েকে, স্বামী দ্বারা নির্যাতিত মেয়ে ঈর্ষা করে স্বামীকে তালাক দিয়ে চলে আসা ব্যক্তিত্বশালী মেয়েকে, নিচু ক্লাস অবধি পড়া মেয়ে ঈর্ষা করে বিদুষী মেয়েকে; অক্ষমতার এই ক্রোধ কী ভয়ংকর হিংসার রূপ নেয় তা ওই হিংসার অনলে একবার না পুড়লে বোঝা যাবে না।
শিক্ষিত মেয়েরা হাতে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার বড়াই করে। ‘শিক্ষা’ কোনও অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় অর্জিত হয় না। মেয়েরা, কিছু মেয়েরা, পরীক্ষায় পাস করছে বটে, শিক্ষিত হচ্ছে না। ‘শিক্ষিত’ হওয়া অন্য জিনিস। শিক্ষিত হলে মানুষ ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে না, সেই কমপ্লেক্স থেকে হিংসার আগুনে সেও পোড়ে না, অন্যদেরও পোড়ায় না।
লোকে এও বলে, ‘মেয়েরা মেয়েদের যত হিংসা করে, ছেলেরা তত করে না। মেয়েদের মধ্যে নীচতা, হীনতা, কূটকচাল, হিংসে, লোভ ইত্যাদি বেশি। মেয়েরাই মেয়েদের সম্ভ্রম নষ্ট করে, মেয়েরাই মেয়েদের অগ্রসর ইচ্ছের গলা টিপে ধরে, মেয়েরাই মেয়েদের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি।’ এই ক্ষতি কিন্তু একটি অশিক্ষিত, নির্বোধ মেয়ে যতটা করে, তার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি করে অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত (!) বুদ্ধিমান মেয়েরা; এই শিক্ষিতরা যদি একবার কমপ্লেক্সে ভোগে, সে বড় মারাত্মক ভোগা, তাদের দূষিত দীর্ঘশ্বাসে চারপাশ সংক্রামিত হয়; তাদের ধ্বংসযজ্ঞে মেয়েরাই সুযোগ্য বলি হিসেবে ধৃত হয়।
আমার বড় করুণা হয়। আহা নারী! আহা হতভাগ্য নারী! লেখাপড়া করে ‘বুদ্ধি’ হবে বলে তাকে লেখাপড়াই শেখানো হয় না, আর লেখাপড়া শিখে যাদের ‘বুদ্ধি’ হয়েছে, তারা এমনই হতভাগ্য যে, নিজেদের বুদ্ধি অপব্যবহার তারা এভাবেই করে যে, দুর্বলের ওপর তারা খড়্গহস্ত হয়, তারা অসহায়কে দাঁত খিঁচোয়, তারা দুর্গতদের ভাত কেড়ে নেয় এবং নিগৃহীতদের গালগাল করে। যে ‘বুদ্ধি’ দ্বারা মানুষের ক্ষতি হয়, নারীর যে বুদ্ধি আরেক নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে—আমি তাকে বুদ্ধি বলি না। বলি- ছোবল, বিষধর সাপের ছোবল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন