তসলিমা নাসরিন
আমরা কেবল স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে সর্বনাশ দেখি মানুষের। মানুষের সর্বনাশে আমাদের কিছু যায় আসে না। বরং কারও সর্বনাশ হলে আমরা তুড়ি বাজিয়ে হেসে উঠি। আমাদের জন্য এখন ভাবা অসম্ভব হয়ে গেছে যে, কেউ খেতে না পেলে আমরা তাকে খাবার দেব, কারও বস্ত্র বা বাসস্থানের অভাব হলে তাকে বস্ত্র বা বাসস্থান দেব। যদি কেউ কারও একটু-আধটু উপকার করে সে কেবল স্বার্থের কারণে। কেউ যদি কারও জন্য চোখে জলও ফেলে, সে স্বার্থের কারণে। স্বার্থ ছাড়া কেউ দু’পা এগোয় না, পেছোয় না, স্বার্থ ছাড়া কেউ কাঁদে না, হাসেও না।
চোখের সামনে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ। চোখের সামনে মানুষের চোখ উপড়ে নিচ্ছে মানুষ, চোখের সামনে ধর্ষণ, চোখের সামনে অবাধ লুটপাট, অপহরণ, ছিনতাই—তবু মানুষ নিরুত্তাপ, নির্লিপ্ত। মানুষ কী করে এত নির্লিপ্ত হয়? জানি না। তাই এখন মন বড় বিমর্ষ থাকে।
সেদিন এক সুসংবাদ শুনে সারাদিন আমার বড় মন ভাল ছিল। সুসংবাদটি এই—এক বিকেলে বস্ত্রমেলার গেটের কাছে কোনও এক মহিলার হাতব্যাগ, গলার চেইন ইত্যাদি ছিনতাই করছিল কিছু ছেলে। আজরা জ্যাবিন নামের এক মেয়ে ঘটনাটি দেখে ছিনতাইকারীদের আক্রমণ করেন। তিনি এই নির্মম একটি দৃশ্যের প্রতিবাদ করেছেন, তিনি কেড়ে নিতে পেরেছেন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ছিনতাই হওয়া জিনিস। সন্ত্রাসীদের হাতে ছিল ছোরা, আজরা জ্যাবিন এই ছোরার আঘাতে আহতও হয়েছেন। তিনি আহত না হয়ে নিহতও হতে পারতেন। নিহত হবার আশঙ্কা নিশ্চয় ছিল। আজকাল পথেঘাটে অকস্মাৎ নিহত হওয়া এমন কোনও বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু এই যে তিনি সব আশঙ্কা তুচ্ছ করে এগিয়ে গেলেন একজন বিপন্নকে সাহায্য করতে, এ-রকম ক’জন আসে, ক’জন বুক পেতে এগিয়ে যায় অন্যের বিপদে! পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল, দাঁড়িয়ে ছিল অগণন দর্শক, কেবল জ্যাবিন এগিয়ে গেলেন। আমি তাঁর ‘এগিয়ে যাওয়া’র দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। এ-রকম এগিয়ে যাবার মন সবার হয় না। এ-রকম এগিয়ে যাবার সাহস বা সততা সবার থাকে না। ঘরে-বাইরে লক্ষ লক্ষ অন্যায় ঘটে, কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে না, যারা আসে, তারা আহত হয়, তারা নিন্দিত হয়, তারা নিগৃহীত, নির্যাতিত হয়। এখন চারদিকে অন্যায়েরই জয়জয়কার। এখন দেশে অন্যায়েরই রাজত্ব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছে যে মানুষ, তাঁকে অভিনন্দন জানাই, তাঁকে আমার সবটুকু ভালবাসা নিবেদন করি।
২
গৌরীরানি দাস নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এক সপ্তাহ আগে পরিচালকের গাড়ির ড্রাইভার, অফিসের পিয়োন এবং তাদের আরও ক’জন সঙ্গী দ্বারা ধর্ষিতা হয়। সে তার কর্মস্থল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসেছিল তার বকেয়া বেতনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে। তখন এই ধর্ষকদের দৃষ্টি পড়ে গৌরীর শরীরে। গৌরী কি খুব গৌরী ছিল, তাই এই অত্যাচার? গৌরী কি বড় একা ছিল, তাই এ নির্যাতন? নাকি গৌরী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, দরিদ্র, নাকি গৌরী সংখ্যালঘুদের একজন—তাকে ছ’সাত অথবা দশ-বারোজন লোলুপ লুম্পেন উপর্যুপরি ধর্ষণ করে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হবার কারণ নেই?
এই সব ছোটখাট অন্যায় নিয়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের লোকেরা মোটে ব্যস্ত হয় না। সম্ভবত ধর্ষণ নামক ঘটনাটি এখন আর অন্যায় বা অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে না। ধর্ষণ যেহেতু নারীর ওপর এক ধরনের আক্রমণ, তাই এটিকে হয়তো অন্যায় বলা যায় না। কারণ নারীর ওপর নানা রকম অন্যায়ের খেলা চলে সমাজে, এই অন্যায়গুলো অত্যন্ত সাদরে গৃহীত হয়। যেহেতু কোনও ধর্ম বলেনি নারীকে মর্যাদা দিতে, যেহেতু সমাজের কর্তাব্যক্তিরা বলেনি নারীকে মূল্য দিতে, যেহেতু রাষ্ট্রনায়ক বা নায়িকারা নারীকে মানুষের সমান সম্মান দেবার ব্যবস্থা করেনি তাই গৌরীরানিকে ধর্ষিতা হতে হয় দিনের আলোয়, ধর্ষিতা হতে হয় যখন সে তার শ্রম এবং পারিশ্রমিকের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বেরোয়। না, শুধু ঘরের ভেতরে বন্দি থাকলেই যে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তা নয়। ঘরের ভেতরের নারীও নিরন্তর ধর্ষিতা হচ্ছে, ঘরের বাইরের নারীও ধর্ষিতা হয় পথে বা কর্মস্থলে, কর্মস্থলে বা মহাপরিচালকের অধিদপ্তরে। কোথায় নিরাপত্তা নারীর? কোথায় গিয়ে দাঁড়ালে নারীর আশঙ্কা নেই ধর্ষিতা হবার, এই পৃথিবীর কোথায় সেই স্থান?
আমাদের সমাজে আজ যে-কোনও নারীই গৌরীরানি। যে-কোনও নারীর জন্য অপেক্ষা করছে অপমান, অপেক্ষা করছে অসভ্য পুরুষের কালো থাবা। গৌরীরানির মতো অত্যাচারিত অনেকেই
আজরা জ্যাবিন নামের এক ম্যাজিশিয়ান মেয়ে কোনও এক নারীর পক্ষে একা দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা, নারীরা সকলেই কি নারীর ওপর আক্রমণকে এমন দু’হাতে রোধ করতে পারি না? পারি। আমরাও সেই সাহসী মেয়ের মতো এগিয়ে আসতে পারি মঙ্গলকামনায়। আমরা এগিয়ে আসতে পারি ধর্ষণের বিরুদ্ধে, যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। দুষ্ট ক্ষতগুলো দিন দিন বেড়ে উঠছে। আমরা, নারীরা একবার কেন প্রচণ্ড এক শক্তি হয়ে উঠি না সকল অসত্যের বিপক্ষে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন