ইসলামি থাবা

তসলিমা নাসরিন

ঠিক কবে থেকে ওঁরা এই নিয়মটি মানছেন, আমি সনতারিখ জানি না। লক্ষ করে বেশ অবাক হয়েছি, এতে ওঁদের এবং অন্যান্যদের কী লাভ হচ্ছে আদৌ, নাকি নিয়মটি তৈরি হয়েছে কর্তাদের সন্তুষ্টির জন্য? কর্তারা সন্তুষ্ট হলে অবশ্য লাভের কোনও কমতি হয় না।

টেলিভিশনে খবর পড়তে বা ঘোষণা করতে যে মেয়েরাই আসেন, ক্যামেরার সামনে ওঁদের শাড়ির আঁচল সামনের দিকে টেনে বসতে হয়। আগে এই নিয়মটি ছিল না, এখন আঁচল টেনে রাখবার কারণ কী? এক সময় রোজার মাসে মাথায় আঁচল তুলে ঘোষিকা বলতেন—শুরু হচ্ছে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘রংবেরং’। মাথা থেকে নেমে আঁচল এখন ডান বাহু ঢেকে ফেলেছে। তবু তো ঢেকেছে কিছু, কিছু না ঢাকলে নাকি অনেকের স্বস্তি নেই।

প্রথম ভেবেছিলাম আঁচলের কারুকাজ দেখাবার জন্য বুঝি খুব ফ্যাশন-সচেতন কেউ কেউ আঁচল সামনে এনেছেন, পরে দেখি সবাই—সবাই এই একই কাজ করছেন। সবাই যখন করছেন তখন নিশ্চয় এটি আর শখ থেকে নয়, আদেশ থেকে, কর্তৃপক্ষের আদেশ। শখ থেকে একই পদ্ধতি দীর্ঘকাল অনুসরণ করে না কেউ। কিন্তু কেন এই আদেশ? আঁচল সামনে না আনলে, যা এতকাল ছিল, কী অসুবিধে হয়? কার অসুবিধে? অসুবিধে নিশ্চয়ই মেয়েদের নয়, কারণ খবর বা ঘোষণার পরই ওঁরা আঁচল সরিয়ে ফেলেন সামনে থেকে। তবে এই কৃত্রিম সাজের কারণ কী? আমি কি তবে এই ধরে নেব যে, ইচ্ছে নেই, তবু এই কাজে ওঁরা বাধ্য হচ্ছেন?

কেন এই অদ্ভুত নিয়মটি (আমি নিয়মটিকে অদ্ভুতই বলব যেহেতু আড়ালে এটি আর পালন হয় না, কেবল প্রদর্শনের বেলায় এটি সুচারু, সুন্দর) মেয়েদের গায়ে চাপানো হল? সঙ্গে তো খবরপাঠক বা ঘোষক-ছেলে ছিলেন, ওঁদের গায়ে তো নতুন করে জড়াতে হয়নি কিছু!

নাকি জড়ালে মেয়েদের গায়েই জড়াতে হয় কাপড়চোপড়, চাপালে মেয়েদের ওপরই চাপাতে হয় নিয়ম? অনেকে বলছে এ নাকি ইসলামি নিয়ম। আঁচলে চুল ঢাকলে যেহেতু চুলের খোঁপা, বা চুলের নানা রকম কায়দাকানুন ঢাকা পড়ে যায়— তাই মেয়েরা চুল ঢাকতে রাজি নন। দুই নেত্রী ঢাকছেন তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থে, টেলিভিশনের মেয়েদের সে-রকম কোনও স্বার্থ নেই। অতঃপর আঁচলটি মাথায় না উঠে কাঁধে উঠেছে। অগত্যা এটিই ওরা পালন করছেন। যে দেশে ইসলামের জয়জয়কার, সে দেশে কিছুটা রাখঢাকের দরকার আছে, আর কোথাও না থাক, মেয়েমানুষদের গা-গতর না ঢেকে রাখলে পুরুষমানুষেরা তো যেখানে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সম্ভবত কামুক পুরুষদের সামাল দেওয়ার জন্য ইসলামের অধিকাংশ বিধিবিধান তৈরি হয়েছে।

যদি ইসলামকে মানতেই হয়, তবে সবটুকুই মানতে হয়। এ-রকমই নিয়ম। সেক্ষেত্রে টেলিভিশনের পরদায় মেয়েদের ছবি ভেসে ওঠাই তো অত্যন্ত অন্যায়। মেয়েরা পরদা পুশিদা মতো থাকবে, ঘরের বার হবে না, রামপুরায় যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। বিজ্ঞাপনে মেয়েদের হাসিঠাট্টা বন্ধ হবে, নাটকে নারীচরিত্র থাকবে না, মেয়েরা গান গাইবে না, নাচবে না। ইসলামকে মানতে হলে উচিত সবটুকু মানা, আধাআধি মানবার তো কোনও অর্থ হয় না। শুধু সেটুকু বা কেন মানা হয়, যেটুকুতে পুরুষের কোনও কর্তব্য নেই, কর্তব্য কেবল মেয়েদের? ইসলামের আইন এদেশে কেবল নারীর ওপরই কেন অকাতর বর্ষিত হয়?

উত্তরাধিকার আইনে নারীকে বঞ্চিত করেছে ইসলাম, পুত্রসন্তানের জন্য রেখেছে দু’ভাগ, কন্যাসন্তানের জন্য এক ভাগ। এই অসভ্য উত্তরাধিকার আইনটি এই দেশে প্রচলিত। বিবাহ আইনে মেয়েরা দেনমোহরের শর্তে পুরুষের কাছে একরকম বিক্রি হয়, পুরুষেরা স্ত্রীদের খাওয়াপরা জোগাবে আর পুরুষের নির্দেশমতো স্ত্রীরা কাজকর্ম করবে, বাড়ির পোষা কুকুরকে যেমন মনিবেরা সময়মতো খাবার দেয়, বিনিময়ে বিশ্বস্ত কুকুরটি বাড়ি পাহারা দেয়, এ অনেকটা সে-রকম। পুরুষেরা চার বিয়ে করবার অনুমতি পায়, এক ঘরে চার বউ নিয়ে বিবাহিত জীবনযাপন করবার অধিকার কেবল পুরুষেরই আছে।

কেবল নারীকে অবদমনের ক্ষেত্রেই ইসলামের নিয়ম চালু হয়েছে দেশে। বাকি নিয়ম কোথায়, চুরি করবার হাতকাটা আইন? ব্যভিচার করলে পাথর ছোড়া বা বেত মারা? অক্টোপাসের মতো দুর্নীতি তার শত বাহু মেলে বিকশিত হচ্ছে। কই, কোনও শাস্তির নিয়ম তো নেই! নাকি পুরুষেরা দুর্নীতিতে অভ্যস্ত বলে পুরুষ-কর্তারা শাস্তির নিয়মটি বহাল করতে চান না! কেবল টুপি-পাঞ্জাবি পরে মসজিদে দৌড়োলেই গা থেকে পাপ খসে পড়ে!

যে-কোনও সচেতন মানুষই এ-কথা খুব ভাল করেই জানেন—ইসলাম হচ্ছে এক ধরনের বর্ম। পাপী ও পতিত মানুষের বর্ম, অত্যাচারী ও ব্যভিচারী মানুষের বর্ম। এই বর্মটি এ-দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। যেহেতু রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সমাজ ও সমাজের মানুষ, তাই বর্মটি ব্যবহার হতে থাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, রেডিয়ো, টেলিভিশনে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ মেয়েদের না নাচালে ব্যাবসা করতে পারবে না, তাই নাচাচ্ছে, আর সে সঙ্গে মেয়েদের গায়ে ইসলামের সুগন্ধ ছিটিয়ে পাকপবিত্র করাও হচ্ছে। মেয়ে ছাড়া একদিকে চলেও না, অন্যদিকে ইসলাম ছাড়াও চলে না। তাই মেয়েদের কিছু সৌন্দর্য, রংঢং, সাজগোজ, নাচগান যেমন প্রয়োজন, ইসলামও তেমন কিছুটা হলেও প্রয়োজন। তাই কিছু ইসলাম এবং কিছু নারী উপস্থিত করে টেলিভিশনওয়ালারা ভীষণ এক জগাখিচুড়ি করছেন। না পারছেন নারী বর্জন করতে, না পারছেন ইসলাম। এতে হচ্ছে কী, কোনওটারই স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না। নারী ঠিক মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, কারণ, যখন-তখন তার ওপর এটা-সেটা চাপানো হচ্ছে, সে নিজের রুচি এবং পছন্দমতো যাপন করতে পারছে না জীবন, তার ব্যক্তিস্বাধীনতা বারবার ব্যাহত হচ্ছে। আর ইসলামেরও নিশ্চয় ক্ষতি হচ্ছে আধাআধি ব্যবহারে। হলে সবটুকু হবে, না হলে কিছুই নয়। ইসলাম যদি জেঁকে বসতে না পারে তবে আর বসা কেন! থাবা দিলে পাঁচ আঙুলে দেওয়াই ভাল, দু আঙুলে থাবা জমে না।

ইসলামকে তাঁরা সময়-সুযোগমতো দুর্বলের ওপর চাপাতে চান, ইসলাম ধৰ্ম বটে, বর্মও কম নয়। নেতারা এই বর্ম দিয়ে ঠেকিয়ে রাখেন অসততা, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষও নিশ্চয় এই বর্ম দিয়ে ঠেকিয়ে রাখেন নিজেদের অসৎ বাণিজ্য। ইসলাম দুর্বলের ওপরই বর্ষিত হয় বেশি। এই দুর্বলেরা, এই নির্বোধ মেয়েমানুষেরা যদি একবার এই চাপানো নিয়ম থেকে নিজেদের মুক্ত করেন তবে তাঁদের ব্যক্তিত্বের কাছে সবিনয় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে শুধু আমি কেন, সচেতন অনেকেই চাইবেন।

আমি বলছি না ডান কাঁধ থেকে আঁচল ফেলে দিয়ে আপনারা বিদ্রোহ করুন। আমি কেবল এটুকুই অনুরোধ করছি, আঁচল যদি আপনাদের টানতে ইচ্ছে হয় টানুন। যদি টানতে ইচ্ছে না হয়, টানবেন না। আপনাদের ইচ্ছের মর্যাদাটুকু আপনারা দিন। অন্যের ইচ্ছেয় নয়, নিজের ইচ্ছেয় জীবনযাপন করে দেখুন, জীবন আপনাকে স্বাগত জানাবে। পথ হয়তো বন্ধুর, ঝোপঝাড়, সাপখোপ হয়তো বেশি, তবু জয় আমাদের হবেই। ইচ্ছে প্রবল হলে কোনও অকল্যাণের সাধ্য নেই গন্তব্যকে আড়াল করে।

সকল অধ্যায়

১. ‘আর রেখ না আঁধারে আমায় দেখতে দাও’
২. আশায় আশায় থাকি
৩. আমাদের বুদ্ধিজীবীরা
৪. আগ্রাসন
৫. নগর-যাপন
৬. ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
৭. ‘কার নিন্দা কর তুমি। মাথা কর নত। এ আমার এ তোমার পাপ।’
৮. ‘দুঃখরাতের গান’
৯. বৃত্ত
১০. নাগরিক খাঁচা
১১. ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’
১২. সকল সন্তানই বৈধ
১৩. ‘জারজ’ শব্দের বিলুপ্তি চাই
১৪. নারীভোজ
১৫. ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’
১৬. ‘মুক্ত করো ভয়’
১৭. ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’
১৮. ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’
১৯. ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’
২০. ‘খসিল কি আপন পুরনো পরিচয়?’
২১. ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’
২২. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী
২৩. ‘বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’
২৪. নাস্তিক্যবাদ
২৫. নিজের পায়ে নিজের কুড়োল
২৬. গোটা দুই ‘পতিত’, ছ’সাতটি ‘রক্ষিত’ হলে জমত বেশ
২৭. খারাপ মেয়ের গল্প
২৮. শব্দবাণবিদ্ধ নারী
২৯. থ্রি চিয়ার্স ফর হাসিবা
৩০. ‘বড় বিস্ময় লাগে’
৩১. ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে’
৩২. ‘মন কেমন করে’
৩৩. বিজ্ঞাপনের নারী
৩৪. ‘কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে…’
৩৫. ইসলামি থাবা
৩৬. নিজের গোলা শূন্য
৩৭. ‘নপুংসক’ বিষয়ক
৩৮. ‘MEGALOMANIA, THY NAME IS MAN’
৩৯. ধর্মের কাজ ধর্ম করেছে
৪০. কন্যাজন্মের প্রায়শ্চিত্ত
৪১. অবদমন
৪২. গিনিপিগ
৪৩. হিন্দুর উত্তরাধিকার
৪৪. বাঙালি মুসলমানের দুর্মতি ও দুর্গতি
৪৫. রাজনীতির ফাঁকফোকর
৪৬. নারীর নামপরিচয়
৪৭. কাজ
৪৮. পাকিস্তান-প্রীতি, অলৌকিকতা এবং অভিজ্ঞতা
৪৯. কবরের খবর
৫০. যদি সত্য কথা বলি
৫১. সংসার-চিতা
৫২. অনভ্যাস
৫৩. যে-কোনও নারীই আজ নুরজাহান
৫৪. ঘটনা-দুর্ঘটনা
৫৫. ‘উই শ্যাল ওভারকাম’
৫৬. ‘ভাবনার ভাস্কর্য’
৫৭. ‘একলা চলো রে…’
৫৮. অতঃপর নারী হবে মসজিদের ইমাম
৫৯. ‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি…’
৬০. আইন বদল
৬১. প্ৰথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন