তসলিমা নাসরিন
বছর তিনেক আগে একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেলে বাংলা অ্যাকাডেমির গেটের ভিড় সম্পর্কে এক পত্রিকায় লিখেছিলাম—“শরীরে শাড়ি নেই, ব্লাউজ ছেঁড়া, এই অবস্থায় সেদিন ভিড় থেকে বেরিয়েছে একুশ-বাইশ বছরের একটি মেয়ে; এইমাত্র ধর্ষিতা হয়ে অবিন্যস্ত পায়ে হেঁটে-আসা নারীর মতো তাকে মনে হয়—দেখে আমি আমূল শিহরিত হই, এই যদি একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেল, এই যদি হয় ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন, তবে যারা এই বিকৃত যৌনআনন্দ-শেষে ভালমানুষের মতো মিশে যায় বইমেলায়, বই দেখে, কেনে, গান গায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো – ধিক সেই বাঙালি, ধিক সেই মুখে একুশে ফেব্রুয়ারির গান।” আরও লিখেছিলাম—“এমন মেয়ে নেই, যে মেয়ে ভিড় পার হয়ে মেলায় ঢুকছে অথচ তার নারীঅঙ্গে কারও অসৎ থাবা পড়েনি। আমি অনেক মেয়েকে ভিড়ের ভয়ে ফিরে যেতে দেখেছি, তারা ফিরে যায় কারণ জানে নিগ্রহের প্রকৃতি ওখানে কীরকম। যারা ভিড় পেরিয়ে যায়, তারা কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, কেউ লজ্জায় নত হয়, যেন সমস্ত গ্লানি নারীরই, যেন নারীঅঙ্গ ধারণের পাপ নারীর, যেন নারীজন্মের প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই হয়, একুশের চেতনায় উদ্দীপিত পুরুষ এভাবেই সহযাত্রী নারীকে স্বাগত জানায়।”
এ-বছর ছাত্রী ব্রিগেড নেমেছে অ্যাকাডেমির মাঠে, বইমেলার যাবতীয় দুর্ঘটনা ছাত্রী বিগ্রেড দ্বারা প্রতিহত হবে। বইমেলা ব্যবস্থাপকদের এই অভিনব উদ্যোগের প্রশংসা করছি। ছাত্রী ব্রিগেডের দু’একজনকে দেখেছি সাদা অ্যাপ্রন গায়ে ঘোরাফেরা করতে। ওরা মাঠে এ-অবধি কতটুকু সন্ত্রাস দমন করেছে আমি জানি না। এ-অবধি নারীর ওপর ছুড়ে দেওয়া ক’টি অশ্লীল বাক্যের প্রতিবাদ করেছে, নারীর ওপর এগিয়ে আসা ক’টি চতুর আঙুল ওরা সরিয়েছে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখিনি। কেবল ছাত্রী ব্রিগেডের কথা উঠলেই দেখি দল বেঁধে পুরুষেরা ছাত্রী ব্রিগেড দেখতে যায়। যেন অদ্ভুত কোনও প্রাণী এসেছে মেলায়; দুটো হাত, দুটো পা, নাক, চোখ, ঠোঁটওয়ালা অবিকল মানুষের মতো প্ৰাণী।
বইমেলায় বইয়ের প্রসঙ্গ নেই, প্রসঙ্গ ছাত্রী ব্রিগেডের। ছাত্রী ব্রিগেডের চারপাশে ভিড় করছে এই প্রজন্মের প্রাণবান সন্তানেরা। তারা শিস দিচ্ছে ওদেরই দিকে, তারা চোখ টিপছে ওদেরই দিকে, তারা অশ্লীল আস্ফালন করে সভ্যতার খেলা দেখাচ্ছে। এখন নিরাপত্তার কারণেই নাকি সন্ধে ছ’টার সময় ছাত্রী ব্রিগেডের চলে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকে বলেছে, যাদের নিজেদেরই নিরাপত্তা নেই, তারা কী করে অন্যকে নিরাপত্তা দেবে? অনেকে বলছে, মেলার এই ‘চিড়িয়া’ দেখতেই লোকে ভিড় জমাচ্ছে বেশি। লোকে তো কত কথাই বলে, বলুক। এই সমাজের সব নারীই তো চিড়িয়া। যে নারীকে পুরুষেরা অপদস্থ করছে, সে নারীও চিড়িয়া; আর নারীকে সকল অপমান থেকে রক্ষা করতে চায় যে নারী; সেও চিড়িয়া। এইসব চিড়িয়ার দিকে, এইসব নারীর দিকে পুরুষেরা থুতু ছুড়ছে, ঢিল ছুড়ছে, ছুড়ে দিচ্ছে যৌনগন্ধময় উচ্চারণ।
এমন বিরুদ্ধ পরিবেশে ছাত্রী ব্রিগেডের মাঠ-বিচরণ, এমন বিরুদ্ধ পরিবেশে ছাত্রী ব্রিগেডের দুর্বিনীত চলাচল আমাকে প্রাণিত করে। ওদের পক্ষে কোনও অশ্লীলতার মূল ধরে নাড়া দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, ওদের পক্ষে অসভ্য পুরুষের জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলা হয়তো সম্ভব নয়, তবু এই যে ওরা দাঁড়িয়েছে সুন্দরের বাগানে অসুন্দরের উৎপাতের বিরুদ্ধে—এ তো কিছু কম নয়; এ তো কম অর্জন নয়, যখন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর তীব্র করবার জন্য এক-এক করে মিছিলে নেমে আসে অনেকে। যদিও এই দেশের জন্য, লালন করা একটি সংস্কৃতির জন্য, এ বড় লজ্জার কথা যে, বাঙালি যখন পুরো এক ফেব্রুয়ারি উৎসব করে নিজের ভাষার আনন্দে ও গৌরবে, বাঙালি যখন নিজের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির আলোয় নিজেকে আলোকিত করবার পথে অগ্রসর হয়, তখন সেই মহতী উৎসবে ব্রিগেড় নামাতে হয় অশ্লীলতা রোধ করতে। এত সৃজন ও শ্লীলতার মধ্যে কিছু অসভ্য বাঙালি নোংরা করতে আসে সব আয়োজন। ছাত্রী ব্রিগেড তাদের অসভ্যতা রোধ করতে দাঁড়িয়েছে। বাঙালি সভ্য হয়েছে যত, অসভ্যও কিছু কম হয়নি। এও কিছু কম লজ্জার কথা নয়।
তবু অভিনন্দন ছাত্রী ব্রিগেডকে, অভিনন্দন মেলা পরিচালনা কমিটিকে। নারী আজ নারীর স্বার্থে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। শুধু মেলা কেন, মেলা ছাড়া আর যত নির্যাতন হয়, আর যত নিষ্পেষণ চলে নারীর ওপর, সে-সব ফেরাবে কারা? সে-সব ফেরাবার জন্য রাষ্ট্র কি কোনও ব্রিগেড নামাবে না ঘরে এবং ঘরের বাইরে?
কে ফেরাবে তাবৎ অনাচার? কে ফেরাবে অগণন ধর্ষণ, কে ফেরাবে অপহরণ, অশ্লীলতা? কে ফেরাবে নারীকে অবদমনের অসংখ্য শৃঙ্খল? বইমেলার শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের ভিড়েও নারীর জন্য নিরাপত্তা দরকার হয়; তবে পুরো রাষ্ট্রের মূর্খ, ধর্মান্ধ ও অশিক্ষিত মানুষের ভিড়ে নারীর নিরাপত্তা কি সামান্যও কিছু আছে, নাকি থাকে?
নেই। নারী জন্মাবার পরই পুরুষের তৈরি নানা নিয়ম ও নীতির কামড় খেয়ে বাঁচে। নারীর শরীর রক্তাক্ত, নারীর হৃদয় রক্তাক্ত, নারী যে পথে হাঁটে, সে পথে কাঁটা বিছানো। নারী তার গতিকে যত দীর্ঘ ও বেগবান করে, তত সে রক্তাক্ত হয়, তত তার অস্তিত্বে ক্ষত জমা হয়, তত সে আঘাতে আক্রান্ত হয়।
নিরাপত্তা দরকার হয় দুর্বল মানুষের জন্য, শিশুর জন্য, পঙ্গুর জন্য এবং নারীর জন্য। মেলায় ব্রিগেড নেমে নারীর দুর্বলতা কিছু কাটাচ্ছে কি না, অথবা নারী যে দুর্বল, সে-কথা প্রমাণ করবার জন্যই এই ব্যবস্থা কি না আমি জানি না। আমি কেবল উদ্দীপিত হচ্ছি এই ভেবে যে, অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যত ক্ষীণ হোক, মৃদু হোক, তবু সেই প্রতিবাদ এই একচিলতে মেলার মিছিলে পথ চলতে চলতে রাজপথেও একদিন উঠবে নিশ্চয়ই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন