তসলিমা নাসরিন
চিত্রকলায় এ-যাবৎ নারীঅঙ্গ যত ব্যবহৃত হয়েছে, পুরুষঅঙ্গ কি তার শতভাগের একভাগও ব্যবহৃত হয়েছে? এর উত্তর আমি একবাক্যে বলব, না।
নারীর স্তন, কোমর, নিতম্ব, ঊরু, পা’র প্রতি চিত্রকরদের যে প্রচণ্ড আকর্ষণ তা পুরুষের যৌনাঙ্গ, হাত, পা, নিতম্বের প্রতি নেই। এর প্রধান কারণ কি এই যে, চিত্রকররা সাধারণত পুরুষ হয়, নারী নয়! আর চিত্রকর পুরুষ বলেই বিপরীত লিঙ্গ নারীঅঙ্গের প্রতি তাদের স্বাভাবিক এক আকর্ষণ জন্মায়। তাই তারা নারীঅঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে! আমি অনেক নারী-চিত্রকরের কাজ দেখেছি। ওরাও নারীকে পুরুষের চোখে দেখে, পুরুষের শেখানো তুলিতে ওরা নারীকে আঁকে। আমি এমন নারী-চিত্রকর দেখতে চাই—যে চিত্রকর পুরুষের সুঠাম বাহু, পুরুষের নিতম্ব, ঊরু ও পুরুষের যৌনাঙ্গের ছবি আঁকবে। কারণ পুরুষঅঙ্গের প্রতি নারীর স্বাভাবিক এক আকর্ষণ আছেই। পুরুষের শরীর নানান রঙের খেলায় নারী-দর্শকের পিপাসাও মেটায়। শুধু রঙে ও রেখায় নয়, পুরুষের ভাস্কর্যও কম আকর্ষণীয় নয়—অন্তত নারীর চোখে।
নারী-ভাস্করকে দেখেছি নারীর স্তন গড়তে, তবে পুরুষাঙ্গ গড়বে কারা? পুরুষ যদি ভার নিয়েছে নারীকে গড়ে তোলবার তবে নারী নিশ্চয় দায়িত্ব নিতে পারে পুরুষের মূর্তি গড়বার। আমরা নারীরা পুরুষের সুঠাম, সুন্দর শরীর দেখতে চাই চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে। আমরা আমোদিত হতে চাই পুরুষ-শরীর দেখে। আমরা তৃষ্ণার্ত হতে চাই, আহ্লাদিত হতে চাই। কয়েক শতক ধরে পুরুষ-শিল্পীদের ঘরে নারী কেবল মডেল হন। তাঁরা উলঙ্গ বসে থাকেন সামনে আর শিল্পীরা তাঁদের ছবি আঁকেন অথবা মূর্তি গড়েন। বিশ্বখ্যাত ভাস্কর রদ্যা তাঁর প্রায় কোনও নারী-মডেলকেই ভোগ না করে ছাড়েননি। আমি কোনও পুরুষ-মডেলের নাম আজ অবধি শুনিনি। পুরুষ-মডেল নারী-শিল্পীদের সামনে উলঙ্গ হয়ে বসবেন, নারী-শিল্পীরা তাঁদের ছবি আঁকবেন, মূর্তি গড়বেন এবং সবশেষে পুরুষ-মডেলদের তাঁরা ভোগ করবেন—এই ঘটনা কেন জগতে ঘটছে না, যেখানে নারীরা চিত্রকর ও ভাস্কর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত?
সেদিন এক চিত্রপ্রদর্শনীতে দেখি, এখানকার নারী-চিত্রকররা ছবি এঁকেছেন কিছু মেয়ের, ওরা আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে, ওরা হেসে হেসে ঢলে পড়ছে একজন আরেকজনের গায়ে, ওরা সাজছে, বাঁশঝাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়। কার অপেক্ষায়? নিশ্চয় পুরুষের অপেক্ষায়।
ছবির মেয়েরা যখন সাজে, আমাদের বুঝতে হবে যে এই সাজগোজ করা অর্থাৎ মুখে স্নো-পাউডার মাখানোর উদ্দেশ্য পুরুষকে প্রলোভিত করা। পুরুষকে নিজের রূপে মুগ্ধ করানো ছাড়া নারীর সত্যিকার কোনও কাজ নেই, যা চিত্রকরের তুলিতে ফুটে ওঠে, তা নিতান্তই অকর্মণ্য সজ্জিত নারীদের অলস অপেক্ষা। পুরুষ দু’একটি যা গড়া হয়েছে, তা একেবারে ফরমায়েশি, ধরা যাক স্বোপার্জিত স্বাধীনতায় মুক্তিযোদ্ধা পুরুষ, কাজি নজরুল—যা শামিম শিকদার করেছেন।
এ ছাড়া সর্বত্র নারী, এ ছাড়া সর্বত্রই নারীমুখ, নারী-শরীরের খাঁজভাঁজ প্রদর্শন। পুরুষ-শরীরকে যদি আঁকা হয় বা গড়া হয়—তা একেবারেই বীরের প্রতীক হিসেবে। নারীকে বীরের প্রতীক নয়, বীরের সঙ্গিনী বা রূপের আড়ত হিসেবেই আঁকা হয় বা গড়া হয়। নারীকে মেধার জন্য নয়, শরীরের জন্যই মূল্য দেওয়া হয় বেশি, শুধু বেশিই বা বলি কেন, সবটুকুই।
.
শুধু কি নারী চিত্রকর বা ভাস্কর? নারী-লেখকরা কী করেন? সম্প্রতি ‘রোমেনা আফাজ’ নামের এক লেখক বলেছেন, ‘নারীর স্বাধীনতা আমি পছন্দ করি না।’নারীর স্বাধীনতা আসলে নারীরাই পছন্দ করেন না, তাঁরা নারীকে মালা, দুল, চুড়ি পরিয়ে পুরুষের যোগ্য করেন, প্রেমের যোগ্য, বিবাহের যোগ্য। তাঁরা যে করেই হোক, নারীর ‘সতীত্ব’ বজায় রাখেন। যে সতীত্বের জোরে নারী-চরিত্র উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা পায়, লোকে তাকে ধন্য ধন্য করে। মনে রাখতে হবে, এই সতীত্বের সঙ্গে সততার কোনও সম্পর্ক নেই, এই সতীত্বের অর্থ যৌনাঙ্গকে অকেজো রাখা।
আমার প্রশ্ন, কেন পুরুষ-লেখকদের দেখাদেখি নারীর এই প্রবণতা? এখানকার রিজিয়া রহমান বা সেলিনা হোসেনের লেখা পড়ে কখনও মনে হয় না এ কোনও নারীর লেখা। নারীরা দুর্বল ভাষা ও দুর্বল বিষয়-বক্তব্য নিয়ে পুরুষের অনুকরণ করেন। নারী নিজেদের এতকালের অবনমন, অবদমন, এতকালের দাসত্ব, শৃঙ্খল, সর্বনাশ কিছুই প্রকাশ করেন না, তাঁদের লেখায় কোনও ক্রোধ, কোনও প্রতিবাদ ফুটে ওঠে না। তাঁরা অবিকল ‘প্রভু পুরুষের’ মতোই সুখের গদ্য লেখেন, প্রেমের কবিতা লেখেন; তাঁরা যে সমাজের ভোগ্যবস্তু, তাঁরা যে ধর্মের এবং সমাজের উপাদেয় সামগ্রী, তাঁরা যে দাসী, তাঁরা যে পুতুল, তাঁদের সারা শরীরে যে অত্যাচারের কালো দাগ, শৃঙ্খলের দাগ—কোথায় এর প্রকাশ? নারীর লেখায় কোথায় এর সামান্য ছাপ? নেই। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে নারীই এসেছেন—তাঁরা আজও পুরুষের অনুকরণ করে ছবি আঁকছেন, ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন, কবিতা লিখছেন, উপন্যাস লিখছেন, প্রবন্ধ লিখছেন। তাঁদের দুর্দশার কথা কোথাও আঁকা নেই, তাঁদের পঙ্গুত্বের কথা কোথাও লেখা নেই। নারীর মুক্তি এবং প্রগতির কথা যা লেখা হচ্ছে বেশির ভাগই লিখছেন পুরুষেরা। অবশ্য সেই লেখায় ফাঁকিও আছে। কায়দা করে নিজেদের উদার এবং মহৎ সাজাবার এও আরেক কৌশল পুরুষের। এই কৌশল রপ্ত করলে বেশ আধুনিক প্রগতিশীল পুরুষ হিসেবে লোকের বাহবা পাওয়া যায়, আবার শিক্ষিত আধুনিক নারীদেরও পক্ষপাত জোটে। তাঁরাও সময়-সুযোগমতো এইসব পুরুষের গা ঘেঁষে রাস্তাঘাটে চলেন। শেষ অবধি কী হয়, এই পুরুষেরা উন্নত রুচির নারীদের সেই পুরনো রান্নাঘরেই পোরেন। নারীরা সেখানে চুলোয় খড়ি ঠেলেন, ভাত সেদ্ধ হল কি না পরখ করে দেখেন। আর ‘মুক্তবুদ্ধির পুরুষটি চুলে টেরি কেটে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সন্ধের আড্ডায় যান, সেখানে নারী-আন্দোলন নিয়ে তুখোড় আলোচনা জমে ওঠে।
অবশেষে আড্ডায় নারী-আন্দোলনকারী পুরুষেরা যে যার ঘরে গিয়ে স্ত্রী-ধর্ষণ করেন।
যাঁদের স্ত্রী নেই, তাঁরা অগত্যা বেশ্যা-ধর্ষণে অগ্রসর হন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন