তসলিমা নাসরিন
১
শেষ বিকেলে ঘরে একেবারেই মন টেকে না। ইচ্ছে করে বাইরে বেরোতে। গাছগাছালির না হোক, নাগরিক দরদালানের পাথুরে হাওয়াটাও তো গায়ে এসে লাগে। আর সন্ধে থেকে লোডশেডিং-এর যে প্রতাপ শুরু হয়েছে, তাতে ঘরের মধ্যে বসে থাকবার অর্থ, জ্বলন্ত চুলোর ওপর বসে থাকা। প্রায়ই বাইরে বেরিয়ে রিকশা নিই, সঙ্গে ভাই-বোন কেউ একজন থাকে। হুড খুলে রিকশাকে বলি যেতে। কোথায় যাবে তা কখনও বলি না। এদিক-ওদিক দু’ঘণ্টা ঘুরে বাড়ি ফিরে আসি।
এ শহরে হাওয়া খাওয়ার জায়গা তো কম নয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখ ছাড়া রমনা পার্কে কখনও যাইনি। সোহরোওয়ার্দি উদ্যানে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে একটি গান বা কবিতার অনুষ্ঠানে। আমার বাড়ি থেকে এই উদ্যান দুটো খুব কাছে, কিন্তু যাওয়া হয় না, শেষ বিকেলে বা সন্ধেয় এই উদ্যান দুটোয় জমে ওঠে মেয়েমানুষের হাট, এই হাটে পুরুষেরা দরদাম করে মাংস কেনে। রমনা পার্কের পেছনে সরকারের বাৎসরিক খরচ কয়েক লাখ টাকা—এর রক্ষণাবেক্ষণ করে কী লাভ দেশে পতিতাবৃত্তির প্রসার ছাড়া? আজকাল কাকরাইল মসজিদেও ধর্মলিপ্সু যুবক ও বৃদ্ধের ভিড় বাড়ছে, ফুটপাত পেরিয়ে রাস্তায় উপচে পড়ছে ওরা। ওরাও জিকির-ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁটতে বের হয় রমনায়। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে হাটে। হাটে টুপি-দাড়ি বেমানান বলে অগত্যা টুপিখানা পাঞ্জাবির পকেটে লুকোতে হয়। আমাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই। রমনায়, সোহরোওয়ার্দির হাটে মাংসের গন্ধ। ক্রিসেন্ট লেকে ইচ্ছে করে সন্ধে কাটাতে। তাও সম্ভব হয় না। বিপর্যস্ত তরুণেরা অসৎ আনন্দে এগিয়ে আসে সামনে। সবখানে বাধা, সবখানে সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র, সবখানে দূষিত বাতাস।
এই ঢাকা শহরে কোথায় গিয়ে ঘ্রাণ নিতে পারব স্নিগ্ধ সবুজের? কোথায় গেলে নিশ্বাসে পাব নির্মলতা? ঘর ছেড়ে কোথাও বেরিয়ে আনন্দ নেই, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয় রিকশায় বসেই, কোথাও নেমে দাঁড়াবার মাটি নেই, সিঁড়ি নেই, গাছের গোড়া নেই। বাচ্চাকে প্যারামবুলেটরে করে দম্পতিরা ছুটে আসে, ছোট ছোট সাইকেল নিয়ে শিশুরা খেলতে আসে বিকেলে সংসদ ভবনে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মেলা বসেছে। মেলায় ফুচকা, চটপটির হুড়োহুড়ি।
আমাকে অগত্যা ফিরতে হয় ঘরেই। ঘরের লোডশেডিং তখনও কাটে না, তবু ফিরতে হয়। কারণ রিকশাওয়ালাকে অত বেশি পরিশ্রম করাবার ইচ্ছে আমার নেই, তাকে পারিশ্রমিক দেবার ক্ষমতাও আমার কম কিনা।
২
পরিবার পরিকল্পনার দিকে সরকারের দৃষ্টি বড় সজাগ। এই খাতে বিদেশি সাহায্যও বেশ আসে। ঢাকা শহরের দোতলা বাসগুলো ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’ জাতীয় উপদেশ বিতরণ করতে করতে যায়। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশি ‘কম্বিনেশন ফাইভ’। কিন্তু দরিদ্রের কোলেকাখে তো কম প্রাণী নেই। বাড়ছেই। পুত্রলিপ্স পিতারা পুত্রসন্তান না হওয়া তক উৎপাদন বন্ধ করতে রাজি নন। তাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সরকার একবার স্লোগান দিয়েছিল—দু’টি নয়, একটি সন্তানই যথেষ্ট। একটি সন্তান পুত্র হলে যথেষ্ট হয় মানি। কন্যা হলে কোন পরিবারে তা যথেষ্ট বলে— বাংলাদেশের কটি পরিবার একে যথেষ্ট মনে করে?
যথেষ্ট মনে করবার জন্য সরকারই বা কী ব্যবস্থা নিয়েছে? যদি ব্যবস্থা নিয়েই থাকে তা কার্যকর হচ্ছে কতটুকু? আর আমাদের সমাজই বা একে যথেষ্ট মনে করবার জন্য কতটুকু যোগ্য হয়েছে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন