তসলিমা নাসরিন
১
একটি মেয়ে। বাবা মরে যাবার পর ভাইয়ের সংসারে মানুষ। ভাইটি তাকে বেচে দিয়ে গেল পতিতালয়ে। পতিতালয় থেকে মেয়েটি পালিয়ে বাঁচতে চাইল। সেটিও হতে দিল না আমাদের সাধুপুরুষেরা। রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে তাকে ধর্ষণ করল। গণধর্ষণ। মেয়েটি এখন রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। সাংবাদিকরা বিছানা ঘেরাও করে তার দুঃখের গল্প শুনছে, ক্যামেরায় ফ্লাশ জ্বলছে সারাদিন। বাঃ, কী মজা! ক্যামেরাম্যানের মজা, সাংবাদিকের মজা, পত্রিকাওয়ালার মজা, হকারের মজা এবং পাঠকেরও মজা নিশ্চয়।
‘নারী নিয়ে কিছু কেলেংকারি’ ছাপা না হলে আজকাল পত্রিকা তেমন জমে না। অনেকে, আমি লক্ষ করেছি, পত্রিকা খুলেই নারীবিষয়ক ঘটনাগুলো বেশ খুঁটিয়ে পড়ে। জানি না এতে ওরা আনন্দ পায় কি বিমর্ষ হয়। অবশ্য বিমর্ষ হবার কোনও লক্ষণ দেখি না সমাজের কোনও স্তরে। সকলে লুটছে, সকলে খাচ্ছে, সকলে চাইছে ‘নারী-সম্পদ’। নারী অনেকটা দোপিয়াজা মাংসের মতো, খেতে মজা। নারী অনেকটা আমের আচারের মতোও—একে চেটেও মজা।
২
নারী এমনই এক মজাদার বস্তু এ-দেশে, পুরুষেরা এই মজা দেবার বস্তুটিকে বিগড়ে যেতে দেখলেই দেবে চড়, দেবে লাথি, দেবে তার গলা টিপে, মারবে দা দিয়ে কুপিয়ে। আমাদের গ্রামগুলোয় যৌতুক না দেবার অপরাধে বধূহত্যা এখন ডালভাতের মতো। মেরে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া, মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া এখন খুব একটা দক্ষ হাতেরও কাজ নয়। পুলিশ দু’একদিন খোঁজাখুঁজি করে। খোঁজাখুঁজি অবশ্য আসামি ধরবার তাগিদে যত না, তার চেয়ে বেশি কিছু টাকাপয়সা নেবার আশায়। খুনখারাপির মামলা-মোকদ্দমায় নাকি নানারকম টাকাপয়সার খেলা চলে।
কিন্তু যৌতুক সমস্যার হবে কী? যৌতুক দেবে বলে মেয়েটিকে কারও কাছে গছিয়ে দরিদ্র পিতা যদি ব্যর্থ হয়- যৌতুকের টাকা, ট্রানজিস্টর, সাইকেল, ঘড়ি জোগাড় করতে? শুনেছি যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া—দুটোই নাকি আইনত নিষিদ্ধ। এ-কথা কেবল শুনেছিই। অথচ এই নিষিদ্ধ কাণ্ডটি ঘটেই যাচ্ছে নিরন্তর। মেয়ের বাবার কাছ থেকে ধনসম্পদ পাবার আশায় পুরুষেরা উৎসাহী হয় বিবাহে। দেনমোহরের টাকাও দেয় কমিয়ে। কারণ যখন খুশি তখন তালাকের পথটি মসৃণ করা চাই যে! মেয়ের বাবা সময়ের হেরফের করলে পুরুষেরা মেয়ের বুকের খাঁচা থেকে প্রাণটি বের করে নেয়, যেন খাঁচা থেকে অকম্পিত হাতে বের করে নেওয়া পোষা কবুতর।
৩
লোকে বলে, পুরুষেরা খাটে বেশি। এই বাক্যটি যে কত বড় মিথ্যে একটি বাক্য, তা অনেকেই জানে না। ধরা যাক, গ্রামের একটি সচ্ছল বাড়ি—কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জাগবে বাড়ির ‘মেয়েমানুষ’টি, সে উঠোন ঝাঁট দেবে এবং ঘর যদি মাটির হয়, সে একাই প্রতিটি ঘর লেপবে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চুলো ধরাবে। লকড়ি না থাকলে কুড়োলে লকড়ি কেটে নিয়ে তবে ধরাবে। চুলোয় ভাত চড়াবে, ডাল-তরকারি নয়, কিছু পিঠে-টিঠে। এসবের আয়োজন করতে হয় তাকে একাই। এই কাজ সারবার মধ্যে হয়তো দেখা যায় বাড়ির পুরুষটি একটি দাঁতন হাতে নিয়ে দাওয়ায় বসে। শীতের রোদ পোহায়, পাড়াপড়শি অথবা বাড়ির পুরুষ-আত্মীয়দের সঙ্গে বসে, গল্পগুজব হয়। গোরুগুলো গোয়ালঘর থেকে বার করে। বার করে এসে পিঁড়িতে বসে।
মেয়েমানুষটি পুরুষটির থালায় ভাত বেড়ে দেয়, ডাল-তরকারি দেয়, লবণ দেয়, কাঁচা লঙ্কা দেয়, জল দেয় গ্লাসে। পুরুষটি খেয়ে ঢেঁকুর তুলে চলে যায় খেতে। খেতে গিয়ে পুরুষটি চাষ করে, ধান বোনে, সার দেয় নয়তো ধান কাটে। সেই ধান বাড়ি নিয়ে আসে। ধরা যাক, ধান বাড়ি এল। বাড়ির মেয়েমানুষটি সেই ধান মাড়াল, ধান নিয়ে বড় বড় ডেকচিতে তুলে সেদ্ধ করল, ঢেঁকিতে ধান ছাটল, সে ধানের চাল বাড়ির গোলায় রাখল। মেয়েমানুষটি ধান মাড়াই ও সেদ্ধর ভারী ভারী কাজের ফাঁকে এসে চুলোয় ভাত বসায়। তরকারি রাঁধে। আর পুরুষটি পুকুর থেকে স্নান সেরে মাথায় সরষের তেল মেখে মাদুর বা পিঁড়িতে বসে। তৃপ্তি করে খায়।
মেয়েমানুষটি গোয়ালের গোবর সাফ করে। পুরুষটি খেয়েদেয়ে বাইরে বেড়াতে যায়। অথবা দাওয়ায় বসে হুঁকো খায়। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে। বাড়ির মেয়েমানুষটি গোরুর খাবার জন্য ভাতের মাড়ের সঙ্গে নুন গুলে দেয়, খড় কেটে দেয়। সেই সকালে দু’মুঠো পান্তা মুখে দিয়েছিল, সন্ধে নেমে আসে, তার আর খাবার সময় হয় না। আবার সন্ধের পর কুপি বা হারিকেন জ্বালিয়ে খাবার দেবার আয়োজন করা, থালাবাসন মাজা, ঘর-উঠোন ঝাঁট দেওয়া। মেয়েমানুষের সময় নেই খায়, সময় নেই চুল বাঁধে, শাড়ি পালটায়। বিকেল-সন্ধে হেঁটে বেড়িয়ে বাড়ির পুরুষটির আবার খিদের উদ্রেক হয়। সন্ধের পর পরই আবার খেয়েদেয়ে সে বিছানায় শোয়। মেয়েমানুষটি সব কাজ সেরে ঘুমোতে আসে—পুরুষটি তখন তার ক্লান্ত, জীৰ্ণ, আধপেট-খাওয়া, ঘর্মাক্ত শরীরটিকে ভোগ করে। নারী অবশ্য জানে না, এই সম্ভোগে তার প্রাপ্য কী, জানে এতে কেবল পুরুষেরই তৃপ্তি।
পরিশ্রম নারীই করে বেশি। পুরুষের ঘরের গোলায় নারী ধান ভরে দেয়। তার নিজের গোলা থাকে শূন্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন