তসলিমা নাসরিন
মীরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি খুঁজে পেতে খুব কিন্তু অসুবিধে হয়নি আমার। ভবানীপুরের বৃক্ষশোভিত একটি দোতলা বাড়ি। আমার হাতে শ্রীনিখিল সরকারের চিঠি। চিঠি দেখালে ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেবেন। এমনিতে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না, দরজায় নোটিস সেঁটে দিয়েছেন ‘দেখা করা নিষেধ’। একবার নাকি কোনও এক সাংবাদিককে দরজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
চিঠি হাতে। তবু ভয়ে বুক কাঁপে, যদি বলে বসেন—না, দেখা হবে না! কড়া নাড়ি। ভেতর থেকে কর্কশ স্বরের একটি ‘কে’ শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডে আঘাত করে। কর্কশ স্বরের লোকটি দরজা ফাঁক করে গলা বাড়ালে চিঠিটি দ্রুত তার হাতে চালান করে দিই। খানিক পরে ভেতরঘর থেকে বেরিয়ে আসেন অপরূপ সেই নারী, কোমল, ধবলবসনা নারী। আমি তাঁর পেছন পেছন একেবারে ভেতরে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকি। যে-বারান্দা পেরিয়ে ভেতরঘরে ঢুকি, সে-বারান্দায় স্তূপ করে রাখা ঢালাই-এর কাজ, ছাঁচ, বড় এক বুদ্ধমূর্তি। মূর্তির গায়ে লেখাজোখা। ব্রোঞ্জের গায়ে পদ্য লেখা—একেবারেই মীরা মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব।
স্নিগ্ধ নারীটিকে অপলক দেখি। কী কথা বলব তাঁর সঙ্গে, আমি চিত্রকলার কিছু জানি না, ভাস্কর্যের বিষয়-আশয় কী আর বুঝি, কেবল দু’চোখ ভরা মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া! মীরা মুখোপাধ্যায় আমাকে তাঁর বিছানায় বসালেন, নিজেও বসলেন।
পুরনো বাড়ি। লোহার গরাদের ফাঁক গলে সকালের রোদ এসে পড়ছে ধোয়া মেঝেয়। ঘরের মেঝেয় রাখা এক সাঁওতালি মেয়ে, দু’হাতে ঝুড়ি বুনছে। দেখে এত ভাল লাগে যে, চোখ ফেরাতে পারি না, মেয়েটির গলাভরতি মালা, গলাটি লম্বা হয়ে মিশেছে শরীরে। পাশে আরেকটি মূর্তি, মায়ের মূর্তি, নীচে পিলপিল করছে তার ছানাপোনা। আরেক পাশে এক বিচারসভা, সভায় জজ বসেছেন, উকিল-ব্যারিস্টার আছেন, আর কাঠগড়ায় আছেন মীরা মুখোপাধ্যায় নিজে। ক’দিন আগে বাড়ি নিয়ে এক মামলা হল, কোর্ট অবধি দৌড়ুতে হল, সেটিরই ছবি ধাতুতে গড়ে রেখেছেন।
আমার ইচ্ছে করে স্নিগ্ধ নারীটির হাত একবার ছুঁয়ে দেখি, কী করে এই হাত ছবি আঁকে, ঢালাইয়ের কঠিন কাজে এই হাত কী করে নিবেদিত হয়, বাটাল হাতুড়ি নিয়ে এই হাত ব্রোঞ্জ কেটে কেটে জীবন তৈরি করে কী করে, একবার ছুঁয়ে দেখি।
ছোটবেলায় আমার স্কুলে যেতে হচ্ছে করত না, আমার বাগান ভাল লাগত, ভাল লাগত ফুলের বাগান। গাছগাছালির সঙ্গে মনে-মনে কথা বলতাম। লেখাপড়ায় মন বসত না।’ মীরা মুখোপাধ্যায়ের কথার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। কণ্ঠে তাঁর আবেগ উপচে পড়ে। বললেন, কখনও নিজেকে ভাবতে দিইনি যে, আমি মেয়ে, ভেবেছি মানুষ, মেয়ে হয়েছি বলে আলাদা করে কারও কাছে স্বাধীনতার দাবি করিনি। আমি একটি জিনিসই সারা জীবনে বুঝেছি—কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি করে নয়, পথে নেমে এই করো-সেই করো স্লোগানে নয়, মানুষের যা হয় তা কাজেই হয়। আমি যদি ভাল কাজ করতে পারি, আমার ভাল কাজই বুঝিয়ে দেবে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আমি তাই মুখ বুজে কাজ করে গেছি।
মীরা মুখোপাধ্যায় কেবল এগিয়ে গেছেন, থামেননি। পথে কতরকম প্রতিবন্ধক ছিল। তখনকার রক্ষণশীল সমাজ ধরে বেঁধে বিয়েও দিয়েছিল তাঁকে, মেলেনি। মেলেনি বলে মীরা কিন্তু আপস করেননি। লোকে তাঁকে মন্দ বলেছে। মীরার সবচেয়ে বড় গুণ, মীরা লোকের কথায় কখনও ফিরে তাকাননি। গান ভালবাসতেন, ছবি আঁকতে ভালবাসতেন, সবুজ পাতার সঙ্গে সেই শৈশব থেকে যাঁর নিবিড় ভাব তাঁকে কি সমাজ-সংসারের জালে ধরা যায়, নাকি চার দেয়ালের ঘরে তাঁকে কোনওরকম মানায়?
মীরা মুখোপাধ্যায়ের গানের গুরু বিমলাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। গান শেখাতে শেখাতে বলতেন—‘গান কি রোজ আসে, প্রথম প্রথম মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু একসময় এমন দিন আসবে যে, ওরা আর তোকে ছেড়ে দেবে না।’ মীরা গাইলেন ‘সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন কেমন করে’—গাইলেন, কিন্তু গান নয়, ধাতুর কাজই তাঁকে ছেড়ে আর কোথাও গেল না। ওরা আসল কিন্তু ছেড়ে গেল না। সুখেদুঃখে ওরা তাঁর আঙুলে জন্মের মতো ঘর বাঁধল।
লোকে যাকে ঘর-করা বলে, সেই ঘর-করা মীরার হয়নি, এ-নিয়ে কোনও দুঃখ তাঁর নেই। তাঁর সংসার গোলবিবি, হারানের মা, নুরবানু, অসিত, প্রশান্ত, মায়া, গৌরী, চৈতালি, হরেন, প্রতাপ, নজরুলের বউকে নিয়ে। ওরা ঘুঁটে দেয়, ঢালাইয়ের পর ছাইয়ের ভেতর থেকে কাঠকয়লা বাছে। মীরা নিজে ধাতু গালাই করেন, নিজে ঢালাই করেন, ধাতুকে যত আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেন, তত বোঝেন–ধাতুর মধ্যে অদ্ভুত এক রহস্যময়তা আছে।
রবীন্দ্রসংগীতেও মন ভরেনি মীরার, তাঁর আসলে অন্য কিছু চাই। বাঙালি-অবাঙালি প্রতিবেশীরা তাঁকে পাড়াছাড়া করতে চেয়েছে, বাড়িওলা বাড়ি ছাড়তে বলেছে, দিল্লিতে ছবি আঁকবার ক্লাসে যুবকেরা ফাঁক পেলেই গায়ে হাত বুলোতে চাইত—কেউ পারেনি, কেউ তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে মাথা সোজা করে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেনি। সব তুচ্ছ করে মীরা তাঁর কাজ করে গেছেন। সংসার ফেলে চলে আসা মেয়েটির গায়ে আঁচড় দিতে হয়েছে, গোপনে কামড় বসাতে চেয়েছে সমাজের ভালমানুষেরা। সকল থাবা থেকে গা বাঁচিয়ে মীরা কেবল কাজ করেছেন। নোংরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই তাঁর নিরন্তর সংগ্রাম।
আমার সঙ্গে এত কথা বলবার তাঁর কোনও দরকার ছিল না। না বললেও পারতেন। বললেন—ঘোল খাবে? ঠান্ডা ঘোল খাওয়ালেন। নিখিলদা সম্ভবত লিখে দিয়েছেন, ও আপনার সঙ্গে গল্প করতে চায়। যে মানুষ কারও সঙ্গে দেখাই করেন না, দরজা থেকে দর্শনার্থী বিদেয় হয়, সেখানে একেবারে শোবার ঘরে বসে ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে ঘরভরতি ভাস্কর্য দেখতে দেখতে স্বয়ং ভাস্করের সঙ্গেই দীর্ঘ সময় কথা বলবার সৌভাগ্য খুব কমজনেরই হয়, সে আমি নিশ্চয় বুঝি।
সত্তরের কাছাকাছি বয়স তাঁর, বড় একটি বই লিখেছেন, ভারতের বিভিন্ন এলাকার ধাতুশিল্প নিয়ে। দিনরাত ব্যস্ত থাকেন, একটানা অনেক দিন ঢালাইয়ের কাজ করেন, তারপর শুরু হয় হাতুড়ির ঘায়ে বুদ্ধের নাক-চোখের আদল দেওয়া, নৃত্যরত রমণীদের হাত-পায়ে ছন্দ দেওয়া, মোষের পালের পেছনে রাখালের শরীর গড়া। মীরা একেবারেই বসে থাকবার মানুষ নন, গোলাপের বাগান থেকে উঠে আসা মুগ্ধ কিশোরী এখন হৃৎপিণ্ডের অসুখে ভুগছেন কিন্তু দুটো কর্মঠ হাতকে তিনি একটি দিনের জন্যও অশ্রদ্ধা করেননি। সমাজের ছকবাঁধা জীবনের বাইরে বেরিয়ে তিনি কম গলিঘুপচি, কম আঁধার পেরিয়ে আলোর পৃথিবীতে আসেননি। আঁধারে একলা ঘরে তাঁর মন মানেনি—তাই স্কেচ করবার কালিকলম, ছবি আঁকবার রংতুলি, মূর্তি গড়বার ব্রোঞ্জ ধাতু সবকিছুর মধ্যে ডুবেছেন, সারা জীবন চেষ্টা করেছেন ভাল মানুষ হবার, ভাল ভাস্কর হবার। তিনি বলেন, ভাল ওইটুকু হল, যেটুকু হল।
মীরা মুখোপাধ্যায়ের হয়নি কী, সবই হয়েছে। শান্তিনিকেতন, দিল্লি, মিউনিখ ঘুরে এসে, ভারতের আনাচকানাচ চষে এসে, শাস্ত্রীয় ধাতুর স্বভাব সব শিখে এসে প্রিয় কলকাতায় যখন কাজ করতে চাইলেন—তাঁকে চাকরি দেওয়া হল কারিগরের, দিনে দশ টাকা মজুরি। মীরার দারিদ্র্যও দেখা হয়েছে কম নয়, এই দুর্ভাগা দেশ জানত না, কাকে সে দশ টাকা মজুরি দিয়ে পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে, এ-মানুষ কোনও সস্তার মেয়েমানুষ নয়, এ-মানুষ মীরা মুখোপাধ্যায়, যাঁর ভাস্কর্য কিনতে লক্ষ টাকা নিয়ে লোকে দরজায় ভিড় করে, মীরা সেই দরজার দিকে এখন বড় একটা তাকান না।
‘ব্রোঞ্জের কাজ আসলেই খুব এক্সপেনসিভ।’ বললেন—‘লোকে বারগেইন করে, শেষ অবধি দেখা যায় ধাতুর দামই ওঠে না, শ্রমের দাম তো বাদই। শিল্পের সঙ্গে কি বারগেইনিং মানায়?’ এই নির্মোহ, নির্লোভ, প্রচারবিমুখ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন তাঁর কাজকে। তিনি বলেন, ‘ধাতু কোনওরকম গাফিলতি আর অন্যমনস্কতাকে ক্ষমা করেনি। আগুনের মতো শক্তি দিয়ে সে আমার সমস্ত সত্তাকে পাকড়ে রেখেছে। আর আমিও আমার শক্তি আছে কি নেই—এ-নিয়ে প্রশ্ন করিনি। ভালবেসে কাজ করে গেছি।’ কাজ হয়তো অনেকেই করে কিন্তু ভালবেসে ক’জন করে মীরা মুখোপাধ্যায়ের মতো? বস্তুর প্রাণকে বার করে আনতে চেয়েছেন তিনি। সমস্ত সাধারণের ভেতর থেকে অসাধারণকে বার করে এনেছেন। এতেই তাঁর মুক্তি। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, নদী ডিঙোতে ডিঙোতে তিনি তাঁর প্রিয় প্রকৃতির সঙ্গে গোপন আলাপ সেরেছেন। আসমুদ্র হিমাচল ছুটতে ছুটতে নিজেই বলেছেন, ‘সবারে দিয়েছ ঘর, এ ভবেশ এ শঙ্কর আমারে দিয়েছ শুধু পথ। ‘
মীরা মুখোপাধ্যায় সেই পথ পেরিয়ে কি গন্তব্যে পৌঁছেছেন, নাকি শিল্পীর কোনও গন্তব্য থাকতে নেই! শিল্পীর থাকবে যখন যেদিকে খুশি, সেদিকে যাবার অবাধ স্বাধীনতা।
একসময় দুপুর হয়ে এল, কাজপাগল মানুষকে এভাবে বসিয়ে রেখে গল্প করতে ইচ্ছে হয়নি আর। যদিও শুনতে ভাল লাগছিল শৈশব থেকে একটি-একটি করে তাঁর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসবার গল্প। জীবনের অনেক দেখেছেন তিনি, অনেক জেনেছেন। আমি তাঁর তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্র বালুকণা, যদি তিনি মরুভূমি হন, তাঁর তুলনায় আমি এক বিন্দু জল, যদি তিনি সমুদ্র হন। মীরা ভাল শিল্পী হতে চেয়েছিলেন, নিখিল ভারত জানে মীরা ভাল শিল্পী হয়েছেন। মীরা ভাল মানুষ হতে চেয়েছিলেন, সম্ভবত অনেকেই জানেন এবং আমিও জানি, মীরা ভাল মানুষ হয়েছেন, ভাল মানুষ তিনি তাঁর জন্ম থেকেই ছিলেন নিশ্চয়। তাঁর অসাধারণ দুটো হাত আবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, ছুঁয়ে বলি, আপনাকে আমার বড় ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। আমি এমন আশ্চর্য স্নিগ্ধ-সুন্দরের পাশে কখনও ঘনিষ্ঠ বসিনি। আবার নিশ্চয় দেখা হবে আমাদের।
বুকের ভেতর তাঁর অনেক আগুন ছিল, আমি বুঝি। যে আগুনে এখন ধাতু ঢালাইয়ের কাজ চলে, সে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর কাজের আনন্দে গভীর ডুবে থাকেন। এ আগুনের চেয়ে বুকের সেই আগুন কিছু কি কম দহন করেছে তাঁকে? সিঁড়ি বেয়ে নামতে না বলি, তবু তিনি নেমে আসেন, আমাকে বিদায় দিতে একেবারে নীচের গেট অবধি। বড় ভাল লাগে তাঁকে, তাঁর কঠোর সারল্যকে।
আমি কেবল তাঁর ঘোরে ডুবে থাকি, তাঁর স্বপ্নে আমি মগ্ন হই, আমি তাঁর বেদনা ও ভালবাসা কণ্ঠে ধারণ করে বলি—সখী, আঁধারে একেলা ঘরে আমারও মন মানে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন